দীপক চৌধুরী : প্রিয় দুই গুণীজন চলে গেলেন। বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক শেখ আব্দুল হাকিম ও কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী আমার আপনজন হয়ে ওঠেন ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এরপরতো ক্রমান্বয়ে তারা হয়ে ওঠেন প্রিয় জ্যেষ্ঠ বন্ধু। গতকাল দুপুরের দিকে শুনলাম হাকিম ভাইয়ের শেষসংবাদ। আর রাতে শুনলাম একুশে পদকপ্রাপ্ত বুলবুল ভাইও দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। তারা ছিলেন একে অন্যের হরিহর আত্মা। পৃথিবী ছাড়লেন একই দিনে। বেলা একটার দিকে রাজধানীর মাদারটেকের বাসায় মারা যান শেখ হাকিম। তিনি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিলো ৭৫ বছর।
স্বৈরাচার এরশাদের আমলে নানাকারণে সূত্রাপুরের "ডাইলপট্টি" আর টিকাটুলির "বিক্রমপুর হাউজে" আমার ঠাঁই হয়েছিল দুজনের উছিলায়। তাঁরা ছিলেন আমার দুর্দিনের বন্ধু। জায়গা ঠিক করে দিয়েছিলেন তাঁরাই। কিছুদিন এমন আশ্রয়ে থাকার পর নানা রকম সমস্যা থেকে মুক্তি পাই। এরপর কখনো গোপীবাগ, নারিন্দা, সূত্রাপুরে বুলবুল চৌধুরীর বাসায় ছিল রাজনীতির গল্পসহ চৌদ্দমিশালী বিষয়ের হাসি-ঠাট্টা আর নির্মোহ আড্ডা। হাল আমলের লেখালেখি, মুম্বাই সিনেমার বৈশিষ্ট্য কিংবা কোনো না কোনো কিংবদন্তির পরিণতি। কী ছিল না সেখানে! খানাপিনা তো ছিলই। তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর প্রাণবন্ত আড্ডায় দিন গুজরাণ করার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে রাত জেগে ‘ভিসিআর’ উপভোগ করা ছাড়াও গভীর রাতঅব্দি আড্ডায় মানুষের জীবনের গল্প শুনেছি তাঁর মুখে। জীবন-জীবিকার গল্প, রাজপুত্রের অসহায়ত্বের কাহিনী। নিজের রচিত গল্প শুনিয়ে অতঃপর এর ‘বিচার ভার’ আমাকে দিয়ে জানতে চাইতেন, ‘কেমন হয়েছে বলুন তো?’ এ সময় লক্ষ্য করেছি, তাঁর চোখেমুখে ফুটে ওঠা অন্যরকম সৃষ্টিশীলতার আনন্দ। অনেক বড় মাপের লেখক হলেও এতোটুকু অহমিকা ছিল না তাঁর মধ্যে। দারুণ চিন্তাবিদ বুলবুল চৌধুরী শরতের এক গভীর রাতের আমাদেও জনাকীর্ণ আড্ডায় বলেছিলেন, ‘পৃথিবীটা শুধু ঘৃণাভরা নয়, প্রেমভরাও’। হয়তোবা এটাই তাঁর অনুধাবন।
সেবা প্রকাশনীর বিখ্যাত গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র ২৬০টির মতো বইয়ের লেখক শেখ হাকিম। তবে সিরিজের নিয়ম অনুসারে প্রকাশ হয়েছে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে। ১৯৪৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে শেখ আবদুল হাকিমের জন্ম। ভারত ভাগ হলে চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন তিনি।
১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝিতে সেবার আরেক সিরিজ ‘কুয়াশা’র দশম কিস্তি দিয়ে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হন শেখ আবদুল হাকিম। অবশ্য এর আগেই লিখে ছিলেন নিজের প্রথম উপন্যাস ‘অপরিণত প্রেম’। সেবার সঙ্গে প্রায় চার দশক যুক্ত ছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। গতকাল সন্ধ্যার দিকে সূত্রাপুরে নিজ বাসায় মারা যান বুলবুল চৌধুরী। তিনি দীর্ঘ দিন ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। গত সাত-আটমাস মাস আগে চৌধুরীর ক্যানসার ধরে পড়ে। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সারওয়ার আলমের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। কিন্তু ক্যানসার তার শ্বাসযন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে তার জ্বর ও শরীরের ওজন কমে যাচ্ছিলো। বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ‘কহ কামিনী’, ‘পাপ পুণ্যি’সহ বেশকিছু উপন্যাস জীবন্ত হয়ে ওঠে বর্ণনার কারণে। এ কথাসাহিত্যিকের বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘টুকাকাহিনী” এককথায় অনবদ্য সৃষ্টি।
কীর্তিমানদের বিদায়বেলায় শেষদেখাটি হয়ে উঠল না আমার। যেখানেই থাকুন না কেন- যেন তাঁদের শান্তিতে রাখেন প্রভু। ( ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : হামিদ কায়সার)
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :