শিরোনাম
◈ অবশেষে মার্কিন সিনেটে সাড়ে ৯ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ পাস ◈ কক্সবাজারে ঈদ স্পেশাল ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল চলাচল বন্ধ ◈ ইউক্রেনকে এবার ব্রিটেননের ৬১৭ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ◈ থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ◈ জিবুতি উপকূলে অভিবাসীবাহী নৌকাডুবিতে ৩৩ জনের মৃত্যু ◈ লোডশেডিং ১০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, চাপ পড়ছে গ্রামে ◈ এফডিসিতে মারামারির ঘটনায় ডিপজল-মিশার দুঃখ প্রকাশ ◈ প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আয়ে ১৫.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ◈ প্রথম ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাত চেয়ারম্যানসহ ২৬ জন নির্বাচিত ◈ বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগ আহ্বান রাষ্ট্রপতির

প্রকাশিত : ১২ আগস্ট, ২০২১, ০৬:৫২ বিকাল
আপডেট : ১২ আগস্ট, ২০২১, ০৭:৩৬ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সম্পদ সৃষ্টির কৌশল মুসলমানদের জানা কেনো জরুরি

রাশিদ রিয়াজ : এক সময়ে সম্পদ সৃষ্টির জন্যে প্রধান তিনটি উপাদান ছিল অপরিহার্য। তা হচ্ছে পুঁজি বা মূলধন, শ্রম ও ভূমি বা জমি। এখন প্রযুক্তির বিকাশে এ তিনটি উপাদান ছাড়াও সম্পদ সৃষ্টি করা অনেকটা সহজ। এক্ষেত্রে জ্ঞান বা মেধার ব্যবহার প্রয়োজন। কোভিড মহামারির মধ্যেও গত বছর মার্কিন পরিবারগুলো সাড়ে ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ১৩ লাখ কোটি ডলার অর্জন করতে পেরেছে। তার মানে চরম অর্থনৈতিক মন্দা থাকলেও একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি তার নাগরিকদের সম্পদ অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ভর্তুকি বা ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার সুবিধা দিয়ে অভাবের মধ্যেও মার্কিন নাগরিকদের অর্থনৈতিক কষ্ট বুঝতে দেওয়া হয় না। বিশেষত ২০০৮ সালে মার্কিন পরিবারগুলো ৮ ট্রিলিয়ন ডলার হারানোর পর তাদের জন্যে অর্থনৈতিক সুরক্ষা কবচ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের আর্থসামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলো তাদের উদ্যোক্তাদের বিকাশের জন্যে সহজ শর্তে ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া যাতে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থান ঘটে এবং মানুষ আয় থেকে বঞ্চিত না হয়। এসব ক্ষেত্রে পুরোনো দিনের মূলধন, শ্রম, জমির ভূমিকার প্রাধান্য থাকে না। সহজ শর্তে বন্ধকী দিয়ে ঋণ সংগ্রহ করতে পেরেছে মার্কিনীরা। কোভিড মহামারির মধ্যে লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক বেকার হয়ে যাওয়ার পর তাদের বেকার ভাতা দিয়েও সাহায্য করা হয়েছে। এজন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয়া হলেও কার্যকর অর্থনৈতিক নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এ বিপুল পরিমান অর্থের যোগান অন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করে নিচ্ছে।

আবার কোভিড মহামারির সময় মার্কিন কোটিপতিরা সবচেয়ে বেশি দান খয়রাত করেছেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তারা অকাতরে যেমন ব্যয় করেছেন, প্রযুক্তি ও পুঁজির সংমিশ্রণে মেধা খাটিয়ে তারা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার আয়ও করেছেন। এটাই হচ্ছে সম্পদ সৃষ্টির কৌশল জানার রহস্য। এ কৌশল আয়ত্বে আনার ব্যাপারে বিশ্বের মুসলমানরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। অথচ মুসলিম দেশগুলোর কাছে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ পেট্রোলিয়াম, ৭৫ শতাংশ রবার, ৫০ শতাংশ ইউরেনিয়াম থাকলেও বাণিজ্য আছে মাত্র ১০ শতাংশ। সস্তা শ্রম রয়েছে সবচেয়ে বেশি মুসলিম দেশগুলোতে। কিন্তু সম্পদ সৃষ্টির কৌশল সঠিকভাবে জানা না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছে মুসলমানরা। এর মূল কারণ হচ্ছে কার্যকর অর্থনৈতিক নীতির অভাব।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে অর্থনীতিকে অনেক কঠিন ও জটিল মনে করে অনেকে এ নিয়ে আগ্রহ বিমুখ হয়ে থাকেন। কিন্তু কোরানে আল্লাহ বলেছেন, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমু‘আ, আয়াত : ১০) হজরত আদম (আ.) কৃষি কাজ করতেন। হজরত ইদরিস (আ.) সেলাই কাজ করতেন। হজরত দাউদ (আ.) লোহার বর্ম বানাতেন। আমাদের নবীজি (সা.)ও নিজে ব্যবসা করেছেন। ব্যবসাকে উপার্জনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম আখ্যা দেয়ার বড় কারণ এটাই যে, নবীজি (সা.) স্বয়ং নিজে ব্যবসা করেছেন। তিনি অন্য আরেকজনের সঙ্গে মিলে শেয়ারে ব্যাপক পরিসরে ব্যবসা করেছেন। মুদারাবা তথা ব্যবসার মাল আদান-প্রদান করে লাভ নির্দিষ্ট হারে বণ্টন করে নেয়া। এ ধরনের ব্যবসাও করেছেন। নবুওয়াত লাভ করার পূর্বে নবীজি (সা.) মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.)-এর সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসা করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) বলেন, আমি জাহেলিয়াতের যুগে নবীজির ব্যবসার শেয়ার ছিলাম। আমি যখন মদিনায় গেলাম তখন নবীজি (সা.) বললেন, আমাকে চিন? বললাম, কেন চিনব না? আপনি তো আমার অনেক ভালো ব্যবসার অংশীদার ছিলেন। না কোনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করতেন, না কোনো কিছুতে ঝগড়া করতেন!’ (খাসায়েসে কুবরা, উসদুল গাবাহ)

উপার্জনের অনেক রকম পদ্ধতি আছে। বৈধ পন্থায় রিজিক অনুসন্ধান করাকে উত্তম বলেছেন মহান আল্লাহ। হালাল উপার্জনের যতগুলো পন্থা আছে, তন্মধ্যে রাসূল (সা.) শ্রমলব্ধ ও ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত আয়কে সর্বোত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু কোন একজন মুসলমান যখন মিথ্যা ও খেয়ানতের আশ্রয় না নিয়ে পূর্ণ সততা সহকারে সৎ উদ্দেশ্যে ব্যবসা করে, তখন তার এ ব্যবসা একটি পবিত্র ইবাদতে পরিণত হয়। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ফরজ ইবাদতসমূহের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।’ এসব অকাট্য দলিল জানার পর অর্থনীতি সম্পর্কে বিমুখ থাকা মুসলমানদের মোটেও উচিত নয়।

অধিকাংশ মুসলিম দেশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরাশক্তি দেশগুলোর বিভিন্ন শর্ত আরোপ থাকে যে কারণে স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। এসব দেশের অর্থনীতি অন্যদেশের অর্থনীতির পরিপূরক অর্থনীতি হিসেবে কাজ করে। যে কারণে অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা যায় না। অথচ এধরনের ইনস্টিটিউশন থাকলে স্বাধীনভাবে, আইনের শাসনের কল্যাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীমুলক চুক্তির পবিত্রতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। আবার ইনস্টিটিউশন থাকলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে সেগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। অন্তত ৭০ বছর আগে প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের শর্ত হিসেবে যে অর্থনৈতিক মডেলে মূলধন, শ্রম ও জমি উপাদান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট ছকে ফেলা হত তা পাল্টে দেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট মার্টন সোলো। তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তত্ত্বে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তত্ত্বগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮৭ অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। রবার্ট সোলো শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নের গুরুত্বের উপর জোর দেন। পণ্য এবং পরিষেবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যার মধ্যে আর্থিক প্রবাহও রয়েছে এসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তিনি তুলে ধরেন। কিন্তু মুসলিম দেশ বা মুসলমানদের মধ্যে এখনো এধরনের নতুন তত্ত্ব অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। এখনো সঞ্চয়, মূলধন, জমি বা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল আমদানিকৃত পণ্য ও সেবাকে রপ্তানিতে রুপান্তর করার সনাতনী ব্যবস্থায় পড়ে আছে মুসলিম দেশুগুলো। কিংবা খনিজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রপ্তানি আয়কে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে যেখনো মূল্য সংযোজন কাঙ্খিত আকারে ঘটছে না। অথচ ২শ বছর আগে অ্যাডাম স্মিথ যে ধারণা দিয়ে যান তারই আলোকে আশির দশকে অর্থনীতিবিদরা এমন কিছু উদ্যোগ নেন যা মার্টন সোলোর চোখে উল্লেখযোগ্য হয়ে ধরা পড়ে। এর একটি হচ্ছে কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো। যদি আইনের শাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারী কোনো দেশে কেনো বিনিয়োগ করতে নিরাপত্তা বোধ করবেন? বিনিয়োগকারী তা না করলে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না। সম্পদ সৃষ্টির কৌশল তো দূরের কথা। তাই অর্থ পাচার হতে থাকে অন্য দেশে। কারণ বিনিয়োগকারী তার মূলধনকে ধরে রাখতে চান না। তিনি তা খাটাতে চাইলে যখন আইনের শাসনের অভাবে তার সম্পদ বেআইনিভাবে জব্দ হয়ে যায় বা ব্যবসা করতে যেয়ে হাজারো লুক্কায়িত ঝুট ঝামেলায় পড়েন তখন তিনি এক পর্যায়ে ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েন। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই কর্মসংস্থানের স্বপ্নে বিভোর থাকতে পারেন না। তিনি তখন ভাবতে থাকেন কিভাবে একটি ব্যবসা সফল হতে পারে যদি বিদ্যমান প্রবিধান, নীতি ও স্বাধীনতার অভাব ব্যবসার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি ব্যাপক হলে অর্থনীতি কীভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে - আপনি যে কোন আইনি কাজ করতে চাইলে কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হবে না এর নিশ্চয়তার প্রয়োজন পড়ে। এসব ক্ষেত্রে সম্পদ সৃষ্টির কৌশলের আগে বরং কাঠামোগত সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ে।

সম্পদ সৃষ্টির কৌশলে আরেক বাধা হচ্ছে মুসলিমদেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত মজবুত নয়। মূলধন পড়ে থাকা সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলো একে অপরে বড় ধরনের বিনিয়োগে যেতে ব্যর্থ হচ্ছে। একারণে মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। প্রযুক্তি ও গবেষণার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। ফলে অভ্যন্তরীণভাবে বিনিয়োগ দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। রয়েছে অর্থনৈতিক কূটনীতির বিরাট অভাব। পারস্পরিক আস্থার সংকটও রয়েছে প্রকট। মুসলিম দেশগুলোর এধরনের সমস্যা নিরসনে ওআইসি’র মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কাজই করছে না। অথচ এধরনের প্রতিষ্ঠান মুসলিমদেশগুলোতে ব্যক্তি অধিকার, স্বতন্ত্র ব্যক্তি, সমাজ ও সংগঠনের সদস্যদের উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করলে সম্পদ সৃষ্টির কৌশল নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠত মুসলমানরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়