এম আমির হোসেন : শোকের দিন আজ। আজকের দিনে বাঙালি কী হারিয়েছিল তা অনুভূত হবে যুগযুগ ধরে। আজকের দিনটি শুধু প্রাক্তন কোনো দলপ্রধানের মৃত্যুর দিন নয়, শুধু কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের নিহত হবার দিন নয়, হাজার বছর ধরে নিষ্পেষিত এক জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে সফলভাবে বাস্তবায়নকারীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিবস আজ। যে বাঙালি জাতি তার জন্মলগ্ন থেকে কখনও স্বাধীন ভূখণ্ড পায়নি, সে জাতি তাঁর নেতৃত্বে পেয়েছে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন এক রাষ্ট্র।
যদি এই উপমহাদেশের ইতিহাস ঘাঁটি, সেখানে দেখি অভিজাততন্ত্রের শাসনের ইতিহাস, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যতিক্রম। এই বাংলার ধূলি-হাওয়ায় বেড়ে-উঠা সাধারণ এক মুজিবুর কী-করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলো, স্বাধীন-সার্বভৌম এক রাষ্ট্রের জনক হলো তা সৃষ্টি করলো আরেক অনন্য ইতিহাস। এ যেন সাধারণতন্ত্র দ্বারা ক্ষমতার বলয় থেকে অভিজাততন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রতিস্থাপন। না, তিনি রোমান্টিক কোনো বিপ্লবী ছিলেন না, গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি আজীবন গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে, গণমুখী আকাক্সক্ষাকে বুকে ধারণ করে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অভীষ্ট লক্ষ্যে। তিনি সত্তরের নির্বাচন করে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। সেই ম্যান্ডেট হাতে নিয়ে তিনি জাতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার পথে। তিনি হঠাৎ আবির্ভূত কোনো নেতা ছিলেন না।
পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের কালরাতে তাঁর দুঃখজনক বিদায় না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বে নিপীড়িত মানুষের নেতা হতেন তিনি। আজ বিভ্রান্ত মুসলিম জাতি ক্রমাগত উগ্রতার চর্চা করে আত্মবিনাশ করে যাচ্ছে। তিনি বেঁচে থাকলে মুসলিম বিশ্বে হতে পারতেন সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী এক আইডল। বিভ্রান্ত মুসলিম তারুণ্যের স্বপ্নপুরুষ হতে পারতেন তিনি। বিশ্বে বাংলাদেশ হতো উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত।
তাঁর মতো নেতা নেই বলে বিশ্বের বহু জাতি এখনো স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। একজন শেখ মুজিব নেই বলে আজও কাশ্মির স্বাধীন হয়নি; আজও কুর্দিস্তান, বেলুচিস্তান, ফিলিস্তিন পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ। একজন শেখ মুজিব নেই বলে বিশ্বের বহু জাতি আজও ধুঁকে-ধুঁকে মরছে। এই উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে প্রকাণ্ড নেতা বলে যাঁরা বহুল প্রচারিত সেই দেশগুলোকে তাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন ধর্মের ভিত্তিতে, কৃত্রিম দাঙ্গা বাধিয়ে, ব্রিটিশ-রাজের তোষণ করে। স্বার্থের বাইরে খুব কমই ভাবতে পেরেছিলেন তাঁরা। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু এ দেশ সৃষ্টি করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক এক গণযুদ্ধের মাধ্যমে, ত্যাগের বিনিময়ে, জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে। এই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে একদিন বঙ্গবন্ধুই হবেন সর্বোচ্চ নেতার আসনে আসীন-এটি বলা মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
তিনি শুধু জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, ছিলেন কল্যাণ জাতীয়তাবাদী। উগ্র জাতীয়তাবাদ নয়; ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে ধারণ করা ইনক্লুসিভ জাতীয়তাবাদী ছিলেন। কোনো উগ্ররূপ না দিয়ে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে জাতীয়তাবাদী চেতনায় দেশ সৃষ্টির সাফল্য ইতিহাসে বিরল। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রী। ছিলেন সমাজতন্ত্রী চেতনাসমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক এক নেতা। বঙ্গবন্ধুর মতো প্রভাবক নেতা না থাকলে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ কোনোদিনও অসাম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’ হতো না; বরং আওয়ামী শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে ‘মুসলিম লীগ’ নামক জীর্ণ সাম্প্রদায়িক কোনো শাখায় পরিণত হতো; এবং ইতিহাসের সহস্র প্রবাহে হারিয়ে যেতো। নতুন দেশ সৃষ্টির স্বপ্ন হতো সুদূরপরাহত। প্রতিটি বাঙালির নেতা ছিলেন তিনি, ছিলেন সকল নিষ্পেষিত মানুষের প্রেরণা।
আজ সেই দিন, সেই নির্মম দিন, যেদিন সেই মহান পুরুষ, বঙ্গবন্ধু, সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির দিকনির্দেশক সেই নেতার সপরিবারের নিহত হবার দিন; কিছু বিপথগামী, বিভ্রান্ত কুচক্রীর হাতে ইতিহাস ধ্বংসের দিন। এই অপূরণীয় ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবার নয়, কোনোভাবেই নয়। কাঁদো, বাঙালি কাঁদো। লেখক : চিকিৎসক
আপনার মতামত লিখুন :