মোরশেদ শফিউল হাসান
১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রগতিশীল মাসিক ‘সীমান্ত’ (১৯৪৭-১৯৫২) একটি ‘দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যা’ (৩ বর্ষ ১ সংখ্যা, বৈশাখ ১৩৫৭) প্রকাশ করে। আমাদের জানামতে, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের আর কোনো পত্রিকা তখন পর্যন্ত এরকম কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শুধু তাই নয়, এই পত্রিকার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন এবং যাঁরা এতে লিখতেন মূলত তাঁদের উদ্যোগেই এ সময় চট্টগ্রামে ‘শান্তি সম্মেলন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং তরুণদের নিয়ে ‘শান্তি ফৌজ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করা হয়। দাঙ্গা প্রতিরোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাই ছিলো যার উদ্দেশ্য। ‘সীমান্ত’-এর এই দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যায় যাঁরা লিখেছিলেন এবং যাঁদের লেখা পুনর্মুদ্রিত হয়েছিলো তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, অন্নদাশঙ্কর রায়, শওকত ওসমান, যোগেশচন্দ্র সিংহ, সুচরিত চৌধুরী (ছদ্মনামে), মতিউল ইসলাম, ওহীদুল আলম, মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া শওকত ওসমানের অনুবাদে কৃষণ চন্দরের একটি গল্পও (‘দুই অমৃতসর’) সংখ্যাটিতে ছাপা হয়েছিলো।
‘সীমান্ত’-এর এই দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যার প্রথম রচনাটি ছিলো একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ, যার শিরোনাম ছিলো ‘পশ্চিমবঙ্গের কবি, শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিকট একটি আবেদন’, আর এর লেখক ছিলেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত লেখকের সুবিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতি-কথা’য় (১৯৫৮) পরিবর্তিত শিরোনামে (‘একটি নিবেদন’) অন্তর্ভুক্তির সময় অজ্ঞাত কোনো কারণে প্রবন্ধটির বড় অংশ বর্জিত হয়। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির অপতৎপরতা মোকাবেলায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের কর্তব্য সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ‘এক বিরাট শান্তিকামী প্রতিষ্ঠান’ গড়ে তোলার আবশ্যকতার কথা বলেন। ‘দৃঢ়হস্তে দুষ্কৃতকারীদের দমন এবং নিপীড়িত আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের মনে আশা ও বিশ্বাস উৎপাদন’ই হবে যার উদ্দেশ্য। তবে তাঁর মতে এই প্রতিষ্ঠান বা ‘শান্তিফৌজ’ গঠন করতে হবে ‘রাজনীতি ও ধর্মের নামে নয়, মনুষ্যত্বের নামে।’ এ বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, ‘আমি রাজনীতি ও ধর্মের নামে এগিয়ে আসতে নিষেধ করছি এইজন্য যে, দেখতে পাওয়া গেছে, এই দুই নামে মানুষ সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্রমনা হয়ে পড়ে, মানুষের ভেতরের মহান প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষ দলগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠতে পারে না।’
তিনি লিখেছেন, ‘অবশ্য ধর্ম আর রাষ্ট্রেরও এক্ষেত্রে কথা বলার আছে। ধর্ম বলতে পারে : সাম্প্রদায়িক হত্যাকার্য ধর্মনীতির অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়, ধর্মের মনুষ্যত্ব উদ্বোধক বাণীগুলো প্রচার করেও ধর্ম প্রচারকরা এর প্রতিবিধান করতে পারেন।’ লেখক চেয়েছেন, ‘রাজনীতি ও ধর্ম তাদের তরফ থেকে কাজ করুক’, তবে তাঁর অভিমত, ‘রাজনীতির মানে বাস্তবতার নামে ছোট ছোট কথা বলা, আর ধর্ম যে বর্তমানে তার উঁচু আসন থেকে রাজনীতির হীনস্তরে নেমে এসেছে তা তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। তাই তার মুখেও রাজনীতির মতোই ছোট ছোট বুলি, কোনো প্রকার মহত্বের প্রেরণা সে আজ আর দিতে পারে না।’ মোতাহের হোসেন চৌধুরী এ কথাগুলো লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে।
পশ্চিমবঙ্গের কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের (প্রবন্ধে তিনি বিশিষ্ট কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন) প্রতি ‘দলাদলি ভুলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে একটা ইউনাইটেড ফ্রন্ট বা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি লেখেন, ‘বর্বরতা যে কারণেই ঘটুক না কেন তা বর্বরতাই, ওইখানে আগে হয়েছে, এখানে পরে হচ্ছে, ওইখানকার তুলনায় এখানকার মৃত্যুর হার অনেক কম, এ ধরনের জঘন্য উক্তি শুনে শুনে মন বিষিয়ে উঠলো- আর সহ্য হয় না।’ এ বিষয়ে রাজনীতিকদের ভূমিকার সমালোচনা বা তাঁদের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করে মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘জটিলতা বাড়ানোই তাঁদের কাজ, কমানো নয়। কোনো ব্যাপারে মুক্ত মনের পরিচয় দিতে পারেন না বলে তাঁরা প্রায়ই হিতে বিপরীত ঘটান। মানুষ ও মনুষ্যত্বকে বড় করে না দেখে রাষ্ট্রীয় প্রেস্টিজ বা ইজ্জতকে বড় করে দেখার দরুন তাঁদের দ্বারা কোনো ব্যাপারেরই সার্থক সমাধান হয় না। ইজ্জত আর জিত এই দুই অপদেবতার তোষণ করতে গিয়ে তাঁরা জাতীয় জীবনে সর্বনাশই ডেকে আনেন, কল্যাণ নয়। তাই তাঁদের সম্বন্ধে সাবধান হওয়া দরকার।’
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ বা মোকাবেলায় চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘এখন আমি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী ও সাহিত্যিকদের একটা সুসংবাদ দিচ্ছি। আশা করি তাঁরা সংবাদটি পেয়ে খুশি হবেন। আমাদের চাটগাঁ শহরের তরুণ শিল্পী ও সাহিত্যিকরা মিলে এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘শান্তি সম্মেলন’। এই প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে একটি শান্তি ফৌজও গড়া হয়েছে। তাঁরা মহল্লায় মহল্লায় শান্তির বাণী প্রচার করছেন এবং যাতে দুষ্কৃতকারীদের মনে ভয় এবং সংখ্যালঘুদের মনে আশা ও বিশ্বাসের সঞ্চার হয় তার ব্যবস্থা করছেন। তরুণ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের সজীব মনুষ্যত্ববোধে আমরা মুগ্ধ। নিরাশার আঁধারে তাঁরাই আমাদের আশার আলো।’
‘সীমান্ত’-এর দাঙ্গাবিরোধী সংখ্যার দ্বিতীয় রচনাটি ছিলো আবুল ফজলের একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ, নাম ‘ইতিহাসের আহ্বান’। এতে ১৯৫০ এর দাঙ্গা পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও তরুণ সমাজের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার উল্লেখ করে তিনি তাঁর হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘পাকিস্তানের এখানে ওইখানে যখন আগুন লেগেছিলো – সাম্প্রদায়িক আগুন, পাকিস্তানের অসহায় নাগরিকের ঘর যখন দুর্বৃত্তের হাতের আগুনে জ্বলছিলো, নিরীহ নিরপরাধ নাগরিকের ওপর যখন মুষ্টিমেয় গুপ্ত হত্যাকারীর কাপুরুষোচিত আক্রমণ চলছিলো, তখন তারা পূর্বের মতো বিদ্যুদ্বেগে সাড়া দেয়নি, বজ্রশক্তিতে রুখে দাঁড়ায়নি দুর্বৃত্তের সামনে এসে, ছুটে বের হয়নি ঘর থেকে পথে। ঘর ছেড়ে, হোস্টেল ছেড়ে তারা কেন দলে দলে বেরিয়ে এলো না, এগিয়ে এলো না বাইরে, কেন ছুটে গেলো না হিন্দু প্রতিবেশীর ঘরের দুয়ারে, সতীর্থ হিন্দু ছাত্রদের কাছে? কেন দাঁড়ালো না দলে দলে রাস্তার পাশে ও পথের মোড়ে মোড়ে দুর্বৃত্তের হাত থেকে অসহায় পথচারীকে বাঁচার জন্য?’ আবুল ফজলের মতে, ‘এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন সর্বনাশা আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা, নিজের মনুষ্যত্ব ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলায় মোতাহের হোসেন চৌধুরী ও আবুল ফজল আমাদের এই দুই মনীষী লেখকের উভয়েই মৌখিক প্রতিবাদ (বক্তব্য-বিবৃতি) বা প্রতীকী কর্মসূচি পালনের চেয়ে, বিশেষ করে তরুণদের উদ্যোগে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন।
[সূত্র : ড. ইসরাইল খান ও জওশন আরা রহমান (সম্পাদিত) ‘সীমান্ত সংগ্রহ’ (২০০৫), মোরশেদ শফিউল হাসান, ‘পূর্ব বাঙলায় চিন্তাচর্চা : ১৯৪৭-১৯৭০ : দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া’, সৈয়দ আবুল মকসুদ (সম্পাদিত) ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচনাবলী’ : ১ম খণ্ড (১৯৯৫)। Morshed Shafiul Hasan-র ফেসবুক ওয়ালে লেখাটি পড়ুন।
আপনার মতামত লিখুন :