শিরোনাম
◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট, ২০২১, ০৩:০০ রাত
আপডেট : ১৭ আগস্ট, ২০২১, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

প্রবীর বিকাশ সরকার: রংতুলি আর ক্যানভাসের সঙ্গে নেশা, পেশা আর প্যাশনের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধই ছিলেন না শিল্পী মুর্তজা বশীর, একজন বিরলপ্রজ কবি ও কথাসাহিত্যিকও ছিলেন তিনি

প্রবীর বিকাশ সরকার: ১৯৭৮ থেকে ৮৪ সাল পর্যন্ত আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সাধারণ ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। আমার সাবসিডিয়ারি ছিল সমাজবিজ্ঞান ও চারুকলা। চারুকলার ক্লাস হতো কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের একেবারে ওপরের তলায়। ৪তলা নাকি ৫তলা আজ আর স্মরণে নেই। সেখানেই ছিল চারুকলা বিভাগ এবং শ্রেণীকক্ষ।

সাধারণত দুপুরের পরে অপরাহ্নে ক্লাস হতো চারুকলার। যখন রোদ লাজুক হতে হতে টকটকে লাল রং ধরতো। সবুজ পাহাড়ের গাছাগাছালিতে বিছিয়ে দিতে লাল রেশমি আঁচল। ফাঁকা হয়ে যেত কলা অনুষদের ক্যাম্পাস। নিরিবিলি সুনসান নির্জনতা ক্রমশ তার শ্যামল ছায়া ছড়িয়ে দিতে থাকত রাস্তা, বারান্দা আর ক্যাফেটেরিয়ার প্রাঙ্গণ জুড়ে। মন কেমন করা একটা ঝিরঝিরে বাতাস উদাসীন করে তুলত। ঘরেফেরা বাসের জানালায় ক্লান্তিমাখা চোখের বিদায়ী ভাষা দূর থেকেও নজরে পড়ত। মৃদু হাতনাড়া চঞ্চল করে তুলত হৃদয়। নীল আকাশ জুড়ে তখন শান্ত বিকেলের মিহি সুর বাজতে শুরু করেছে।

ঠিক সময় দরজা খুলে বেঁটেখাটো গোলগাল মুখের ধীরস্থির মানুষটি ক্লাশে প্রবেশ করতেন। আমি বারান্দা থেকে এসে ক্লাসে ঢুকতাম। কোনো-কোনোদিন চোখ তুলে তাকাতেন। কোনো-কোনোদিন ভ্রুক্ষেপও করতেন না। অনুচ্চ কণ্ঠে তিনি বলে যেতেন শিল্পকলার ইতিহাস। সারা পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাস তাঁর জানা। পড়াতেন শিল্পতত্ত্ব অর্থাৎ থিওরি। আমাদের প্রাকটিকেল ক্লাশ ছিল না, মানে ছবি আঁকাআঁকির কাজ ছিল না। ও তো যারা অনার্স পড়ছেন, শিল্পী হবেন তাদের কাজ! আমরা গোটা ২০ ছেলেমেয়ে থিওরি পড়েই সন্তুষ্ট। কখনো তিনি চেয়ারে বসেছেন বলে আমি দেখিনি। টেবিলের ওপর বসে বা কোমর ঠেকিয়ে তাঁর প্রিয় ভঙ্গিমায় আমাদের শিক্ষা দিতেন। টুকটাক শিল্পকলার কথা জিজ্ঞেস করতেন। প্রিয় শিল্পীর নাম জিজ্ঞেস করতেন। একবার বলেছিলেন, ফ্যাশন কাকে বলে জানো তোমরা?

ফ্যাশনের আবার সংজ্ঞা আছে নাকি! যেটা ভালো লাগে আর অভিনব সেটাই তো ফ্যাশন। তাই নয় কি? সবাই চুপ। তারপর বললেন, গতকাল যেটা ছিল না, আজকে আছে সেটাই ফ্যাশন। ফ্যাশন আর প্যাশন খুব কাছাকাছি এবং পরস্পর নির্ভরশীল। কে কী বললো সেটা ফ্যাশন কেয়ার করে না। কারণ প্যাশনটা স্ট্রং বলে। তাঁর এহেন কথায় জ্ঞান ও দর্শনের গভীরতা ও ব্যাপ্তির কূল খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল আমাদের জন্য।

তিনি খুব একটা হাসতেন না। কিন্তু হাসলে ভালো লাগত। তাঁর সঙ্গে আমরা ঘুরে আসতাম সেই প্রাচীনকাল থেকে আধুনিকাল পর্যন্ত। মিশর, ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু, হরপ্পা, মৌর্য, গুপ্ত যুগের কলাবিদ্যা এবং সেইসময়কার ফ্যাশনের চিহ্ন তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। মাঝেমাঝে মোটা মোটা বড় বড় বই এনে ছবি দেখাতেন। আমরা বিস্ময়ভরা চোখে কালার ছবি দেখে তৃপ্তি লাভ করতাম। যখন পড়াতেন আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাস তখন গ্রীক, ইতালি ও ফ্রান্সের পুরনো দিনের কালারফুল লাইফ মানুষের আমাদেরকে বিমোহিত করত। এথেন্স, রোম, মিলান, ফ্লোরেন্স, প্যারিস ভ্রমণ করে আসতাম তাঁর সঙ্গে।

কীভাবে কখন যে একটি ঘণ্টা চলে যেত টেরই পেতাম না! ইউরোপের জাগরণ তথা রেনেসাঁর ইতিহাস যখন বলতেন মনে হতো, ভিঞ্চি, রাফায়েল, সেঁজান, যেন আশেপাশেই কোথাও আছেন, এখনই চলে আসবেন ক্লাসে। চলে আসবেন মেডোনারা তাদের শিশুকে নিয়ে কিংবা ওই বুঝি আসছেন দেয়াল থেকে নেমে মোনালিসা! কথা ও বলার এমন কৌশল তাঁর ছিল আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করত! কতকিছু যে জেনেছি তাঁর কাছ থেকে দুটি বছর। সহজে তাঁর ক্লাস ফাঁকি দিতাম না। অবশ্য কেউ কেউ এক প্রস্ত ঘুমিয়েও নিতেন! স্যার দেখেও কিছু বলতেন না। বললে পরে কথার মায়াজাল ছিঁড়ে যাবে। তাছাড়া এ তো আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অঙ্কের ক্লাস না। ঘনঘন বকাঝকা করতে হবে!

মুর্তজা বশীর স্যার শুধু যে শিল্পী ছিলেন, রংতুলি আর ক্যানভাসের সঙ্গে নেশা, পেশা আর প্যাশনের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তা কিন্তু নয়। একজন বিরলপ্রজ কবি ও কথাসাহিত্যিকও ছিলেন তিনি। হাউকাউ সাহিত্য তিনি চর্চা করতেন না। নিরিবিলি নিসর্গ আর মানব-প্যাশন, রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও আনকমন চরিত্র তাঁর লেখায় কাচের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠত।

এখনো মনে আছে যেদিন তাঁর উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন’ হাতে পেলাম। ছোট্ট আকৃতির মেদহীন উপন্যাসটি পড়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম! কলকাতায় পেয়িং গেস্ট হওয়া আর খ্রিস্টান মেয়েটির সঙ্গে তাঁর আনুরক্তি-বিষণ্ণ-সম্পর্ক কী অসাধারণ ভাষায় এঁকেছেন তিনি! কতবার যে পড়েছি জানি না। এরকম উপন্যাস বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাইনি। কী জানি ‘আলট্রামেরিন’ই কি আমাকে রোমান্টিক হতে প্রথম গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল কিনা। লেখক : রবীন্দ্রগবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়