জারিন তাসনিম: ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণের ভেতরই আমার ক্ষুধা লাগে। যেনতেন ক্ষুধা না। রাক্ষুসে ক্ষুধা। রাতে যদি একটা হাতি খেয়েও ঘুমাই, পরদিন সকালবেলা ঠিক ততোটাই ক্ষুধা লাগবে যতোটা রাতে না খেয়ে ঘুমানোর পর সকালেবেলা লাগে। প্ল্যাংক কিংবা বোল্টজম্যানের কন্সট্যান্টের মতো এই ক্ষুধাও কনস্ট্যান্ট। মাঝেমাঝে ক্ষুধার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না। তখন স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় কুঁকড়ে থাকা ছাড়া আমার কিছু করার থাকে না। আমাদের বাসার সবকিছু চলে সেল্ফ সার্ভিসে। মা-বাবা থাকলে এসব খাতির যত্নের ভার তাদের ওপর ছাড়া যেতো।
আনফরচুনেটলি, তারা ...রাতে ঢাকা টু বরিশালের এক লঞ্চ ডুবিতে ভোরবেলা মারা গেছেন। শুরুর দিকে একটু কষ্ট পেয়েছি, পরে অবশ্য এ আমাকে তেমন আর ভাবায়নি। এমনিতেও মানুষ হিসেবে আমি একটু রুঢ় ধরনের। যেখানে যে ইমোশন আসা দরকার, সেটা আমার ক্ষেত্রে আসে না। শুধু ক্ষুধার কাছেই কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে যাই। পরাজিত হই। তবে আজ সকাল থেকে একটা জিনিস অস্বাভাবিক ঠেকছে। ঘুম থেকে উঠার পর অনেকক্ষণ কেটে গেছে। দুই ঘণ্টা, চার ঘণ্টা,পাঁচ ঘণ্টা...এখনো ক্ষুধা লাগেনি। আমার কাছে জিনিসটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগলো। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সারারাত কেটে গেলো। এরপর একটি দিন, আরেকটি দিন, আরও একটি দিন...ক্ষুধা লাগছে না। এমনকি পানি তৃষ্ণাও লাগছে না। অদ্ভুত ব্যাপার! শরীর ঝিমঝিম করছে না, মাথা ঘুরাচ্ছে না, শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে না, প্রস্রাবের রাস্তা, মানে ইউরেথ্রা জ্বলছে না- সবকিছু বেশ স্বাভাবিক। নিজেকে পরিমিত মানুষ মনে হচ্ছে।
আস্তে আস্তে আমি সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেললাম। এমনি করে বেশকিছুদিন বহুদিন কেটে গেলো। আবারও বলছি, বহুদিন বলতে কতোদিন, সেটা জানতে চাইলে আমি দুঃখিত। আমার কাছে সত্যিই কোনো হিসেব নেই। সারা দিন-রাত বিছানায় শুয়ে থাকি। নরম তুলতুলে বিছানা। কখনো মনে হয় ভেজা মাটি, কখনো মনে হয় মেঘ, কখনো মনে হয় ঘাস। আবার কখনো মনে হয় স্থির পানিতে নৌকায় ভেসে যাচ্ছি। জীবনের একমাত্র দুর্বলতা ক্ষুধাকে আমি জয় করে ফেলেছি। খাবার কিংবা পানির স্বাদ আমি ভুলে গেছি। শুরুর দিকে একটু-আধটু ইচ্ছে হতো। এখন তাও হয় না। দিব্যি ভালো আছি। একদিন হঠাৎ আমার ঘোর ভাঙে। এটা আসলে ঠিক ঘোর না। শূন্যতা না। কষ্ট না। সুখ না। এটা কোনো ইন্দ্রিয়প্রাপ্ত ফিলিংস না। আমার শুধু মনে হলো, এক ডাইনমেনশন থেকে অন্য ডাইমেনশনে এলাম। পৃথিবী এখানে অন্যরকম। একটু আগে আমি অন্য কোথাও ছিলাম। খুব দ্রুত কিছু একটা পরিবর্তন হয়ে গেলো। আমি টের পাই আমি শুয়ে আছি মাটির ওপর। ওপরে, নিচে, ডানে,বামে কেবল মাটি। আমার মনে পড়ে সেদিন লঞ্চে আমিও ছিলাম মা-বাবার সঙ্গে। বারবার হাতঘড়ি দেখছিলাম পৌঁছাতে আর কতোক্ষণ। সেদিন ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছিলো আমার...।ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :