শিরোনাম
◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৪:২৪ সকাল
আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৪:২৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অবহেলার বৃত্তে মেইল ও লোকাল ট্রেন

বাংলাদেশ প্রতিদিন : প্রায় অর্ধেক জনবল নিয়ে ধুঁকতে থাকা রেলওয়ের সামনে বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি। কিন্তু তা কাজে লাগাতে পারছে না রেলওয়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের মাধ্যমে রেলওয়ে আন্তনগর ট্রেনগুলো জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখলেও মেইল ও লোকাল ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অবহেলা রয়েছে। আন্তনগরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি মেইল ও লোকাল ট্রেন যাত্রীর ৭০ শতাংশ পরিবহন করে। করোনা সংক্রমণের আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালে রেলওয়ে প্রায় ৮ কোটি যাত্রী বহন করেছে। সাধারণ যাত্রীদের এ নির্ভরতাকে কাজে লাগাতে পারছে না রেলওয়ে। রেলওয়ের মনোযোগ কেবল আন্তনগর ও এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর প্রতি। লোকাল ও মেইল ট্রেনের প্রতি তাদের মনোযোগ নেই। যুগ যুগ ধরে লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনের প্রতি রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে প্রতিষ্ঠানটি তার সম্ভাবনাকে ব্যবহার করতে পারছে না।

স্বাভাবিক সময়ে ১০৪টি আন্তনগর এবং ২৫৪টি মেইল, কমিউটার, লোকাল এই মোট ৩৫৮টি ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করে রেলওয়ে। আসনবিহীন টিকিট বিক্রি হতো ১০ থেকে ২৫ শতাংশ। করোনাকালে চলা কোনো ট্রেনেই আসনবিহীন টিকিট বিক্রি হয়নি। এমনকি প্ল্যাটফরমে প্রবেশ টিকিট বিক্রিও পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। রেলওয়ে সূত্র জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ট্রেন বন্ধ থাকায় এবং নির্ধারিত যাত্রী নিয়ে কিছু ট্রেন চলায় করোনাকালে ১৪ মাসে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে রেলওয়ে। বিভিন্ন সময় ৫০ শতাংশ আসন নিয়ে ট্রেন চললেও অধিকাংশ ট্রেনেই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ (৫০ শতাংশ আসন থেকে) সিট ফাঁকা ছিল।

এদিকে করোনার বিধিনিষেধ শিথিলের তিন সপ্তাহ পরও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। সর্বশেষ ১৭ আগস্ট রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের সার্কুলার অনুযায়ী পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ১২ জোড়া আন্তনগর ট্রেন চলাচল করছে। অন্যদিকে উভয় অঞ্চলে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও ডেমু ট্রেন মিলিয়ে ২৪ জোড়ার কিছু বেশি ট্রেন চলাচল করছে। অনেক ট্রেন এখনো রেলওয়ের শিডিউলভুক্ত হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, যাত্রীদের ব্যাপক চাহিদার পরও লোকাল, এক্সপ্রেস ও মেইল ট্রেনের আধুনিকায়নে রেলওয়ের মনোযোগ নেই। এমনকি সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে থাকা ট্রেনগুলো একে একে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রেলওয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো কোচ আমদানি করেনি। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আন্তনগর ট্রেনে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে গত ১০ বছরে দুই দফা বাড়ানো হয়েছে রেলের ভাড়া। রেলওয়ের অব্যাহত লোকসান কমিয়ে আনতে ২০১২ সালের অক্টোবরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়। এর চার বছর পর ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আরেক দফা ভাড়া বাড়ানো হয়। ২০২০ সালের জুলাই-আগস্টে করোনার মধ্যেই ২৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সে উদ্যোগ কার্যকর হয়নি।

সারা দেশে রেল নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির লক্ষ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন, আধুনিক ইঞ্জিন ও কোচ আনা হলেও লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনে নতুন কিছু সংযোজন হয়নি। অথচ প্রতি বছর ট্রেনে ভ্রমণকারী কোটি কোটি যাত্রীর ৭০ ভাগই বহন করে লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন। এসব ট্রেনের চলাচল সীমিত করায় দুর্ভোগ বেড়েছে অল্প দূরত্বে চলাচলকারী কম আয়ের রেলযাত্রীদের। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেন, রেলওয়েতে লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিন-কোচের স্বল্পতা দীর্ঘদিনের। আমরা এসব মেরামত করছি।

এদিকে আন্তনগর, মেইল এক্সপ্রেস, কমিউটার, ডেমুসহ বিভিন্ন ট্রেনে যুক্ত রয়েছে নতুন পুরান কোচ ও ইঞ্জিন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বগি বা কোচের ঘাটতি কিছুটা কমলেও ইঞ্জিন সংকটের কারণে ট্রেন চলাচলে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘদিনের পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত ট্রেনের যাত্রা বাতিল ও শিডিউল বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ আরও বেশ কিছু কোচ আমদানি করলেও ইঞ্জিন কেনায় রয়েছে নানা জটিলতা। ফলে ইঞ্জিন সংকটের মধ্যেও জোড়াতালি দিয়েই চলাচল করছে ট্রেন। পূর্বাঞ্চলের আন্তনগর ট্রেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে যাত্রীরা চলাচল করছেন নতুন কোচেই। তবে ইঞ্জিন সংকট রয়েই গেছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে। এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে রেলওয়ে প্রশাসন কাজ করছে বলে জানান দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে বর্তমানে ১৩৩টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৩টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৮টি এবং ঢাকা বিভাগে ৪৫টি ইঞ্জিন বিভিন্ন ট্রেনে চলাচল করছে। প্রতিদিনই ১০০ ইঞ্জিন দিয়ে কোনোরকমে ট্রেন চলাচল করে আসছে। তার পরও প্রতিদিনই ৫-৭টি ইঞ্জিন সংকটে রয়েছে। ৩৩টি ইঞ্জিন ভারী মেরামতের জন্য পার্বতীপুরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে বিদেশ থেকে ইডিসিএসের অর্থায়নে ১০টি এবং এডিবির অর্থায়নে ২০টি ইঞ্জিন এসেছে। আরও ১০টি ইঞ্জিন আসছে। এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ৬০ থেকে ১০০ বছরের পুরনোও রয়েছে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে নতুন পুরান ৯৮০টি কোচ রয়েছে। এখানে ১৯৬টি ট্রেন চলাচলের মধ্যে ঢাকায় ১৩০টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৬টি ট্রেন চলাচল করছে। এখানে আন্তনগর, মেইল এক্সপ্রেস, কমিউটার, ডেমুসহ বিভিন্ন ট্রেন চলাচলে নতুন কোচ ও ইঞ্জিনগুলো যুক্ত রয়েছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) ইঞ্জিনিয়ার মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘রেলওয়ের গতি বাড়াতে দায়িত্বশীলরা কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বিদেশ থেকে কোচ ও ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে। আরও কিছু কোচ ও ইঞ্জিন আমদানির প্রক্রিয়াধীন আছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে পূর্বাঞ্চলে ১৩৩টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে ১০০ ইঞ্জিন ট্রেন চলাচলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বাকি ৩৩টি ইঞ্জিন ভারী মেরামতের জন্য পার্বতীপুর ওয়ার্কশপে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এসব সংকট কাটাতে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আরও ১০টি ইঞ্জিন এবং ১৫০টি কোচ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে।’ তবে দীর্ঘ বছরের পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনও (লোকমোটিভ) রয়েছে বলে জানান তিনি।

রেলের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনের গতি যথাযথভাবে বজায় রাখা যাচ্ছে না। পুুরনো ইঞ্জিন প্রতিনিয়ত মেরামত করে চালাতে হয়। একটি ইঞ্জিন প্রায় তিনটি কারখানায় মেরামত করে তারপর ট্রেনে সংযোজন করা হয়। পুরনো ইঞ্জিনের কারণে দুর্ঘটনার পাশাপাশি যাত্রাপথে রেলের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। তারা বলেন, দৈনিক চাহিদার তুলনায় ইঞ্জিন কম থাকা, লাইফটাইম শেষ হয়ে যাওয়া, মেরামতের জন্য মালামালের ঘাটতি, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং লোকবল সংকটের কারণে ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন থাকলে যাত্রা বিলম্ব রোধ করা সম্ভব হতো বলে জানান তারা। জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে (ঢাকা-চট্টগ্রাম) ১৯৬টি ট্রেন চলাচল করে। এখানে আন্তনগর, মেইল এক্সপ্রেস, কমিউটার, ডেমুসহ বিভিন্ন ট্রেন চলাচলে ইঞ্জিন আছে ১৩৩টি। এর মধ্যে প্রায় ৫০টি মেরামতের জন্য কারখানায় আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। একই সঙ্গে ভারী মেরামতের জন্য পার্বতীপুরেও নেওয়ার অপেক্ষায় আছে বেশ কয়েকটি ইঞ্জিন। এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ২০ বছর ইকোনমিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আছে অর্ধশত বছরের পুরনো ইঞ্জিনও। রেলওয়ে ২০১৪ সালে ভারত থেকে ৪৬ ও কোরিয়া থেকে ২৫টি ইঞ্জিন কেনে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য আনা ২ হাজার ৯০০ সিরিজের (এমইআই-১৫) একটি ইঞ্জিন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগকে দেওয়া হয়। এসব ইঞ্জিনের ইকোনমিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারিত। কিন্তু আমেরিকা থেকে আনা ১১টির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে ৩৪ বছর আগেই। কানাডা থেকে প্রথম ধাপে আনা ৮টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে ৪৬ বছর আগে। অর্থাৎ এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ২৬ বছর আগেই। দ্বিতীয় ধাপে কানাডা থেকে আনা ৯টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে ৩৭ বছর আগে। হাঙ্গেরি থেকে আনা ৩টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে ৩৪ বছর আগে। এসব ট্রেনের কোচ ও ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে আগেই। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিন ও কোচ দিয়েই ট্রেনগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব ট্রেন উনিশ-বিশ হলেই লাইনচ্যুতসহ চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়ে পড়ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়