অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
১৯৮১ সালের ১৭ মে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিদেশে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় রূপান্তরিত পূর্ব পাকিস্তানকে আবার বাংলাদেশের ধারায় ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। বাঙালির বুকে আশার সঞ্চার হয় বাংলাদেশকে আবার ফিরে পাওয়ার। এর মধ্যেই সহস্রাধিক সেনা সদস্যকে সামরিক বিচারিক প্রহসনের মাধ্যমে হত্যাকারী জিয়াউর রহমান একদল সেনা সদস্য কর্তৃক চট্টগ্রামে নিহত হন। কয়েকদিন ধানাই-পানাই করে বিচারপতি ছাত্তারকে তাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করেন অপর স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। শুধু পীর বদল হয়Ñ ‘শর্ষিনা থেকে আটরশি’, বাকি সবই আগের মত। ‘সাফারি- সানগ্লাস -খাল কাটার’ জায়গায় চলে এলো ‘মেরি (লেডি)-হেলিকপ্টার-গতরাতে স্বপ্ন দেখা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায়’। এরশাদ একধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে চিরতরে বিতাড়িত করার জন্য রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামকে সামনে নিয়ে আসলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচন। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে গণতন্ত্র মুক্তি পেলো না। সামরিক শাসক জিয়া এরশাদের মতোই গণতন্ত্র অবরুদ্ধ থাকলো ক্যান্টনমেন্টে। শহীদ নূর হোসেনের বুকে লেখা গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পেল না। গণতন্ত্র থেকে গেলো সেনানিবাসই। সেনানিবাসে থেকে গেলেন আমাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। রয়ে গেলো পাকিস্তানি ভাবধারা। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ৮ জানুয়ারি ১৯৯৩, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আফিস নওয়াজ জানজুয়া আকস্মিক মৃত্যুতে নজিরবিহীন শোক বাণী পাঠান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জানজুয়া ১৯৭১ সালে হানাদার হিসেবে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা করে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হলেও গণতন্ত্র মুক্তি পেল না। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে এদেশের মানুষ দীর্ঘ দেড় দশক পর গণতন্ত্রের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও কুশীলবদের সূক্ষ্ম কারচুপির কারণে গণতন্ত্র ক্যান্টনমেন্টেই থেকে গেলো। সেনানিবাস থেকেই গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশ শাসন করতে লাগলেন। সামরিক গোয়েন্দাদের খবরদারি থেকে গেলো সরকার ব্যবস্থায়। পরবর্তী সময়ে আরো দুটি নির্বাচনে ১৯৯৬ এ আওয়ামী লীগ ও পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও বিরোধীদলের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সেনানিবাসে থেকে গেলেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যভিত্তিক মানবিক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। আর সেটার নেতৃত্বে অবশ্যই দিচ্ছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। যে দেশটি অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছিল, জঙ্গিবাদী ব্যর্থ রাষ্ট্রের ধারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই আজকে বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। ১৯৭২-৭৩ থেকে শুরু করে ২০০৬-৭ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর সময় লেগেছিল মাথাপিছু আয় ৫৩২ ডলারে আসতে। ২০০৭-৮ থেকে ২০১৯-২০ এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২০৬৪ ডোলারে। ১১ বছরে প্রায় চারগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২২২৭ ডলার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা কীভাবে একটা জাতিকে উন্নয়নের পথ দেখায় তা বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে গেলেন। নেত্রীর অগ্রগামী দল হিসাবে আমরা যারা যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলাম আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিকেলে সবাই যখন চা খাচ্ছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ করেই বলে বসলেন, ‘ভারতের দার্জিলিংয়ে যদি চা চাষ হতে পারে, তাহলে পঞ্চগড়ে কেন হবে না’। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রবিউল হোসেন। সম্ভাবনা যাচাই করতে তিনি মৌলভীবাজার থেকে চারা সংগ্রহ করে টবে লাগালেন। ২৫ বছর পর এখন পঞ্চগড়ে প্রায় ৩০০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ২০১৭ সালে উৎপাদন ছিল ৫৫ লাখ কেজি । বছরে তিন কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব।
শেখ হাসিনার মনোবল কতো দৃঢ় এবং সিদ্ধান্তে কতোটা অবিচল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। দেশি-বিদেশি সকল চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি ছিলেন আপোসহীন। এছাড়াও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মুখের উপর গ্যাস রপ্তানির সুযোগ নাকচ করে দিয়েও তার অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যখন অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ালো তখন কাল বিলম্ব না করে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত নিলেন পদ্মা সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে এবং হয়েছেও তাই। পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না’। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তির স্থাপত্য রূপ হচ্ছে পদ্মা সেতু । ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ তোলে ‘সিউল থেকে বুসান’ হাইওয়ে নির্মাণে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্ব ব্যাংক। তখন দক্ষিণ কোরিয়া মহাসড়কটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করে দেখিয়ে দেয়, ‘আমরাও পারি’। এরপর থেকে বিশ্বব্যাংকের নির্ভরতা কমিয়ে আনে। ১৯৯৬ সালের পরে দক্ষিণ কোরিয়া আর বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সততা এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকার কারণে বিশ্ব দরবারে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হয়েছেন। সম্প্রতি ইউরোপের একটি গবেষণা সংস্থা ‘পিপলস এন্ড পলিটিক্স’ বিশ্বের ৫ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিহ্নিত করেছেন যাদের কোনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। এদের বিদেশে কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই, উল্লেখ করার মত সম্পদও নেই। ১৭৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে স্কোর করা হয়। এই তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, তাঁর স্কোর ৯০ । দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং , স্কোর ৮৮ । বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮৭ স্কোর পেয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলবার্গ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন, তাঁদের স্কোর ছিল যথাক্রমে ৮৫ এবং ৮১। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয় দেশের ৭৮ শতাংশ
মানুষ মনে করে শেখ হাসিনা দুর্নীতিমুক্ত এবং লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। ছোটখাটো দুর্নীতিও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। এর বিপরীতে দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানের সাময়িক বিরতিসহ জেল খাটছেন। অনেকে বলেন সামান্য আড়াই কোটি টাকার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছর জেল হওয়া খুবই অমানবিক। এটা নাকি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী । অনেকটা এমন, বড় রাজনীতিবিদদের বড় দুর্নীতি বিচার করা যাবে, হাজার কোটি টাকা চুরি না করলে এর বিচার করা যাবে না। বড় রাজনীতিবিদদের যখন দুর্নীতির দায়ে ধরা হয় সারা পৃথিবীতেই এসকল নেতারা নাকি কান্নাকাটি করেন এবং অন্যরাও দুর্নীতি করেছে অজুহাত দেখিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালান। এর অর্থ এই যে, কোন অসৎ রাজনীতিবিদকে সাজা দেয়া যাবে না, যদি না প্রথমে অন্য সব অসৎ রাজনীতিকদের সাজা দেয়া না হয়।
দেশের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত কেউ কি পরিমাণ দুর্নীতি করলে তাকে দুর্নীতিবাজ বলা যাবে এ ব্যাপারে ফ্রান্সিস বেকনের একটি উদাহরণ দিয়ে আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানবো। ফ্রান্সিস বেকন(১৫৬১-১৬২৬), ইংরেজ রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক। রানী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ১৬০৩ সালে রাজা প্রথম জেমসের উপদেষ্টা নিয়োজিত হন , ১৬০৭ সালে সলিসিটর জেনারেল, ১৬১৪ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ১৬১৮ সালে লর্ড চ্যান্সেলর (চিফ জাস্টিস সমমর্যাদার) নিযুক্ত হন। বিচারকের আসনে বসে তিনি মামলাকারীদের কাছ থেকে উপঢৌকন গ্রহণ করেন, যদিও
সেকালে এটা স্বাভাবিক ছিল, তবুও এটি অবৈধ। এই অপরাধের দায়ে বেকন ক্ষমতাচ্যুত হন, টাওয়ার অফ লন্ডনে তাঁকে বন্দী করা হয়, বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়, সারা জীবনের জন্য সরকারি পদে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরে অবশ্য রাজা ক্ষমা করে দেন। যদিও জনগণের বিশ্বাস হত্যা এবং ঘুষ গ্রহণের কারণে সাজাপ্রাপ্ত উচ্চমানের রাজনীতিবিদদের দৃষ্টান্ত সে আমলেও খুবই কম ছিল। সাজা ঘোষণার পর বেকনের মন্তব্য ছিল একটু অন্যরকম। ‘ইংল্যান্ডের ৫০ বছরের মধ্যে আমি ছিলাম ন্যায়পরায়ণতম বিচারক, কিন্তু আইনসভার ২০০ বছরের মধ্যে এটাই ছিল ন্যায্যতম তিরস্কার’।
এতিমের জন্য বিদেশ থেকে আনা টাকা আত্মসাতের চেষ্টায় বেগম খালেদা জিয়ার মাত্র ১০ বছর জেল হয়েছে। এর কম আর কি সাজা হতে পারত? পবিত্র কোরআনে আছে, ‘যারা এতিমের অর্থ-সম্পদ অন্যায় ভাবে ভোগ করে তাঁরা যেন আগুন খেলো এবং তাঁরা অতিসত্বর অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ ( সূরা- আল নিসা, আয়াত ১০)। ঈষৎ সংক্ষেপিত।
লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :