হাসান তাকী : কঠোর লকডাউনেও মানুষের আচরণের পরিবর্তন হয়নি। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, মাস্ক পরেনি। এ কারণে কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নেই। একটি আইসিইউ বেডের জন্য এখনই ৪০ জন গুরুতর করোনা রোগীকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তার ওপর এবার চলমান কঠোর লকডাউন শিথিল করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সরকার। এতে আগামী ১১ আগস্ট থেকে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ সবকিছু খোলা থাকবে। কিন্তু গণপরিবহন, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচলে প্রজ্ঞাপনে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। যাত্রী থাকবে সব আসনেই তবে বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলবে অর্ধেক।
এমন অবস্থায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে সামনের দিনগুলোতে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন শিথিল করায় আগামীতে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়তে পারে। সরকারের এমন নির্দেশনায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সব কিছু খোলা রেখে অর্ধেক পরিবহন সড়কে নামানো হলে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। একইসঙ্গে সড়ক, ট্রেন ও নৌপথে যাত্রীর চাপ বাড়বে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি হুমকিতে পড়বে। এতে কঠোর লকডাউন শিথিল করায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ রোগী শনাক্তের পর থেকে বেশ কয়েকবার কঠোর লকডাউন দেয় সরকার। এতে সব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। আবার কঠোর লকডাউন শিথিল করে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে গণপরিবহন চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র। গণপরিবহন অর্ধেক চলবে আর সব আসনেই যাত্রী বসবেন আগের ভাড়ায়। এতে সড়কে গাড়ি কমে যাবে, সড়কে তৈরি হবে ভিড়, গাড়িতে গাদাগাদি করে চলতে হতে পারে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, চলমান লকডাউন যেমনই হোক, সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। তবে ঠিকমতো লকডাউন বাস্তবায়িত হলে করোনা সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসত। এখন শনাক্তের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে।
তিনি বলেন, এখন ব্যাপকভিত্তিক টিকা দিতে হবে। একই সঙ্গে সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শনাক্তের হার ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত মুখে মাস্ক পরতেই হবে। লকডাউন শিথিল হলেও এখনো জনসমাবেশ ও পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। রেস্টুরেন্টে অর্ধেক সিট ফাঁকা রাখতে হবে।
সড়কে অর্ধেক গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনার বিষয়ে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, স্বাভাবিক সময়ে রাজধানীতে গণপরিবহন সংকটে চাকরিজীবী মানুষ সড়কে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানে করোনা সংক্রমণের মধ্যেই সব অফিস খোলা রেখে অর্ধেক গণপরিবহন চালানোর নির্দেশনা দেয়া মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে সড়কে মানুষের ভিড় বাড়বে এবং করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে আগামী ২৫ আগস্টের মধ্যেই করোনার ঊর্ধ্বমুখী রূপ মানুষ দেখতে পাবে। এতে সংক্রমণ বেড়ে হাসপাতালে রোগীদের চাপ সামাল দেয়া চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
কঠোর লকডাউন শিথিল করে রোববার (০৮ আগস্ট) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যখন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় তখনও দেশে ১০ হাজারের বেশি করোনা শনাক্ত আর মৃত্যু ২৪১ জন। এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই অর্ধেক গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েতউল্লাহ এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সড়কে অর্ধেক গণপরিবহন চালু হলে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়বে পাশাপাশি গাড়িতে ভিড়ও বাড়বে। নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা কষ্টকর হবে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘সরকার অর্ধেক গণপরিবহন চালানোর যে নির্দেশনা দিয়েছে এতে যাত্রীরা গাদাগাদি করে বসবেন। করোনা মহামারির সময়ে সরকারের এই নির্দেশনা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি ক্ষতিকর। সব অফিস খুলে দেয়া হলে অফিসমুখী মানুষের চাপ বাড়বে। অর্ধেক বাস চললে স্বাস্থ্যবিধিতে উদাসীনতার সঙ্গে সঙ্গে ভোগান্তিও বাড়াবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমাতে কোনো ভিড় যেন তৈরি না হয়, কিন্তু অর্ধেক পরিবহন চললে তো ভিড় তৈরি হবে। এটি জনস্বস্থ্যের আরও ক্ষতি হবে। এই প্রজ্ঞাপন গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোর চেয়ে মন্দ-ই বেশি হবে। এজন্য প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গিতপূর্ণ গণপরিবহন চালু রাখতে হবে। সব লোক অফিসে গেলে সব গণপরিবহন চালু রাখা দরকার।’
করোনা সংক্রমণ কমাতে স্বাস্থ্যবিভাগের কাজে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এই অব্যবস্থাপনা গত দেড় বছরেও স্বাস্থ্যবিভাগ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এরমধ্যে ফের অর্ধেক গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা দেয়ায় ভিড় বেড়ে যাবে, ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। লকডাউন দেওয়ায় সংক্রমণ কিছুটা কমবে। তবে লকডাউন পুরোপুরি কার্যকর হলে সংক্রমণ আরও কমত। এখন জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা এবং সবাইকে টিকার আওতায় আনা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, যেহেতু লকডাউন ১১ আগস্ট শেষ হচ্ছে। তাই সংক্রমণ রোধ করতে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। আর ব্যাপক হারে গণটিকা দিতে হবে। তিনি বলেন, দিনের পর দিন লকডাউন দিয়ে রাখা যায় না। দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। তাই লকডাউন শিথিল হলেও সবাইকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
সবকিছু খোলা রেখে অর্ধেক গণপরিবহন চালানোর কারণে করোনা আক্রান্তে মানুষের মৃত্যু আরও বাড়তে পারে কিনা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এর সঙ্গে ফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :