আবু হাসাদ: কৈশোরে এক তরুনীর প্রেমে পড়েছিল রায়হান আলী (১৯)। তাদের সেই সম্পর্কটি মেনে নেননি পরিবারের লোকজন। উল্টো কড়া শাসন। এতেই কিছুদিন মানুষিক ভাবে চরম হতাশায় ভুগছিল সে। এক পর্যায়ে খাওয়া-দাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। তার হতদরিদ্র পরিবারের লোকজন বিভিন্ন কবিরাজ পল্লী চিকিৎসকদের দারস্ত হয়েও কোনো লাভ হয়নি। পরিবারের দাবি রায়হান এখন পুরো মানুষিক প্রতিবন্ধি। আর অর্থ সংকটের কারণে ভালো চিকিৎসাও করাতে পারছেন না।
তাই মানুষের জানমালের ক্ষতির আশঙ্কায় তার পায়ে শিকল পরিয়ে গাছের সাথে বেধে রাখা হয়েছে। গত এক বছর থেকে এভাবেই চলছে তার শিকলবন্দি জীবন।
রায়হান আলী রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের পশ্চিম কান্দ্রা গ্রামের দুলাল মন্ডলের একমাত্র ছেলে।
রোববার (৩ অক্টোবর) সকালে রায়হান আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুটি বেড়ার খুপড়ি ঘর। এরমধ্যে একটি ঘরে তার ছোট বোন ও দাদী থাকেন। অপর একটি ঘরে বাবা-মা ও সবার ছোট আরেকটি বোন থাকেন। আর মানুষিক প্রতিবন্ধি রায়হানকে বাড়ির উত্তরপাশের একটি আমের গাছের সাথে তার ডান পায়ে শিকল পড়িয়ে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানেই কয়েকটি টিন দিয়ে ছাপরা তৈরি করে একটি চৌকি রেখে দেয়া হয়েছে।
রায়হানের চারপাশে মশার উপদ্রব। গত এক বছর থেকে এভাবেই গাছের সাথে শিকল বেধে তাকে রাখা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে তার ছবি তুলতে গেলে সে নিজেই বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলার পরামর্শ দেয়। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ছবি তোলার কারণে সে শুরু করে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল। সে সময় তার ছোট বোন নিলা খাতুন বদনায় পানি পান করতে দিলে সে শান্ত হয়।
দাদী সাজেদা বেওয়া বলেন, রায়হানের যখন ১০ বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। সে সময় রায়হার মাত্র ৫ম শ্রেণীতে উঠেছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে নানীর বাড়িতেই থাকতো। এরমধ্যে গত ২ বছর আগে নানীর বাড়ির পাশে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে। তাদের সে সম্পর্ক নানীর বাড়ির লোকজন মেনে না নেয়ায় সে মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকে সে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। কয়েকদিনের মধ্যে সে পুরো পাগল হয়ে যায়। এরপর থেকে মানুষজন দেখলেই মারধর গালাগালি ও বাড়িতে ভাংচুর শুরু করছিল। যার কারণে তার পায়ে শিকল পরিয়ে গাছে সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে।
এনামূল হক নামের তাদের একজন প্রতিবেশী বলেন, রায়হান সম্পর্কে আমার ভাতিজা হয়। ছোট থেকে সে খুবই শান্ত ও মেধাবী ছিল। তবে তার মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবারো বিয়ে করেন। অভাবের সংসারে রায়হানের পড়া বন্ধ হয়ে গেলে ঠাঁই হয় নানীর বাড়িতে। সেখানে প্রায় দুই বছর আগে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে আবার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখন সে মানুষিক রোগি। অভাব অনটনের সংসারে তার বাবা ঠিকমত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। হয়তো ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ্য হতেও পারে।
বাবা দুলাল মন্ডল বলেন, আমার প্রথম স্ত্রীর পক্ষে দুই ছেলে-মেয়ে। সে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আবার দ্বিতীয় বিয়ে করি। এই পক্ষের আরেকটি মেয়ে আছে। আমাদের একমাত্র বাড়ির ভিটা ৫ শতক জমি। সেখানে ভাইকে ভাগ দিলে আমার অংশ মাত্র আড়াই শতক। একমাত্র শরীর খাটিয়ে মানুষের জমিতে কাজ করলেই চলে সংসার।
তারমধ্যে দুটি মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিতেই রোজগারের বেশীর ভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। যার কারণে অভাব অনটনের কারণে টেনেকষে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন যায়। তার ওপর একমাত্র ছেলেটা অসুস্থ্য হয়ে এখন পাগল। টাকার অভাবে তার সু-চিকিৎসাও করাতে পারছি না। যখন কিছু টাকার যোগান দিতে পারি তখন বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তাকে ঠিকমত ওষুধ খাওয়ালে কিছু দিন ভালো থাকে।
শিকলে বেধে রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রায়হানকে ছেড়ে দিলে বাড়িতে ভাংচুর ও যাকে সামনে দেখে তাকেই মারধর করে। যার কারণে পায়ে শিকল পরিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। সেখানেই তার খাওয়া-দাওয়া ও থাকা। শুয়ে থাকার জন্য একটি চৌকি পেতে দেয়া হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আব্দুর মতিন বলেন, অসুস্থ্যতার কারণে এক যুবক শিকল বন্ধি এমন খবর আমার জানা নেই। তবে ওই রোগিকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে দেখে বলা যাবে তার কি সমস্যা।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুুরুল হাই মোহাস্মদ আনাছ বলেন, মানুষিক অসুস্থ্যতার কারণে একজন যুবককে বেধে রাখা হয়ে আর অর্থ সংকটে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ওই পরিবার আমার সাথে যোগাযোগ করলে সার্বিক ভাবে সহয়তা করা হবে।