শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ০২ অক্টোবর, ২০২১, ০৩:২৩ রাত
আপডেট : ০২ অক্টোবর, ২০২১, ০৩:২৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে পদ্মার: পাড় ভাঙছে, গতি বদলানোর পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে মাছ

বণিক বার্তা: গত ৫০ বছরে পদ্মা নদীর পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ের মধ্যে বারবার গতিপথ বদলেছে নদীটি। সংকুচিত হয়ে পড়ায় মৎস্য আহরণও কমেছে। আঁকাবাঁকা সর্পিল গতি হারিয়ে পরিবর্তনশীল ও নাজুক তটরেখার নদীতে রূপ নিয়েছে পদ্মা। নদীটি এখন অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি, উষ্ণায়ন, পলি পড়ার মাত্রা বৃদ্ধি ও দখল-দূষণসহ নানাবিধ কারণে চিরচেনা চেহারা হারিয়ে ফেলছে।

সম্প্রতি পদ্মার গত ৫০ বছরের আঙ্গিক পরিবর্তনের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যানথ্রোপজেনিক ইন্টারফিয়ারেন্স ফর দ্য মরফোলজিক্যাল চেঞ্জেস অব দ্য পদ্মা রিভার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘স্ট্রেনদেনিং অব হিলশা রিসার্চ ইন রিভারাইন স্টেশন চাঁদপুর’ প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পাঁচ গবেষক যৌথভাবে এটি পরিচালনা করেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘আমেরিকান জার্নাল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’ জার্নালের সর্বশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় নদীর সংকোচনের মাত্রা, বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন, ইলিশ উৎপাদনে প্রভাবসহ নানাবিধ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে এতে নদীর বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনের কারণে পদ্মাকেন্দ্রিক জনবসতির জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের তথ্যও উঠে এসেছে।

গবেষণায় পাওয়া ফলাফল অনুযায়ী, মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কারণ বিশেষ করে নানা উন্নয়ন প্রকল্প এবং দখল-দূষণ নদীটিকে পরিবেশগতভাবে বেশ নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে, যা নদী-তীরবর্তী জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। একই সঙ্গে তা নদী-তীরবর্তী জনসাধারণের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতিরও কারণ হয়ে উঠেছে। স্থানে স্থানে নদী সংকুচিত হয়ে পড়ায় মাছের পরিমাণ ক্রমেই কমছে। বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদন যে হারে বাড়ার কথা ছিল, সে হারে বাড়ছে না।

নদীর পাড় বা তটরেখাও খুব স্থিতিশীল নয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এটি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। গত ৫০ বছরে পদ্মার সামগ্রিক প্রস্থে বিস্তর পরিবর্তন এসেছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতেও দেখা যাচ্ছে এ নদীর চ্যানেল অস্বাভাবিক হারে পরিবর্তিত হয়েছে।

পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি ও পাড়ে ক্ষয়ের তীব্রতা পাওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে পদ্মার আরো বেশি রূপগত পরিবর্তন হতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানিপ্রবাহ এখন বেড়েছে। বর্ষা মৌসুমে তা নদীর চেহারা আরো বদলে দিতে পারে। বিশেষ করে নদীর তীর ও সংশ্লিষ্ট খালগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়বে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পরিবর্তন আরো বেশি প্রকট হবে।

ইতিহাস বলে যে পদ্মা মূলত এঁকেবেঁকে চলা নদী। কিন্তু উচ্চসংবেদনশীল আবহাওয়া এবং নদীর ক্ষয় ও পলি জমার কারণে এটি অনেকটা চুলের বিনুনির আকার ধারণ করেছে, অর্থাৎ অনেক শাখানদী সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে জোয়ারের উচ্চতা থাকে বেশি। একই সঙ্গে উজান থেকে নিচের দিকে পানির প্রবাহও বেশি থাকে। সামনের দিনগুলোয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি, বন্যার পানির তীব্রতা ও উচ্চ তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে উজানের পানিপ্রবাহেও পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে পলি জমা ও পাড় ক্ষয়ের কারণে বন্যার পরিমাণ আরো বাড়তে পারে।

পদ্মার উত্পত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহে। সেখান থেকে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়ে রাজশাহী বিভাগের নবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। উত্পত্তিস্থল থেকে ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে গোয়ালন্দে পদ্মার ধারা এসে মিলেছে যমুনা নদীর সঙ্গে। এরপর এ মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে আরো পূর্বদিকে চাঁদপুর জেলায় গিয়ে মিলিত হয়েছে মেঘনা নদীর সঙ্গে।

নদীটির পরিবেশগত পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখানে অতীতের নানা গবেষণা ও ভূরূপতাত্ত্বিক সমীক্ষার তথ্য-উপাত্তের সহায়তা নিয়েছেন। পাশাপাশি নদীর ভূতাত্ত্বিক গঠন, জলপ্রবাহে পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি এবং বিভিন্ন সময়ের তাপ ও বৃষ্টিপাতের মাত্রার পরিসংখ্যানের সহায়তাও এতে নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার স্যাটেলাইট ইমেজও বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে বাংলাদেশের ২১টি আবহাওয়া অফিস থেকে। আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণে ১৯৬৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

গবেষকদের একজন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, পদ্মা দেশের অন্যতম প্রধান নদী। গবেষণার মাধ্যমে আমরা এ নদীকে ঘিরে মানুষের জীবনযাত্রার একটি নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও খুঁজে দেখতে চেয়েছি। একই সঙ্গে এ নদীর অন্যতম প্রধান মাছ ইলিশের আবাসস্থল ও এ মাছকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার স্বরূপও বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি। এজন্য আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে গত ৫০ বছরের বিভিন্ন তথ্য ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করেছি। গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এ নদীর আচরণগত পরিবর্তনও হয়েছে। আবার নদীভাঙনের ফলে তীরবর্তী মানুষের পেশায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। মাইগ্রেশনও বেড়েছে অনেক। আগে দেখা যেত যারা এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা ভাঙনের ফলে শহরে এসে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। আবার দখল ও দূষণের ফলে নদীর আচরণগত পরিবর্তনও হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে মাছ আহরণের পরিমাণের ওপর। বিশেষ করে এ নদীতে ইলিশ আহরণের পরিমাণ যে হারে বাড়ার কথা ছিল, সে হারে বাড়েনি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

নদীতে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, তাপমাত্রার পরিবর্তন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি ও পলি জমে যাওয়ার কারণে পদ্মায় এখন আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। মাছের বংশ বিস্তারে তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে মাছের ডিম ছাড়ার সময়। এর মধ্যে সামান্যতম তারতম্য হলে তা মাছের বংশ বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। পদ্মা নদীর আয়তন দিন দিন কমছে।

এছাড়া মাছের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মৎস্য শিকারে কারেন্ট জালের ব্যবহার, অতিরিক্ত আহরণকেও চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিষয়টি নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ আহরণের পরিমাণ কমছে। পদ্মা নদীতেও একই কারণে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ কমছে। ক্রমাগত নদীর আয়তন কমছে। আবার নির্বিচারে মাছ শিকার করতে বিভিন্ন ধরনের জালের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে মাছের বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। মানবসৃষ্ট পরিস্থিতির পাশাপাশি প্রাকৃতিক কারণে এ নদীতে মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পদ্মা নদীর রূপগত যে পরিবর্তন হয়েছে, তা চিহ্নিত করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। নদীর রূপগত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইটের তোলা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক তুলনা, স্থল জরিপ, নদীর তলদেশে পলি জমার পরিমাণ, পানির প্রবাহ, পানির নির্গমন ও নদীর পাড় ক্ষয়ের তথ্যও সংগ্রহ ও তুলনা করা হয়েছে।

জলবায়ুর পরিমাপক ও নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ উভয়ই মাছের জীবনাচরণ ও উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় উঠে এসেছে ফলাফলগুলো পদ্মা নদীর সামগ্রিক হাইড্রোডায়নামিক ও রূপগত চরিত্র বিশ্লেষণে কাজে আসবে। ভবিষ্যতের জন্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হাতে নেয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছে এ গবেষণায়।

নদীটি দখল-দূষণ করার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পদ্মা নদীর রাজশাহী এলাকার একটি অংশ ভারতের মুর্শিদাবাদের সঙ্গে নৌরুট তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে ওখানে দখলের সুযোগ নেই। তবে চারঘাট বা ওইসব এলাকায় নদী দখলের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। আমাদের নদ-নদী রক্ষায় নদী রক্ষা কমিশন রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দূষণ বা নদী দখলমুক্ত করতে টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়। দখলদারদের থেকে উদ্ধার করে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ প্রবাহিত রাখতে সরকারের উদ্যোগে সবকিছুই করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়