এম মাছুম বিল্লাহ : [২] বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ইতোমধ্যেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি কাজে। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগামীতে শতকরা ৩০ শতাংশ কমে যাছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধান ও গমের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে।
[৩] বাংলাদেশের কৃষিবিদরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুণাগুণ ও উৎপাদনের পরিমাণে পরিবর্তন আসছে। বর্তমান চাষ এলাকায় উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পানির স্বল্পতা ঘটছে, হ্রাস পাচ্ছে মাটির উর্বরতা। নতুন নতুন বালাই দেখা দিচ্ছে। ফলে কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বাড়াছে। সেচের ব্যাপকতা, ভূমিক্ষয়, মৎস্য বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, রাসয়ানিকের ব্যবহার পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
[৪] বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুলাংশে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জোগান দিয়ে থাকে কৃষি।
[৫] বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের অবদানের প্রায় ৫৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কৃষি পেশায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি বৈরী জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈরী জলবায়ুর সৃষ্টি হচ্ছে।
[৬] তাপমাত্রা বৃদ্ধি জলবায়ুর ও আবহাওয়ার স্বাভাবিক অবস্থাকে অস্বাভাবিক ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষির ওপর। কেননা কোনো একটি নির্দিষ্ট শস্যের বেড়ে ওঠার জন্য একটি পরিমিত মানের জলবায়ুর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি উপাদানগুলোর প্রয়োজন হয়।
[৭] বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২১০০ সন নাগাদ সাগর পৃষ্ঠ সর্বোচ্চ ১ মিটার উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হতে পারে। এ পূর্বাভাস সত্যে পরিণত হলে বাংলাদেশকে উক্ত এলাকার কৃষিসহ সব কিছুই হারাতে হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে।
[৮] বাংলাদেশের কৃষিবিদরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি নিদর্শন বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়া। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে তেমন বৃষ্টি হয় নাভ। আশ্বিন মাসে ৪-৫ দিন এমন পরিমাণে বৃষ্টিপাতে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। খরাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে নিম্নমুখী হয়ে সেচকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এর ফলে বিভিন্ন কৃষির উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
[৯] অন্যদিকে, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত বিঘ্নিত হওয়ায় ঘন ঘন বন্যা ও খরার সম্মুখীন হতে হচ্ছে দেশকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন বাংলাদেশের কৃষির জন্য অবধারিত নিয়তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩-১৯৮৭ সন পর্যন্ত ২১ দশমিক ৮ লাখ মেট্রিক টন শুধু ধান নষ্ট হয়েছে খরায়। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা প্রভৃতি দেশের কৃষির ধরনকে বদলিয়ে দিয়েছে। এক সময় এ দেশে কয়েক হাজার প্রজাতির ধান চাষ হতো। বর্তমানে তা গেছে অনেক কমে।
[১০] বন্যার কারণে আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষক সেচ ও খরচনির্ভর বোরো ধানের দিকে ঝুঁকেছে। অপর দিকে ধানের দিকে কৃষক বেশি ঝুঁকে পড়ায় ডাল চাষের জমি হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডালশস্যের আবাদ তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়াও পাট, গম ও আখের চাষ উৎপাদন উভয়ই লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে যে ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, তা সত্যিই দুঃখের, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আপনার মতামত লিখুন :