শিরোনাম
◈ ঝালকাঠিতে ট্রাকচাপায় নিহতদের ৬ জন একই পরিবারের ◈ গাজীপুরের টঙ্গি বাজারে আলুর গুদামে আগুন ◈ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনোয়ারুল হক মারা গেছেন ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শনিবার ঢাকা আসছেন ◈ দুই এক পশলা বৃষ্টি হলেও তাপদাহ আরো তীব্র হতে পারে  ◈ এথেন্স সম্মেলন: দায়িত্বশীল ও টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত প্রয়াসের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ◈ কেএনএফ চাইলে আবারও আলোচনায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে: র‌্যাবের ডিজি ◈ ওবায়দুল কাদেরের হৃদয় দুর্বল, তাই বেশি অবান্তর কথা বলেন: রিজভী ◈ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী ◈ বাংলাদেশ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে: অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৭:৫৭ বিকাল
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৮:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর অতিরিক্ত ছয় লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে

এম মাছুম বিল্লাহ: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বিভিন্ন দেশে ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলাদেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এ তিনটি বৃহৎ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এবং এর ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবণভূমি। নদীপ্রধান দেশ হওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হিমালয়ের বরফ গলা ও বৃষ্টিপাতের সময়সীমায় তারতম্য এবং নদী ভরাট হওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাল-বিল, জলাভূমি ও নদী দখলসহ নানা কারণে নদী ভরাট হওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের চরম আবহাওয়াজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশ উপকূল বরাবর সমুদ্রের স্তর বছরে প্রায় তিন মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মাটিতে লবণাক্ততা ২ শতাংশ বেড়েছে (মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ২০১০)।

এ লবণাক্ততার কারণে চাল উৎপাদন ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ এবং গম ৩২ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। আইপিসিসির পঞ্চম প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় বাংলাদেশে প্রায় ২.৭ কোটি লোক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ক্লাইমেট ভালনারেবল মনিটর অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রতি বছর অতিরিক্ত ছয় লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ১২৫ কোটি ডলারের অতিরিক্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের জীবিকা নির্বাহের প্রায় ৮৮ শতাংশ কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল এবং জিডিপিতে অবদান প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষি মৌসুমি অবস্থার যেকোনো পরিবর্তনের সাথে সংবেদনশীল, এমনকি তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, মৌসুমের সময় ও সময়কাল, বারবার বন্যাসহ মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির সাথে কৃষির উৎপাদন সরাসরি জড়িত। ২০২০ সালে প্রাক্কলিত দেশের মোট শ্রম খাতের প্রায় ৩৭.৭৫% কৃষিতে জড়িত।

উচ্চতাপমাত্রা ও অধিক বৃষ্টিপাত কোনো কোনো ক্ষেত্রে শস্য উৎপাদনভিত্তিক আয় বাড়াতে অবদান রাখলেও (হোসেন এবং অন্যান্য, ২০১৯) অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতিবাচক সে অবদানকে নেতিবাচক অবস্থানে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে। আশঙ্কার বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষকরা প্রায় ৫৫% প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। কৃষিকাজের জন্য জমির পরিমাণ কমে গিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় ৩০% কমে যেতে পারে। এমনকি মানবসম্পদের জোগান ১৫% হ্রাস এবং কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রায় ২৫% বেড়ে যেতে পারে। ফলে সার্বিক উৎপাদনশীলতা কমে আয় হ্রাস পাওয়ায় আর্থিক সম্পদে গ্রামীণ মানুষের অভিগম্যতা প্রায় ৪৬% কমে যেতে পারে।

মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সম্ভাব্য পানির উৎসকে শুকিয়ে ফেলতে পারে, যা কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সেচের জোগান কমিয়ে দিলে গ্রামীণ জীবন ও জীবিকার জন্য কৃষির অবদান কমে যেতে পারে। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ২১০০ সালের মধ্যে মৌসুমভিত্তিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫-১২ শতাংশ কমে গেলেও মৌসুমভিত্তিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৭% বেড়ে গিয়ে গ্রামীণ মানুষের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে (সাদাও ও ইসলাম, ২০১১)। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৫-২০১৪ সময়ে বর্ষা মৌসুম শুরুর সময় এবং শুরুর আগে যে বৃষ্টিপাত হতো তার পরিমাণ কমে গেলেও বর্ষা মৌসুম, বিলম্বিত বর্ষা এবং বর্ষা মৌসুমের শেষদিকে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে।

এমনকি শীত মৌসুমে বর্ষার মতো বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই যে বৃষ্টিপাতের সময় এবং পরিমাণের যে পরিবর্তন হচ্ছে তা অনায়াসে বলা যায়। এমনিতেই উজানে ভারত কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে গেছে। তারপর সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার উচ্চতর ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে খাদ্যশস্যের অন্যতম ভাণ্ডার উত্তরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদনকে চরম ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদান না করলে সামনের দিনগুলোতে সেচের পানির অভাবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি শুধু শস্য উৎপাদন নয়, অর্থকরী ফসল সবজি ও মৎস্য চাষও হুমকির মুখে পড়বে। উল্লেখ্য, সার্বিকভাবে সেচের পানির প্রকট সংকটের চেয়ে নিয়মিত সেচের প্রয়োজন বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর উত্তরাঞ্চলে সেচের সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্থানীয় গ্রামীণ জনপদ বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকরা সক্ষমতা হারাবে। ফলে কৃষির বর্তমান অবস্থা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এ দুই ঝুঁকি মিলে সার্বিকভাবে কমিউনিটির সম্পদ ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।

কৃষির দিক থেকে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল অত্যন্ত উৎপাদনশীল। অন্যান্য এলাকার তুলনায় উপকূলীয় এলাকা অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকির উচ্চমাত্রা এবং স্থানীয় দরিদ্র সম্প্রদায়ের ওপর এ ঝুঁকির আশঙ্কাজনক প্রভাবের কারণে অঞ্চলটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উপকূলীয় বন্যা প্রতি বছর বিভিন্ন উচ্চতা ও তীব্রতার সাথে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। উপকূলীয় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে বৈশ্বিক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের এক বৃহত্তর হটস্পটে পরিণত করেছে। গত এক দশকে অবিরাম বৃষ্টিপাতের ধরন এবং ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণিঝড় ও তাপপ্রবাহ অনুভূত হয়েছে। ২০০০-১০-এর মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলটি দুটি মেগা ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। এতে প্রচুর অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত, কৃষিকাজ ও মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। উপকূলীয় বাংলাদেশে এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান লক্ষ করা গেছে। উপকূলের ৯৭.৯১ শতাংশ অঞ্চলের সাড়ে তিন কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঝুঁকিতে রয়েছে যেমন—গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ের তীব্রতা, উপকূলীয় বন্যা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ সম্পৃক্ত।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের প্রভাবে পদ্মা নদীতীরবর্তী গ্রামে বসবাসরত মানুষের জীবনের ঝুঁকি বাড়বে। উল্লেখ্য, পদ্মা নদী সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে এক মিটার নিচে অবস্থিত এবং পদ্মার তীরে বাসরত মানুষের প্রায় ৯০% মানুষ তাদের জীবিকার জন্য মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভর করে। অবহেলিত মৎস্যজীবী পরিবারগুলো এমনিতেই চিকিৎসাসেবা ও সুপেয় পানির সংকটে ভোগে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সাথে মৌলিক চাহিদার সংকট মিলিয়ে মৎস্যজীবীদের জীবন সামনে আরো ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মৎস্য আহরণে জড়িত জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে আধুনিক মৎস্য আহরণ যার মাধ্যমে সমুদ্রেই মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে রফতানি নিশ্চিতে দীর্ঘমেয়াদে সুদমুক্ত ঋণ, কারিগরি সহায়তা প্রদান, জীবন বীমাসহ সব ধরনের প্রণোদনা প্রদান করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণায় বলা হয়, কেবল ০.৩ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশে ধান উৎপাদন ০.৫ মিলিয়ন টন হ্রাস পেতে পারে। এটি বিশ্বের বৃহৎ চালের ভোক্তাদের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় দেশে ব্যাপক স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহানি ঘটতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবারের খাদ্য সুরক্ষার চারটি মাত্রার ওপর মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে, যেগুলো হলো খাদ্যের সহজলভ্যতা, খাদ্য সংগ্রহ, ভোগ ও খাদ্যনিরাপত্তা। বন্যা, খরা ও বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের খাদ্য, পুষ্টি ও জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তদুপরি খাবারের মানও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদিত ফসলের ফলন হ্রাসের কারণে খাদ্য ঘাটতির দেশগুলোতে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাবে (হার্টেল, বার্ক ও লোবেল, ২০১০)। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মূলত নারী ও শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে (নাসরিন, ২০০৮; কৌশল ও পরিকল্পনা, ২০০৯)। এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রামীণ পরিবারের নারী ও শিশুরা।

জলবায়ু পরিবর্তন শুধু কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব নয়, চিকিৎসাবঞ্চিত গ্রামীণ জনপদে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মাত্রা এবং সময়ের পরিবর্তনে বিভিন্ন ভেক্টরবর্ন রোগ যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কালাজ্বর, কলেরা ও ডায়রিয়া রোগের বিস্তার ঘটে (হাশিজুম, ২০০৭)। অনুমান করা হচ্ছে যে নিকটবর্তী সময়ে (২০১৩-২০৩৫) যদি তাপমাত্রা ০.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়ে তবে বাংলাদেশে ডায়রিয়ার প্রায় আট লাখ অতিরিক্ত কেস দেখা দেবে (ফিলিপসোর্ন, আহমেদ, ব্রোসি ও লেভি, ২০১ ২০১৬)। তাপমাত্রা বৃদ্ধি টাইফয়েড বাড়ায়, খরার সময় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস নলকূপের পানির ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোকে অন্যান্য উৎস থেকে পানীয় পানির সন্ধান করতে বাধ্য করতে পারে, যা দূষিত হওয়ার ফলে ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহ মৃত্যু এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে এবং শিশুরা বেশি শিকার, চরম তাপ ও ঠাণ্ডার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের উষ্ণতম পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে উদ্বেগের কারণ গরম এবং শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির প্রধান কারণও জ্বর। বাংলাদেশে ভারি বৃষ্টিপাত এবং বন্যার ঘটনা, যা পানীয় জলের দূষণের কারণ হতে পারে, কলেরা, টাইফয়েডের পাশাপাশি ডায়রিয়াজনিত রোগজনিত সংক্রমণের সাথে যুক্ত হয়েছে ই-কোলি (ইউনুস, অন্যান্য, ২০১৬)। বাংলাদেশে কলেরার প্রকৃৃতি ও ঐতিহ্যগত পরিবর্তনশীলতা তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সাথে জড়িত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা ম্যালেরিয়াজনিত সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশি এবং গর্ভাবস্থা অ্যাসিম্পটমেটিক পি ফ্যালসিপারাম সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ কারণ (খান এট আল, ২০১৪)।

বাংলাদেশ খুব বেশি পানি ও খুব সামান্য পানি উভয়ই গ্রামীণ জনপদের জন্য নেতিবাচক পরিণতি নিয়ে আসে। জলবায়ু পরিবর্তন বিদ্যমান পানির সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলছে, পরিবর্তিত বৃষ্টির মাত্রা, তাপমাত্রা ও বাষ্পীভবন বৃদ্ধি এবং বন্যা বৃদ্ধি প্রধান কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি সরবরাহে লবণাক্ততা আরো বেড়েছে। পানি ও পয়োনিষ্কাশনের অবকাঠামোতে বিপর্যয় ঘটছে দীর্ঘমেয়াদি বন্যায়, চরম আবহাওয়ার ঝুঁকির কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, জলোচ্ছ্বাস এবং নদীভাঙন ক্ষতিকারক এবং স্কুল, স্বাস্থ্যসহ গ্রামীণ নারী ও শিশুদের সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস বিশেষ করে ল্যাট্রিন, ঘর ও রাস্তা ভেঙে যাওয়া অন্যতম।

বন্যা, ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা ও খরা ফসল এবং গাছ ধ্বংস করছে, ব্যাহত করছে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং নিরাপদ পানির উৎস হ্রাস করছে, দূষিত করছে পানি এবং পুষ্টিকর খাবার। গ্রামীণ অবকাঠামো প্রায়ই বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় সুরক্ষার অভাবে শিক্ষা সরঞ্জাম বানের পানিতে নষ্ট হয়ে শিশুদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে। উপকূলসহ উত্তরাঞ্চলের বিদ্যালয়ের ভবনগুলো আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর জন্য ব্যবহার হয়, অনেক জায়গায় মাসের পর মাস পড়াশোনা ব্যাহত হয়।

কোনো শিশু বেশ কিছুদিন বিদ্যালয়ের বাইরে থাকলে তাদের শিক্ষাজীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যায়, বাংলাদেশে এটা প্রায়ই ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে ক্রমেই আয় কমে যাওয়ায় কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকা সংকটে পড়ায় স্কুলে শিশুদের রাখতে পারিবারিক ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দুর্যোগের ঘটনা ও গ্রামীণ জীবিকা নির্বাহের ফলে শিশুশ্রমের ঝুঁকি এবং মেয়েদের বাল্যবিবাহ বাড়তে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এখন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার পক্ষে অত্যাবশ্যক, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের আজকের শিশুদের মানিয়ে নেয়ার জন্য দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন হবে।

যদিও জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো দরিদ্র ও সর্বাধিক দুর্বলদের ওপর ব্যাপকভাবে পড়বে তা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ নয়, নারীরাই প্রাকৃতির দুর্যোগ ও তার পরবর্তী প্রভাবগুলোর বেশি শিকার হয়। নারীদের চলাফেরার ওপর সীমাবদ্ধতা, ঝুঁকি সম্পর্কিত ও ঝুঁকি হ্রাস করার উপায় সম্পর্কে তথ্য জানার সুযোগ কম এবং দুর্যোগের সময় স্থানান্তরে অগ্রাধিকার প্রদান না করায় অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুহারে লিঙ্গগত পার্থক্যের কারণ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্যের ও সুস্বাস্থ্যের ওপর অপ্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গোপনীয়তার অভাব থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাল্যবিবাহকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনে অনেক পরিবার বিচ্ছিন্নতার ক্রমাগত ঝুকি ও ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, যা মেয়েদের স্কুল পড়াশোনা ও বিয়েসংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।

সেন্টার ফর রিসার্চ অন দি এপিডেমিওলজি অব ডিজাস্টারসের (সিআরইডি) তথ্যমতে, ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৫৫টি বন্যা ও ৭২টি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সময়ের তুলনায় এ সময়ে অনেক বেশি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা আইপিসিসির পঞ্চম গবেষণা প্রতিবেদনেও বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। যত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসজনিত দুর্যোগের মাত্রা বাড়বে তত বেশি সমুদ্রে জেলেদের জীবন ও উপার্জনের ঝুঁকি বাড়বে।

গত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হলেও আইপিসিসির পঞ্চম অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৮-২০০৯ সময়ে শুধু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে জিডিপির ৫.৯% ক্ষতি হয়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০৯-১৫ সময়ে বন্যায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ হাজার ৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং এ ক্ষতি না হলে বাংলাদেশ প্রতি বছর অতিরিক্ত ০.৩০% জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত। শুধু তা-ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে আগামী দুই দশকে উপকূলের প্রায় এক কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়তে পারে।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার পর পরই বন্যা আঘাত হানে, ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়েও যমুনা নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহের লেভেলের চেয়ে ১৭ সেন্টিমিটাির বেশি উঁচুতে প্রবাহিত হওয়ায় কোনো কোনো জায়গায় দুই মাসের বেশি স্থায়ী বন্যায় গ্রামের প্রায় ১০ লাখ পরিবার পানিতে আবদ্ধ হয়েছিল এবং ২৫৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের (এনডিআরসিসি) তথ্যমতে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার সরাসরি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন এবং লক্ষাধিক নলকূপ এবং এক লাখের বেশি টয়লেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই লাখের বেশি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়, মাত্র এক লাখের মতো মানুষ ১ হাজার ৫২৫টা আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে (রিলিফওয়েবের ওয়েবসাইট, ২০২০)। গ্রামের অর্থনীতির প্রধান চাকা কৃষি এবং এ বন্যায় প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর ধানক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে যায়। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের বন্যায়ও ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫২৬টি পরিবারের ৪০ লাখ মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া ছাড়াও সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের জমির পরিমাণ যথাক্রমে ৪৫ হাজার ৯৬৬ হেক্টর ও ৯৪ হাজার ১৮৩ হেক্টর।

এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ ২০১৫-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯-১৪ সময়ে ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডোতে বাংলাদেশের মোট খানার ২৫.৫১% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (বিবিএস, ২০১৫)। বাংলাদেশে বিগত ২৫ বছরে ঘূর্ণিঝড় সংঘটনের হারের ক্রমবৃদ্ধি লক্ষণীয়। ১৬ বছরে (১৯৯১-২০০৬) মাত্র ছযটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও গত এক দশকে (২০০৭-২০২০) সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, রোয়ান, বুলবুল, আম্পান সহ ১৩টি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়।

ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে এ ঘূর্ণিঝড়গুলোর আঘাত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তবতারই প্রতিফলন। দুর্যোগ সক্ষমতা বাড়লেও সনাতনী ব্রিটিশ সময়ে দুর্যোগের সময়ে নৌযানকে সতর্কবার্তা প্রদানের সংকেতকে সর্বজনীনভাবে ব্যবহারের ফলে নৌযানচালকরা সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে প্রায়ই জেলেরা জীবন হারায়। তবে ঘূর্ণিঝড়ের আগে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোর বিষয়ে আগাম সমীক্ষা ও যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি মানুষের বোধগম্য সতর্কবার্তা প্রণয়ন ও প্রচার, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের জন্য প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কমিউনিটিকে সরাসরি যুক্ত করা, ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে উপার্জনের সুযোগ না থাকায় উপকূলীয় এলাকা থেকে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ঝুঁকিও বাড়ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়