সনতচক্রবর্ত্তী: [২] এক সময় মানুষের নিত্য জীবনে বাঁশের ব্যবহার থাকলেও বর্তমানে বাঁশ ব্যবহার নেই বললেই চলে। এক সময় ফরিদপুর জেলার নিম্নআয়ের মানুষেরা দৈনন্দিন কাজে বাঁশের ব্যবহার করতো। জেলায় বিভিন্ন এলাকায় একসময় বাঁশ বাগান থাকায় গ্রামীণ জনপদের বিশেষ করে দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষ বাঁশের উপর নির্ভরশীল ছিল। যারা কাঠ, টিন অথবা ইটের তৈরি ঘর বাড়ি তৈরী করতে পারতেন না তারা বাঁশের তৈরি বা বাঁশের খুটি দিয়ে ঘরবাড়ী তৈরি করে বাস করতো।
[৩] বাঙালী সংস্কৃতিতে বাঁশ শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঁশ শিল্প একটি লোকশিল্প। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতনিত্য ব্যবহার্য এই বাঁশ কালক্রমে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পের প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে। বাঁশের তৈরি এই শিল্প দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছাড়াও আদিবাসীদের প্রধান জীবিকার মাধ্যম ।
[৪] গ্রাম বা শহর উভয় জায়গাতেই বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বাঁশের তৈরি নানান সামগ্রী ব্যবহার করে থাকি। কাঠ ও বেতের পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যবহার হয়ে আসছে।
[৫] দেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে তার মধ্যে বাঁশ অন্যতম। দেশের লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার হয় না। বাঁশ দিয়ে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো- ঝুড়ি, ঝাকা, চালুন, খাঁচা, পাটি, খাড়ি, ঝাড়ু, কুলা, হাতপাখা, মাদুর, ইত্যাদি। বাঁশের দোলনা ও চারচালা ঘর; বাড়ি-ঘরের বেড়া, ঘরের খুঁটি, ঘরের ঝাপ বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির প্রতীক। ঘরের মাচা, ঘরের খাট বাঁশ দিয়ে তৈর করা যায়। ঘরের আসবাব হিসেবে মোড়া, চাটাই, সোফা, বুকসেলপ, ছাইদানি, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, সিগারেট রাখার ছাইদানি, নূনদানি, পানদানি, চুনদানি, ইত্যাদি বহুল প্রচলিত।
[৬] এক সময় বাঁশ চাষ করা হতো ব্যাণিজ্যিকভাবে। যা অযত্নে আর অবহেলায় গড়ে উঠত অল্প খরচে। সেই বড় বড় বাঁশ ঝাড় বা বাঁশ আজ আর দেখা যায় না।
[৭] এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত বাঁশ ব্যবসায়ীরা এবং তা ক্রয় করে নিয়ে যেতো গ্রাম থেকে। কুটির শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এই দেশে কাগজ তৈরীতেও ব্যাপক অবদান ছিল। যে বাঁশ বন্যা, ঝড়ে, গরীবের বাড়ি তৈরীতে প্রধান বাঁশ ছাড়া কল্পনা করা যেত না। সেই বাঁশ অযত্নে আর আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আগের দিনে অনেক পরিবারই ব্যবসায়ীকভাবে বাঁশ ঝাড়ের খড়কুটা, ছায় এনে বাঁশ ঝাড়ের রনাবনো করতেন। এখন আর সেই পুরনো ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। নেই বাঁশ বাগান বা আর তৈরী হয় না বাঁশের সাঁকোও।
[৮] কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বাঁশের অভাবে উক্ত পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে। বাঁশ ঝাড়ের এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার আগ্রাহে আর নেই বাগান মালিকদের। এছাড়া ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলায় এক সময় প্রতিটি জমির মালিকদের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ ছিল বাঁশ ঝাড়। আর আজ সেই বাঁশ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বাঁশের ঝাড়গুলো নির্মূলভাবে কেটে বিনাশ করে সেখানে কাঠের গাছ, বিভিন্ন ফলের বাগান তৈরী করা হয়েছে। এই কারণে অবহেলায় বেড়ে ওঠা বাঁশের ঝাড় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
[৯] বাঁশ ব্যবসায়িক মামুন হক বলেন, একসময় প্রত্যেক বাড়িতেই বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ছিল। চাহিদাও ছিল ব্যাপক। বর্তমান প্লাস্টিক পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াই বাড়ি তৈরিতে বাঁশ ঝাড় উজার হয়ে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই কমে যাচ্ছে। তাই বাঁশ বাগানে তেমন বাঁশ কিনতে পাওয়া যায় না।
[১০] সৌদি আরব প্রবাসী ইন্দাদুল হক মিলন বলেন, সিলভার ও মেলামাইন জাতীয় হালকা টেকসই সামগ্রী নাগরিক জীবনে গ্রামীণ হস্তশিল্পের পণ্যকে হটিয়ে দিয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ শিল্প। ফলে, এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল লোকজন বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকেই আবার এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। তাছাড়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে এ শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ। নির্মাণ ব্যয় বেশি পড়ায় এসব পণ্যের দামও পড়ছে বেশি। সাধারণ মানুষ ঝুঁকে পড়ছে অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়া প্লাস্টিক পণ্যের উপর। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ মানব জীবনে সর্বাবস্থায় উপকারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাঁশ শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। তাই বাঁশ শিল্পকে বাঁচাতে এখনই আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত।
[১১] তবে বাঁশ ঝাড় টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে বিশেষ ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সর্ববস্তরের মানুষের। সম্পাদনা: হ্যাপি
আপনার মতামত লিখুন :