মাসুদা ভাট্টি: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর একেকজনের কাছে একেকরকম ছিলো। গোটা ধানমণ্ডি এলাকাই ছিলো রক্তাক্ত সে ভোরে। বত্রিশ নাম্বারে লাশের সারি, শেখ মণির বাড়িতে লাশ, সেরনিয়াবতের বাড়িতে লাশ, সর্বত্র লাশ আর লাশ; কিন্তু যারা জীবিত ছিলেন তাদের কী অবস্থা হয়েছিলো? বঙ্গবন্ধুর জীবিত পরিবারবর্গ এবং ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচরদের জন্য সেই ভোরটি ছিলো ভয়ংকর, কারণ বঙ্গবন্ধুসহ যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারাতো চলেই গিয়েছেন কিন্তু যারা জীবিত ছিলেন তারা মৃতদের জন্য শোক করার পরিবর্তে নিজেদের জীবন নিয়ে পালানোর জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এই ঢাকা শহরে, এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি, এ জায়গা থেকে ও জায়গা- তারা জীবনটা হাতে নিয়ে দৌড়াঁচ্ছিলেন। নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউ-ই বাদ ছিলেন না এই জীবন হাতে নিয়ে দৌঁড়ে ফেরাদের তালিকা থেকে। তাদের পেছনে একদল মানুষখেকো কুকুর লেগেছিলো, রাষ্ট্র লেগেছিলো, রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেগেছিলো- কেউই বলতে গেলে বছর পাঁচেকের মধ্যে নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারেননি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশের বাইরে ছিলেন, তবুও তাদেরকে চরম আতঙ্ক নিয়ে এদেশ থেকে ওদেশ করতে হয়েছে। শেষ অবধি বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার মতো শেখ মণির মা-ভাই-বোন-শিশু সন্তানেরাসহ বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য জীবিত আত্মীয়স্বজনদের ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে জীবন বাঁচাতে। তিন/চার/পাঁচ বছর পর প্রকাশ্যে বা গোপনে দেশে ফিরে এসেও তাদের জীবন কতোটা ভয়ঙ্করের মুখোমুখি হয়েছিলো সে আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। ইস্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে হেন কোনো জায়গা নেই রাষ্ট্র সেখানে বাগড়া দেয়নি, রাষ্ট্রের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীগুলি সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কোনো সদস্য যাতে এ দেশে টিকতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। তারা যেনো ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, রাজনীতিতো দূরের কথা।
আজকে যারা বলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গকে হত্যাকাণ্ড ছিলো কিছু বেপথু সেনা সদস্যের উচ্চাভিলাষী কর্মকাণ্ড তারা কী ভাবেন যে, [১]তাহলে কেন তারা বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিবসহ পরিবারের সকল নারী-শিশু-যুবা সকলকে হত্যা করেছিলো?[২]তারা কেন শেখ মণিসহ তার স্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বাকি ঘনিষ্ঠজনদের হত্যা করেছিলো?
[৩] কেন হত্যাকারীরা এতোবড় হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র দখল না করে রাষ্ট্রের দখল বাকিদের দিয়েছিলো?
[৪] কেন খুনি খুন করে পালায়নি?
[৫] কেন খুনীদের ধরার জন্য দীর্ঘ একুশ বছর রাষ্ট্র কোনো তৎপরতা চলেনি?বরং খুনি ও তাদের পরিবারবর্গকে বিবিধ পুরষ্কার দেয়া হয়েছিলো রাষ্ট্রের খরচে?
[৬] কেন খুনিদেরকে বাঁচাতে আইন পরিবর্তন করে ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছিলো? [৭] কেন যে বাহিনীর সদস্যরা এই ভয়ঙ্কর রক্তকাণ্ড ঘটিয়েছিলো সে বাহিনী তাদেরকে চাকরিচ্যুত কিংবা কোর্ট মার্শাল করে তাদের অবসরোত্তর ভাতাদি বন্ধকরাসহ বিচারটি করেনি?
[৮] কেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জীবিত সদস্যদের জীবনকে, বেঁচে থাকাকে অসহনীয় করে তোলা হয়েছিলো দেশে এবং বিদেশে?
[৯] কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরই বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র বদলানো হয়েছিলো? কে বদলেছিলো?
[১০] কী ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রক্তাক্ত বাংলাদেশের ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের টাকায় ক্যান্টনমেন্টকে ব্যবহার করে রাতারাতি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছিলো এ- দল ও- দল থেকে রাজনীতিবিদদের কিনে এনে?
[১১] কেন সেই দলটির বর্তমান নেতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন তার মিথ্যা জন্মদিন পালনের উৎসব করার দিন হিসেবে? প্রশ্ন আরও আছে, নিশ্চয়ই আপনাদেরও আছে। আসুন যোগ করি প্রশ্ন। আজ জাতীয় শোক দিবস, যারা দিনটি মানেন তারা কেন মানেন আর যারা দিনটি মানেন না তারা কেন মানেন না সেটি পরিষ্কার করা গেলেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে না। যদি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পেছনের রাজনীতিটিই আমরা না ধরতে পারি তাহলে কোনো দিনই আমরা বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারবো না। কেন জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিলো সে প্রশ্নে বিবেকের কাছে আমরা পরিষ্কার কিনা চলুন সে প্রশ্ন করি আজ।
আপনার মতামত লিখুন :