শিরোনাম
◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ ভিত্তিহীন মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের নাজেহাল করা হচ্ছে: মির্জা ফখরুল ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী ◈ অপরাধের কারণেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের  বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী  ◈ অ্যাননটেক্সকে জনতা ব্যাংকের সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি  ◈ ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ ইরানে ইসরায়েলের হামলার খবরে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক ◈ বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে বাস ঢু‌কে প্রকৌশলী নিহত

প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৩:১৩ রাত
আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৩:১৩ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আনিসুল হক: গল্পের ভাষা এবং রবীন্দ্রনাথ

আনিসুল হক: রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মোপাসাঁ বা যে-সব বিদেশী লেখকের লেখকের কথা তোমরা প্রায়ই বলো, তাঁরা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন। লিখতে লিখতে ভাষা তৈরি করতে হলে তাদের কী দশা হতো জানি নে।’ গদ্য তৈরির সেই পথরেখাটা রবীন্দ্রনাথের একাধিক গল্পের চরিত্রদের নিজেদের লেখার মধ্যে আছে। নষ্টনীড়ে অমল যা লিখত, ‘আমার খাতা’ ‘হে আমার শুভ্র খাতা, আমার কল্পনা এখনও তোমাকে স্পর্শ করে নাই। সূতিকাগৃহে ভাগ্যপুরুষ প্রবেশ করিবার পূর্বে শিশুর ললাটপত্রের ন্যায় তুমি নির্মল, তুমি রহস্যময়।’ .. আর আষাঢ়ের চাঁদ রচনায় অমল লিখেছিল, আজ কেন আষাঢ়ের চাঁদ সারারাত মেঘের মধ্যে এমন করিয়া লুকইয়া বেড়াইতেছে। যেন স্বর্গলোক হইতে সে কী চুরি করিয়া আনিয়াছে, যেন তাহার কলঙ্ক ঢাকিবার স্থান নাই। ইত্যাদি।

আর চারু কী লিখেছিল? ‘কোনোমতেই অমলের গণ্ডি এড়াইতে না পারিয়া অবশেষে চারু রচনার বিষয় পরির্বতন করিল। চাঁদ, মেঘ, শেফালি. বউ-কথা-কও এ সমস্ত ছাড়িয়া সে ‘কালীতলা’ বলিয়া একটা লেখা লিখিল। তাহাদের গ্রামে ছায়ায়-অন্ধকার পুকুরটির ধারে কালীর মন্দির ছিল, সেই মন্দিরটি লইয়া তাহার বাল্যকালের কল্পনা ভয় ঔৎসুক্য, সেই সম্বন্ধে তাহার বিচিত্র স্মৃতি...এই সমস্ত লইয়া সে একটি লেখা লিখিল। তাহার আরম্ভভাগ প্রথমে অমলের লেখার ছাঁদে কাব্যাড়ম্বরপূর্ণ হইয়াছিল, কিন্তু খানিকটা অগ্রসর হইতেই তাহার লেখা সহজেই সরল এবং পল্লীগ্রামের ভাষা-ভঙ্গি-আভাসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল।’
চারুবালার সেই লেখা প্রকাশিত হলে অমলদের ধারার তীব্র সমালোচনা করে চারুবালার ভাষার অকৃত্রিম সরলতা, অনায়াস সরসতা ও চিত্ররচনানৈপুণ্যের প্রশংসা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো। এটা কেবল অমলের আর চারুর ব্যাপার না, এটা তখনকার প্রচলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নতুন পথপ্রবর্তনের চিহ্নটাই ধারণ করে আছে। চারুবালা এইখানে রবীন্দ্রনাথের মতো দুটো আবিষ্কার ও প্রবর্তন করলো, এক, কাহিনী নিতে হবে নিজের জীবন নিজের গ্রাম নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে, ভাষাটাও নিতে হবে সেই জীবন থেকেই।

রবীন্দ্রনাথ তাই করেছেন। ছোট প্রাণ ছোট কথা বলতে রবীন্দ্রনাথ সেটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বলেছেন, আগে তো গল্প লেখা হতো প্রতাপাদিত্যদেরকে নিয়ে, তিনিই প্রথম সাধারণ মানুষের জীবনের কথা গল্পে এনেছেন। সেটাই ছোট ছোট দুঃখ কথা। ছোট প্রাণ ছোট কথা বলেছেন বলেই রবীন্দ্রনাথ আদরণীয়। এখানেই তো রবীন্দ্রনাথ আমার কাছের। তারপর ধরুন, ভাষাটা। রবীন্দ্রনাথের গল্পের ভাষার মধ্যে পরতে পরতে কৌতুকময়তা, একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, এই যে তার গল্প আমরা এতকাল পড়েও পড়ি, আর আমাদের ভালো লাগতে থাকে, তার কারণ এই পরিহাসবোধ। হাস্যকৌতুক ব্যঙ্গকৌতুক তো তিনি লিখেছেনই কিন্তু গল্পের ভাষা খেয়াল করে দেখুন না।

অধ্যাপক গল্পের প্রথম লাইন, ‘সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না। সেইজনই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শান্ত ছিলেন না।’ বা ধরুন ছুটি গল্প কী ভাবে শুরু হচ্ছে। ‘বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাবের উদয় হইল; নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়াছিল; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে।’

যে ব্যক্তির কাঠ, আবশ্যক-কালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল। শেষের কবিতার প্রথম লাইনগুলো খেয়াল করুন। ‘অমিতর বাপ দিগি¦জয়ী ব্যারিস্টার। যে পরিমাণ টাকা তিনি জমিয়ে গেছেন সেটা অধস্তন তিন পুরুষকে অধঃপাতে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু পৈতৃক সম্পত্তির সাংঘাতিক সংঘাতেও অমিত বিনা আপত্তিতে এ যাত্রা টিকে গেল।’

এইভাবে রসিকতার সঙ্গে যে গল্প বলে, তাকে আপনি ভালো না বেসে পারবেন? তবে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাতে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ বা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তার মূল্য চিন্তা প্রকাশ করেছেন বলে নয়, বরং সেটাই ওই উপন্যাসগুলোর উচ্চকিত দুর্বলতা, ওগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ রবীন্দ্রনাথ নামের একজন মহাপুরুষের এই অমূল্য চিন্তাভাবনাগুলো ওই উপন্যাসগুলোয় আছে। উপন্যাসগুলো অমূল্য নয়, চিন্তাটা অমূল্য। সেটা খুব প্রশংসার কথা না।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোতেও একজন লেখক হিসেবে আমি পাই সমবেদনা, সহানুভূতি। রবীন্দ্রনাথ চোখের বালি লিখেছেন ধারাবাহিকভাবে, তার চিহ্ন ওই উপন্যাসে আছে। আমাদের টেলিভিশন ধারাবাহিকের মতোই পর্বের পর পর্ব যেন লেখা হচ্ছে, টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নৌকাডুবির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন নৌকাডুবি রচনার কারণ। ‘প্রকাশকের তাগিদ।’ তিনি বলেছেন গল্প লেখার তার কোনো তাড়না ছিল না, প্রকাশকের চাপে পড়ে লিখেছেন। সাইকোলজিকাল একটা নিষ্ঠুর কিন্তু ঔৎসুক্যজনক ‘প্রকাণ্ড একটা ভুলের দম লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ এই যে একটা দম বা চাবি মেরে দেওয়া হলো, আপনাকে পড়তেই হবে।

অমিতের সঙ্গে লাবণ্যর পরিচয় হয়েছিল শিলঙ্গে, গাড়ির দুর্ঘটনার সূত্র ধরে। চোখের বালির ভূমিকাতেও তিনি জানিয়েছেন, তার উপন্যাসগুলো মাসিক পত্রের ভোজের জোগান দেবার জন্য লেখা। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের প্রধান অসুবিধা, আমার জন্য, পাত্রপাত্রীরা বড় বেশি কথা বলে, এবং খুব ভারি ভারি লম্বা লম্বা কথা বলে। রবীন্দ্রনাথের একটা চিন্তা খুব মূল্যবান। যেটা সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে যন্ত্র হিসেবে দেখতে বারণ করেছিলেন। তাঁর ভাষায়:
‘আজকাল য়ুরোপ মানুষের সব জিনিসকেই বিজ্ঞানের তরফ থেকে যাচাই করছে, এমনিভাবে আলোচনা চলছে যেন মানুষ-পদার্থটা কেবলমাত্র দেহতত্ব কিংবা জীবতত্ব, কিংবা মনস্তত্ত্ব, কিংবা বড়োজোর সমাজতত্ব। কিন্তু মানুষ যে তত্ব নয়, মানুষ যে সব তত্বকে নিয়ে তত্বকে ছাড়িয়ে অসীমের দিকে আপনাকে মেলে দিচ্ছে দোহাই তোমাদের, সে কথা ভুলো না।’ এটা রবীন্দ্র উপন্যাসের পাত্রের সংলাপ বটে, কিন্তু এই প্রটাগনিস্ট আসলে রবীন্দ্রনাথেরই বক্তব্য পেশ করছে। ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়