মন্টু ডানিয়েল: গ্রাম বাংলার বটবৃক্ষের শিশু কালের দৃশ্য নিশ্চয় বিস্মৃত হয়নি। সচরাচর খড়ের ঘরের চালে, পুকুর ঘাটের চিপায়, স্তুপীকৃত ইটের ফাঁকে, খেজুর গাছের কোমড়ে, তাল গাছের মাথায় প্রভৃতি সব অভাবনীয় জায়গায় বটের চারা জন্মায়। ৮/১০ বৎসর পরে তার আশ্রয় দাতা খেজুর গাছ, তাল গাছ আর চোখে পড়ে না, বটবৃক্ষ গ্রাস করে ফেলে। এরপর ২/৩ যুগেই স্বমূর্তি-ধারণ করে প্রকাণ্ড বটবৃক্ষে পরিণত হয়।
আমাদের আবহমান কালের সংস্কৃতির হয়েছে সেই-দশা-- খেজুর গাছের মতো ধর্মীয় জোশের কৃষ্টি চর্চার ঘোরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাজার বংসরের সংস্কৃতি, গৌরব-গাঁথার ঐতিহ্য।
অখন্ড ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রকৃতির আর্শিবাদিত আধ্যাত্মিকতা, বাউল বৈশিষ্ট, একতারার মোহ-মায়া, কাম-নিষ্কামের কবিয়াল গীতি-পালা, বৈঠকি-বিচ্ছেদী গান, নাটক-যাত্রা, কিৎচ্ছা-পরস্তা-শাস্তর, হাট-বাজারে সুর ধরে গাওয়া কবিতা; আকাশ, পাতাল, সাগর, পাহাড়, বন বনানী, দানব রাক্ষস-খোক্কসের গল্প, ঝড়-ঝঞ্চা-প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বেমার-মহামারীসহ দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব বিষয়কে জড়িয়ে-মিশিয়ে-মাখিয়ে আছে আমাদের যে প্রাণের সংস্কৃতি, যার দুর্দমনীয় শক্তির ক্রমধারায় লীন হয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব, জাতীয় সঙ্গীত-পতাকা- মানচিত্র- স্বাধীনতা তা আজ ধর্মীয় কৃষ্টির আগ্রাসনে রীতিমতো বিলীন হবার পথে।
দুর্ভাগা সংস্কৃতির কপালে এমন পরিহাস নেমে এসেছে যে, গা-ন= গান গাওয়া হারাম-- কোমলমতি শিশুদের পাঠ্য পুস্তকেও জুড়ে দেয়া হয়েছে। ডাং-টঙ্গী, কাবাডি, ছি কুৎকুৎ, হাঁড়ি ভাঙ্গা, বদন, কানামাছি, গোল্লাছুটের মতো প্রাণের উচ্ছাসভরা খেলাগুলো হারিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই । ফতোয়ার গোঁড়াবচনের আক্রমণে কবে যে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলাও বেহেস্তে যাবে তার কথাই বা কে জানে!
ধর্মের প্রাণশক্তি আধ্যাত্মিকতা আমাদের অজান্তেই যেন উবে গেছে ধর্মের তনাই থেকে। কাচি বাছুরের লেজে কলার শুকনো পাতা বেঁধে দিলে যেমন শুধু দৌঁড়ের ওপর থাকে, তেমনি হয়েছে আমাদের অবস্থা। স্বর্গের লোভকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দিয়ে এমন অবস্থায় সমাজকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, শাস্ত্র পাঠ, মঙ্গল পুস্তক পাঠ, গবেষণা, আরাধনা, কল্যাণ কর্মে নিপ্ত থাকা, সর্বাবস্থায় আত্মাকে শুদ্ধ-শুচি রাখা, নীতি-আদর্শ-মানবিকতাকে রক্ষা করা,,ক্ষমা করা, পরস্পরকে আত্মবোধ প্রীতি করা প্রভৃতির চেয়ে আবশ্যকীয় হিসাবে দেখানো হচ্ছে নামাজ-রোজা, গির্জা-বন্দনা, পূজা-পার্বণকে।
বলা হচ্ছে, এগুলোই না কি স্বর্গে যাবার চাবি। বাৎসরিক পর্ব, উৎসব ও আচার অনুষ্ঠান ঠিক মতো করলেই যেন স্বর্গে যাওয়া নিশ্চিত হলো। সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি-মিথ্যা-চুরি, ধর্ষণ, নরহত্যা, গুম, পরস্ত্রীতে লোভ, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, অন্যের হক হরণ করা প্রভৃতিসহ যে কোন অনৌচিত্য কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারাই যেন যোগ্যতা অর্জনের মাপকাঠি, সমাজ-সংসারে গণ্যমান্য ব্যক্তি হওয়া গেল।
ভয়ঙ্কর দিন আগত। ‘সবাই আমরা পরের তরে’ এই শিক্ষা-সংস্কৃতির বিপরীতে সবাই আমরা মতলবের তরে, স্বার্থের তরে। এই কৃষ্টিতে দীক্ষিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় পড়ে বেচারা ধর্মকে আমরা শুধু হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করছি। সাধনার পুস্তক, ধর্মগ্রন্থকে পাঠ না করে, আত্মত্যাগের মহিমান্বিত দর্শনকে চর্চা না করে, সাধনা না করে, দৈনন্দিনের বিধান ও বাৎসরিক কয়েকটি উৎসবের রশি দিয়ে ধর্মকে আমরা আষ্টে-পিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছি। মনুষত্বের ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এবং ভবিষতের রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে জীবন ধারণের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরা বড্ড জরুরি হয়ে পড়েছে।
নইলে রচনার শুরুর সেই খেঁজুর গাছের মতো ধর্মান্ধ কৃষ্টি আমাদের আজন্মের লালিত সংস্কৃতিকে একেবারে গ্রাস করে ফেলবে। তখন ধর্মের অধ্যাত্মবাদ, মনুষত্ববাদ, সাম্যবাদ, প্রকৃতিবাদ ও বিশুদ্ধতাবাদের মতো গুণবাচক স্তবগুলো শুধু গল্পের উপাদানই হয়ে থাকবে, সমাজ রক্ষার ভাবকথায় বন্দিত হবে না। অনাগত সেই দুর্গতির কথা ভেবে দেখা আবশ্যক নয় কি?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কবি ও সমাজ সংস্কারকর্মী।
আপনার মতামত লিখুন :