শিরোনাম
◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ বিশ্ববাজারে সোনার সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ চেক প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ প্রফেসর ইউনূসকে প্রদত্ত "ট্রি অব পিস" প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত একই ভাস্করের একই ভাস্কর্য: ইউনূস সেন্টার ◈ নির্বাচনী বন্ড কেবল ভারত নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি: অর্থমন্ত্রীর স্বামী ◈ কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে দেশে ফিরলেন ভুটানের রাজা ◈ জনগণকে সংগঠিত করে চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করতে হবে: মির্জা ফখরুল

প্রকাশিত : ২৬ আগস্ট, ২০২১, ০৩:১৭ রাত
আপডেট : ২৬ আগস্ট, ২০২১, ০৩:১৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ফিরোজ আহমেদ: পরীমনি কতোদিন কারাগারে থাকবেন?

ফিরোজ আহমেদ: এই প্রশ্নের উত্তরের আগে একটা পুরনো দিনের সাংবাদিকতার কথা বলি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে দৈনিক আজকের কাগজে একটা রোমহর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছিল। শিরোনামটা ছিল ‘দুই বান্ধবীর জামিন বাণিজ্য’। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের বড় কর্তা ছিলেন এই দুই কথিত বান্ধবী। সারা দেশে তারা একটা গ্রেফতারের জাল ছড়িয়ে রেখেছিলেন, এই অকারণ গ্রেফতারের হয়রানি থেকে রেহাই পেতে নিরীহ মানুষ কিছু টাকা যথাযথ স্থানে ঘুষ দিতো। এইভাবে আসতো বিপুল অর্থ, সেই চক্রের তোলা অর্থের একটা ভাগ পেতেন ওই দুই বান্ধবী, এমনটাই ছিল ওই প্রতিবেদনের ভাষ্য। আজকের কাগজ তখন সরকার সমর্থক একটা দৈনিক, সেই রকম একটা দৈনিকে এমন একটা সংবাদ ছাপা হওয়াটা ছিল রীতিমতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক, [বকর ভাই, বছর কয়েক আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। সদা হাস্যময়. আজন্ম আওয়ামী লীগ, এই বকর ভাইয়ের মতো মানুষ আজকাল বিরল] অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। প্রতিবেদনটির সত্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া মাত্র তিনি সেটা প্রকাশ করেন, নির্ভয়ে। এই এক প্রতিবেদনের কারণে তার জীবনে বহু ঝড় বয়ে যায়, সে এক বিশাল কাহিনী, বাকস্বাধীনতা থাকলে এই এক প্রতিবেদন নিয়েই একটা চাঞ্চল্যকর চলচ্চিত্র তৈরি হতে পারতো- গ্রেফতারের জাল থেকে শুরু করে জামিনের বাণিজ্য পর্যন্ত পুরো দৃশ্যপট যেন জীবন্ত একটা চিত্রনাট্যই। তবু অন্তত এই জামিন বাণিজ্যের সংবাদটা প্রকাশ পেয়ে ন্যূনতম একটা সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি করেছিল। দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ মানে যেটার বরাত দিয়ে রাজনীতির লোকেরা কথা তুলতে পারে [কেননা বেকায়দা, উৎসবিহনীন কথার সূত্র ধরে তাদের মুখ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য আইনের লোকজন সর্বদাই প্রস্তুত থাকেন], চায়ের আড্ডায় ঝড় বয়, পত্রিকার কথার সূত্র ধরে দৃশ্যমান প্রতিরোধের পাশাপাশি অদৃশ্য বহু তৎপরতাও চলে। এমনকি শাসক দলের মাঝেও অস্বস্তি তৈরি হয়, বহু অন্যায়ের প্রতিকার সম্ভব হয়।

তো এবার দেখা যাক পরীমনির বেলাতে কী ঘটলো। কী ঘটলো আমরা আসলে জানি না, কেননা কোনো পত্রিকা আমাদের বলে না আসলে কী হয়েছে। অধুনলুপ্ত আজকের কাগজের একটা বাণীমতো ছিলো, ‘আমাদের চোখ বাঁধা নেই, আমাদের হাত খোলা, আমরা বলতে পারি’। এখনকার দিনে আমার বেশ পছন্দের একটা দায়িত্বশীল দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক সাংবাদিকতার প্রায়-প্রয়াণের শোকবার্তা লিখেছেন এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই: ‘না, আমরা কিচ্ছুটি করি নাই, কেননা এরা সবাই আর্থিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ এবং তাদের ঘাঁটাবার সাহস আমাদের নাই। কখনো কখনো আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করি বটে, কিন্তু কেবল ততোদূর পর্যন্তই, যাতে আসলে যারা কলকাঠি নাড়েন, তাদের আড়ালে রাখা যায়, অথবা কেবল তখনই, যদি মূল অপরাধীদের রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রতিপত্তি আদৌ না থাকে, কিংবা যখন আমাদের অনুসন্ধানের উদ্দিষ্টরা আর ক্ষমতার সুনজরে নেই’। ফলে তার স্বীকারোক্তিতে, গণমাধ্যম আছে এই এমন একটা দশায়, যেখানে ‘খারাপ কিছু দেখি না, খারাপ কিছু শুনি না, খারাপ কিছু বলি না।’

তো আমরা যা বলছিলামÑ আমরা ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ আসলে জানি না, কে বা কাদের ক্রোধের শিকার হয়ে পরীমনি আসলে গ্রেফতার হয়ে আছেন। যারা জানেন বলে অনুমান করি, তেমনি এক জেষ্ঠ্য গণমাধ্যম কর্মীকে দেখলাম লিখেছেন, পরীমনিকে আটকে রেখেছে ‘এখনো উপনিবেশিকতার খোলসে আবৃত’ এই ‘বর্তমান রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চরিত্র’। প্রবাসী একজন প্রিয় ছড়াকার লিখেছেন পরীমনিকে আটকে রেখেছে পুরুষতন্ত্র। কোনো সন্দেহ নাই, পরীমনিকে গ্রেফতারটিকে সহজ করে দিয়েছে সমাজে টিকে থাকা পুরষতান্ত্রিক মানসিকতা। পরীমনিকে আইনি নিপীড়নের কাজটিকে সম্ভব করছে উপনিবেশিক খোলস। কিন্তু ধরুন, যদি সত্যি সত্যি পরীমনি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ক্রোধের শিকার হয়ে থাকেন, সেই বিষয়টার ওপর আলো না ফেলে এই উপনিবেশিক রাষ্ট্রের চরিত্র উন্মোচন, এই পুরুষতন্ত্রের নিন্দা সেই প্রতিহিংসা-পূরণরত ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গকে সামান্য দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারবে? সামান্যতম পরিমাণে? পরীমনিকে নিয়ে যে অধিকাংশ কর্মসূচি হচ্ছে, তার দুর্বলতা আসলে ওইখানেই। আসল কুশীলবা যেহেতু এতে সামান্য মাত্রায়ও আক্রান্ত বোধ করছেন না, বরং হয়তো তাদের প্রভাব কোন মাত্রায় কার্যকর তার ইঙ্গিতবহ হলো পরীমনির উকিল পর্যন্ত জামিনের আবেদন করছেন না। ফলে এই পরিস্থিতিতে পরীমনিকে এই কর্মসূচিগুলো মুক্ত করবে না। যদিও মানবিক আবেদন তৈরি করায় এই কর্মসূচিগুলোর ভূমিকা আছে, তবুও কোনো রকম কোনো চাপ বা অস্বস্তি এই কর্মসূচিগুলো তৈরি করতে সক্ষম হবে না। পরীমনি মুক্ত হবেন তখন যখন এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা তৃপ্ত হবে। তারা স্থির করবে, আচ্ছা যথেষ্ট পরিমাণে শায়েস্তা করা হয়েছে। তাদের তৃপ্তি বোধই কেবল পরীমনির যন্ত্রণার অবসান ঘটাবে।

এই পরিস্থিতির মূল্যায়নটা এই কারণেই জরুরি। এই ঘটনায় কেবল পরীমনি একা নন, বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিক আজকে ক্ষমতাবানদের নৃশংসতার মুখে কতোটা অসহায়, তার একটা দৃষ্টান্ত মাত্র পরীমনি নামের এই নারী। পুরুষ কিংবা নারী, আদিবাসী কিংবা বাঙালি, হিন্দু কিংবা মুসলমান যেকোনো পরিচয়ের মানুষই যদি যথাযথ ক্ষমতাধরের প্রতিহিংসা জাগ্রত করেন, তাহলে তার জন্য একই পরিণাম, কিংবা হয়তো আরও ভয়াবহ পরিণাম অপেক্ষা করছে। প্রয়োজনে তারা পুরুষতান্ত্রিক ঘৃণ্য প্রচারণার আবহ তৈরি করে একদল দলদাসকে যেমন নামিয়ে দিতে পারে পরীমনিকে নিপীড়নের জনমত তৈরির চেষ্টায়, তেমনিভাবে নারীবাদী প্রচারণার আবহ তৈরি করেও তারা তাদেরই আরেকদল দলদাসকে নামিয়ে দিতে পারে ব্যরিস্টার মইনুল হোসেনকে শায়েস্তা করার অভিযানে।

উপনিবেশিক রাষ্ট্র, পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইত্যাদি সত্যিকারের পরিভাষা ব্যবহার করেই ক্ষমতাসম্পর্ককে বিমূর্ত করে ফেলা, আড়াল করা, নিষ্ঠুর নিপীড়ককে অদৃশ্য করাটা মোসাহেবদের কৌশলের অংশ। ফলে যারা পরীমনিরূপী বাংলাদেশের মুক্তি চান, তাদেরও পালটা দায় উপনিবেশিক, পুরুষতান্ত্রিক এই ক্ষমতাসম্পর্কে এই মুহূর্তে কে কীভাবে কোন কলকাঠি নাড়াচ্ছে, কীভাবে এমন অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জন্ম হচ্ছে যারা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সবগুলো হাতিয়ারকে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছেন একটা মানুষকে শায়েস্তা করতে, সেই বিষয়গুলোও তুলে ধরা। লেখক ও রাজনীতিবিদ। ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়