দীপক চৌধুরী: গত ২০ বছরে আফগান নারীরা রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, শিল্প, সংস্কৃতিসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে শুরু করেছিল। হঠাৎ সবকিছু যেনো ওলটপালট হয়ে গেলো। ৯০-এর দশকে তালেবানের নিষ্ঠুর-নিপীড়ক-অসহিষ্ণু শাসন, নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংসতার জন্য তারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়। এটাও মনে রাখা দরকার যে, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় ১ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। সমাজের এই অংশগুলোকে আবার ‘অন্ধকার’ যুগে ঠেলে নেওয়া যায় কী? এ প্রশ্নও উঠেছে। এএফপি ও রয়টার্সের খবরে দেখলাম, কাবুলের পতনের পর আফগানিস্তানে নারী ও কিশোরীদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আরও ১৮ দেশ। বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে এ উদ্বেগ জানানো হয়। একই সঙ্গে নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তালেবানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।
প্রকাশিত ওই যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আফগান নারী ও কিশোরীদের নিয়ে; তাদের শিক্ষা, চাকরি ও চলাচলের স্বাধীনতা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা আফগানিস্তানজুড়ে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ও কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আফগানিস্তানে অন্য সবার মতো আফগান নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের অধিকার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতন প্রতিরোধ করা দরকার। তাদের কণ্ঠ যাতে শোনা যায়, তা নিশ্চিত করতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবিক সহায়তা ও সমর্থন নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলো হলো আলবেনিয়া, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা, উত্তর মেসিডোনিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, প্যারাগুয়ে, সেনেগাল ও সুইজারল্যান্ড। একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে তারা কিন্তু বলেছে, ‘যেকোনো ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতন প্রতিরোধ করা দরকার।’
তালেবানদের সম্পর্কে আগাম কোনো কিছু বলা মুশকিল। কুড়ি বছরে তারা নিজেদের অনেক আধুনিক করেছে এমন কথা যারা বলে থাকেন- তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তারা দেশ চালাবে কীভাবে এটা ভেবেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ইতিমধ্যেই তালেবানরা তাদের মূল রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নড়বে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। গণতন্ত্রের তো প্রশ্নই আসে না।আফগানিস্তানের নাগরিকদের মধ্যে যরা দেশ ছাড়তে চাইছেন, তাদের বিমানবন্দরে যেতে বাধা দিচ্ছে তালেবান। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এমন ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা আশা করছে, যারা আফগানিস্তান ছাড়তে চাইছে, তাদের আর বাধা দেবে না তালেবান।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী উইন্ডি শারমেন বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পেরেছি, তালেবান প্রকাশ্যে যে ঘোষণা দিয়েছে এবং আমাদের সরকারকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। আফগানদের মধ্যে যারা দেশ ছাড়তে চাইছে, তাদের বিমানবন্দরে যেতে বাধা দিচ্ছে তালেবান।’ একটি ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আফগানদের দিনগুলো যাচ্ছে। দেখলাম একাধিক সিএনএন সাংবাদিক এর উপর তালেবানরা জঘন্যভাবে চড়াও হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বলেছে, আফগানিস্তানে সাংবাদিকদের ওপর তালেবান যে হামলা চালাচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে এবং সাংবাদিকদের মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠনটির পক্ষ থকে বলা হয়েছে, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে আফগানিস্তানে কাজ করেন, এমন চার সাংবাদিকের বাসায় তল্লাশি চালিয়েছেন তালেবানের সদস্যরা। যে চার সাংবাদিকের বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন জার্মানির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক। তালেবানের হাত থেকে বাঁচতে তারা লুকিয়ে রয়েছেন। এদিকে আফগানিস্তানের নানগাহার প্রদেশের রাজধানী জালালাবাদে বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহের সময় দুই সাংবাদিকের ওপর হামলা চালিয়েছে তালেবান। সিপিজে বলেছে, এই ঘটনার তদন্ত করছে তারা।
শেষ পর্যন্ত আমেরিকাই নতুন কোনো কৌশল নিয়ে আগায় কী না কেউ বলতে পারে না। কুড়ি বছরে মাঝখানে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনার মৃত্যু। ট্রিলিয়ন ডলার খরচ কি এতই সোজা কথা? যুক্তরাষ্ট্র কি মাথা থেকে সহজে ঝেড়ে ফেলবে? ইতিহাস কী বলে? ইরাক, লিবিয়া দুটি অসাধারণ শান্তিপূর্ণ ধনাঢ্য দেশ ধ্বংস করে দিয়ে তারা বলছিল, স্যরি, আমাদের গোয়েন্দা তথ্য ভুল ছিল। কেউ কোনো পাল্টা প্রশ্ন করেছে?
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :