শিরোনাম
◈ সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বাড়লো ১০ টাকা  ◈ নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের আহবান শিল্পমন্ত্রীর  ◈ প্রচণ্ড গরম থেকেই ঘটতে পারে মানবদেহের নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি ◈ অবশেষে রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি  ◈ ইসরায়েল পাল্টা হামলা করলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান: উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ মিয়ানমারের আরও ১০ সেনা সদস্য বিজিবির আশ্রয়ে ◈ সয়াবিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই: বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত বিএনপির ◈ কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকি, আইনের শাসনে জীবনযাপন করি: ড. ইউনূস ◈ মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে ঢাকা ফিরছিলেন রফিক, পথে প্রাণ গেল সবার

প্রকাশিত : ১৩ অক্টোবর, ২০২১, ০১:৪০ রাত
আপডেট : ১৩ অক্টোবর, ২০২১, ০১:৪০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শরিফুল হাসান: নাজিবুর রহমান : একজন মানুষ কতোটা সৎ, বিনয়ী ও আদর্শবান হতে পারেন তাঁর উদাহরণ তিনি

শরিফুল হাসান: ঘটনা [১] : তিনি তখন বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার। একদিন দুপুরে তিনি দেখলেন তার দুপুরের খাবারের বাটিতে দু’টুকরা মাংস বেশি। জেলার এসপি বলেই কী তাকে দু’টুকরা মাংস বেশি দেওয়া হলো? অতিরিক্ত এই সুবিধা নিতে তিনি নারাজ। তাৎক্ষণিক বাবুর্চিকে ডাকলেন। এরপরের প্রশ্ন, কী ব্যাপার, আমার প্লেটে মাংস বেশি মনে হচ্ছে কেন? বাবুর্চি: না স্যার, আজ সবার ভাগেই একটু বেশি করে পড়েছে। আচ্ছা তা হলে আরেকটা বাটি আমার কাছে নিয়ে আসো। বাবুর্চি আরেকটা বাটি নিয়ে আসলেন। এসপি: এই বাটিতে তো দু’টুকরা মাংস। তাহলে আমার বাটিতে চার টুকরা কেন? বাবুর্চি ভড়কে মাথা নিচু করলেন। এসপি সাহেব বললেন, আমার বাটি থেকে দু’টুকরা নিয়ে যাও। আর কোনোদিন বেশি দিবা না। একজন কনস্টেবলকে যতোটুকু দেবে, আমাকে ঠিক ততোটুকু দেবে।

ঘটনা [২] এটাও বান্দরবানের। নগরের কোলাহলমুক্ত, প্রাকৃতিক দৃশ্য আর হরেক রকমের বাহারি ফলের সমারোহ এই জেলায়। পুলিশ লাইনও তার ব্যতিক্রম নয়। ছোট-বড় নারিকেল গাছে প্রচুর নারিকেল ধরেছে। একদিন লোক দিয়ে গাছের সমস্ত পাকা নারিকেল পাড়লেন এসপি। বললেন, দেখি আমাকে দু’টা নারিকেল দাও। জেলার পুলিশ সুপার নারিকেল খেতে চেয়েছে শোনে সবাইতো চরম খুশি। পরে স্যার দু’টা নারিকেল নিলেন এবং তার সমমূল্য পরিশোধ করলেন এবং বাকি নারিকেল বিক্রি করে সমস্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিলেন। একজন পুলিশ সুপারকে নিয়ে যখন এই ধরনের ঘটনা পড়ছিলাম ভীষণ মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এই দেশে অনেক পুলিশের বিরুদ্ধে যখন নানা অভিযোগ তখন এমন অসাধারণ সৎ মানুষের কথা শুনতে আসলেই দারুণ লাগে। গত কয়েকদিন ধরে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার স্মৃতিচারণ দেখলাম মানুষটাকে নিয়ে। কয়েকটা উল্লেখ করছি। ঘটনা

[৩] স্যার যখন ছুটিতে বাড়ি যেতেন, সরকারি কোনো প্রটোকল নিতেন না। একবার বাড়িতে যাওয়ার সময় বাস স্টপেজ পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য স্যারের ড্রাইভার রিকোয়েস্ট করলেন। স্যার বললেন, এ গাড়িটা সরকার আমাকে সরকারি কাজের জন্য দিয়েছে, ব্যক্তিগত কাজের জন্য নয়। পরে বাস স্টপেজ পর্যন্ত স্যার সিএনজিতে করে গেলেন। আমি আসলেই মুগ্ধ হয়েছি এই ঘটনায়। এই দেশের নিউমার্কেটে যান, বাজারে যান, স্কুল-কলেজে যান, রেলস্টেশনে যান! দেখবেন সরকারের সব জরুরি কাজে নিয়োজিত গাড়ি! এই দেশের অনেক সরকারি কর্মকর্তা যখন নিজের গাড়িটাকে শুধু ব্যক্তিগত কাজে না, স্ত্রী-সন্তানদের সেবায় নিয়োজিত করেন, তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি আসলেই এমন হন, তার সততা মুগ্ধ করে।

বলছিলাম বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি নাজিবুর রহমান, এনডিসি, পিএইচডির কথা। সদ্য তিনি অবসরে গেছেন। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। সেগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদার প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন অতিরিক্ত এই আইজিপি। তাকে নিয়ে সেখানকার পুলিশ ছাত্ররা লিখেছেন, আইজিপির পর পুলিশের এতো বড় পদে কর্মরত থেকেও তিনি ছিলেন ভীষণ বিনয়ী। একজন মানুষ কতোটা সৎ, বিনয়ী আর আদর্শবান হতে পারেন উদাহরণ তিনি। সারদার স্মৃতিচারণ করে পুলিশের এক কর্মকর্তা লিখেছেন, সারদায় প্রতিদিন ভোরে পিটিতে যাওয়ার সময় স্যারকে পেতাম ফজরের নামাজে যাওয়ার সময়। মাঝে মাঝে পিটি থেকে ফেরার সময়ও পেতাম। স্যারের একটা করল্লা গাড়ি ছিলো। যেখানে এসপিরা পাজেরো গাড়ি চালাতেন সেখানে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি হয়েও করল্লা গাড়ি! ড্রাইভার ছিলেন না। স্যারকে নিজেই ড্রাইভ করতে দেখতাম। হাত উঁচু করে প্রত্যেকের সালাম নিতেন। মুখে থাকতো মুচকি হাসি। ভীষণ অমায়িক মানুষ তিনি! একাডেমিতে প্রিন্সিপালের বাসভবন সেই ঐতিহাসিক ছোট কুঠিতে তিনি বাস করতেন না।

শোনা যায়, নিজের কাপড় তিনি নিজেই ধুতেন। এমনকি মায়ের কাপড়ও। পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করতেন। ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন। ক্যাডেটরা ট্রেনিংয়ে থাকা অবস্থাতেই ছুটি থেকে আসার সময় স্যারকে ট্রেন জার্নিতে পেতো। সেলফি তুলতো। কী মানুষ রে বাবা! স্যার অভিবাদন নেওয়ার জন্য যখন ডায়েচে আসতেন সিনা তিন ইঞ্চি বড় হয়ে যেতো! স্যারকে স্যালুট দিতে পেরে গর্ব হতো। স্যার যখন প্যারেড মাঠে আসতেন সারদার ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা কিছুই মনে হতো না। স্যার যখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। বহু পুলিশ কর্মকর্তা লিখেছেন, সারদার তপ্ত রোদে যখন স্যারের কণ্ঠে ‘আমার সন্তানেরা’ শব্দটি প্রতিধ্বনিত হতো তখন যেন শরীরের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হতো। সারদার প্রিন্সিপাল থাকাকালীন বহু কৃতিত্ব রেখেছেন তিনি। সারদার মাটিতে উৎপাদিত ফলমূল ও পুকুরের চাষকৃত মাছ কনস্টেবল থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত সমহারে বণ্টন করতেন।
স্যার সবসময় একটা ডায়ালগ বলতেন, ‘পুলিশ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ, পুলিশিং শ্রেষ্ঠ পেশা’। সারদায় পুলিশ একাডেমিতে স্যার যখন প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, স্যারের আপ্যায়ন বিলের লক্ষাধিক টাকা নিপদস্থ সকল পুলিশের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। নিজের আপ্যায়ন বিল এমনকি সোর্স মানি সকলের মাঝে বিলি করতেন। একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রত্যেক সহকর্মীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একই সত্যিই বিরল। স্যারের ছাত্র হিসেবে বলতে পারি স্যার শুধুই অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সাদাসিধে জীবনযাপন করা এ মানুষটা দু’দিন আগে অবসরে চলে গেলেন। তার ছাত্ররা লিখেছে, সত্যি মিস করবো স্যার আপনাকে, মিস করবো সারদা একাডেমির মাস্টার প্যারডে ‘আমার সন্তানেরা’ বলে ডাকা সম্বোধনকে। নিশ্চয়ই আপনি পুলিশ বাহিনীর জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সত্যি বলছি, আমি পড়ছিলাম আর আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিলো। কী অসাধারণ মানুষ। আরেকটু বোঝার জন্য গুগলে সার্চ দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার দেওয়া বক্তব্য খুঁজছিলাম গণমাধ্যমে।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রশিক্ষণ শেষে সারদায় নিয়োগ পাওয়া নতুন পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলছেন, জনগণ নির্যাতনের বিচার চাইতে এসে তোমাদের (পুলিশ) কাছে যেন নিরাশ না হয়। মনে রাখবে পুলিশ কোনো কিছুর বিচার করে না, তবে বিচারের খুঁটি হিসেবে কাজ করে। নতুন পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করা হলো। এই দায়িত্ব তোমরা দক্ষতার সঙ্গে পালন করবে। মনে রাখবে পুলিশ জনগণের সেবক। দায়িত্ব পালনকালে কোনোক্রমেই যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রয়ারি আরেকটি প্রশিক্ষণ শেষে তিনি বলছেন, আমি প্রিন্সিপাল, কলমের খোঁচায় ১৮ কোটি মানুষের সম্পদ চুরি করতে পারি। তখুনি সেটা করবো যখন মনে হবে যে আমার মৃত্যু হবে না! কিন্তু মানুষ হিসেবে তো আমাকে মরতেই হবে। কাজেই আমি সেটা করতে পারি না। মনে রাখবে পুলিশ কেবল মানুষ নয়। পুলিশরাই দেশের মানুষের সর্বোত্তম সেবক, সেটা সবসময় মনে রাখতে হবে।

বুকের মধ্যে কী সাহস থাকলে এভাবে কথা বলা যায়! এ দেশের প্রতিটি পেশায় যখন কমবেশি অসৎ মানুষদের দাপট তখন নাজিবুর রহমানের মতো মানুষের কারণে আবার শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। মানুষটির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। কাজেই তাকে মূল্যায়ন করতে আমি পারবো না। কিন্তু গত কয়েকদিনে তাকে নিয়ে কয়েকজনের লেখা পড়ে তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করছে। যেহেতু রোজ সকালে আমি ভালো কিছু লিখি। আমি আসলে জানি না স্যারের কতোজন ছাত্র তাকে অনুসরণ করে চলছেন। তবে আমার মনে হয় এ দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা, এ দেশের সরকারি কর্মকর্তারা নাজিবুর রহমানদের মতো মানুষকে অনুসরণ করতে পারেন। Shariful Hasan-র ফেসবুক ওয়ালে লেখাটি পড়ন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়