শিরোনাম
◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী  ◈ সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম নালিশের রাজনীতি করছে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের ◈ বুশরা বিবিকে ‘টয়লেট ক্লিনার’ মেশানো খাবার খাওয়ানোর অভিযোগ ইমরানের ◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী

প্রকাশিত : ০২ আগস্ট, ২০২১, ০৪:৩০ দুপুর
আপডেট : ০২ আগস্ট, ২০২১, ০৭:১৬ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

টাকা মানুষকে নির্ভরতা দেয় যা চিরন্তন নয়

রাশিদ রিয়াজ : ‘জেনে রেখো, তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। (এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে) তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে মহাপুরস্কার রয়েছে। (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৮)

আল্লাহ বলেন, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন রাখে; যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। এটি সংগত নয়; শিগগিরই তোমরা তা জানতে পারবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৩)

নিঃসন্দেহে টাকা মানুষকে এমন এক নিশ্চয়তা দেয় যা তাকে প্রবল সাহসী করে তোলে। অনেক সময় টাকার প্রভাবে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সে মনে করে আইন, শৃঙ্খলা, ন্যায়, নীতি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতার আর কি প্রয়োজন বরং এসব নীতি নৈতিকতা তাকে কেন্দ্র করেই যেন আবর্তিত হচ্ছে। সে যা চায় তাই হয়। এমন এক অনুভব তার আচরণকে বিপদজনক করে তোলে। এমনকি পরিবারের সদস্য ও তার আপনজনের চাহিদা তার কাছে একপর্যায়ে সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। অথচ সে মনে করে টাকা আছে আর তাই যা খুশি তাই করতে পারে। এই অহংবোধ তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখান থেকে তার আর কোনো ফিরে আসার পথ থাকে না। এক পর্যায়ে সেও তার চারপাশের মানুষের চাহিদা পূরণের যন্ত্র হয়ে ওঠে। এতে ঘাটতি সৃষ্টি হলেই সে চূড়ান্ত বিপদ টের পায়। তখন তার আর কিছুই করার থাকে না। কারণ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সবকিছুই আমাদের জানা ও অজানা। যে ভবিতব্য অজানা তার পরিণতি আমাদের সবাইকে ভোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা যাতে সীমারেখা লঙ্ঘন না করি সেজন্যে সম্পদ ও সন্তানের ভালোবাসার পাশাপাশি আল্লাহর আনুগত্য আমাদের ‘সার্কিট ব্রেকার বা রোড ডিভাইডার’ এর মত কাজ করে। যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন তারা জানেন কোনো কোম্পানির শেয়ারমূল্য যদি যুক্তিসঙ্গত হওয়ার চেয়ে ম্যানুপুলেটেড হয়ে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি ঘটে তখন বিনিয়োগকারীদের লোকসান থেকে বাঁচাতে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সেই কোম্পানির লেনদেনে নির্দিষ্ট মাত্রা টেনে সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করে। আবার রোড ডিভাইডার দেখেশুনে কোনো চালক তার গাড়ি সাবধানে চালায়, ধীরগতি অবলম্বন করে যাতে সামনেই কোনো হাটবাজার, স্কুল বা চৌরাস্তার সমাগমে অধিক গতি যেনো কোনো দুর্ঘটনা না ঘটায়। সম্পদ বলেন আর সন্তান বলেন এসবের প্রতি মোহ বা ভালোবাসা যদি মানুষকে অন্যায়-অসত্যের পথে নিয়ে যায়, তবেই তা পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একারণে সুরা আনফালের ২৮ নম্বর আয়াতে সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির চেয়েও আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশ-নিষেধকে অধিক প্রাধান্য দেওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঈমানি দায়িত্ব পালন এখানে মুখ্য, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রতি আামদের সবিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

কারণ সংঘাতময় এ পৃথিবীতে সংঘাতের অন্যতম কারণ হলো প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা ও বিত্তবিলাস। যেকোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন ও অঢেল সম্পদের স্বপ্নবিলাস মানুষকে দানব করে তোলে। নিজের সুখ ও সম্পদের আশায় অন্যের বৈধ অধিকার সে ছিনিয়ে নিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ন্যায় নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে সে ঘুষ, দুর্নীতির প্রাণান্ত প্রয়াস চালায়। এখানেই শুরু হয় ধনী-গরিবের লড়াই। শ্রেণিবৈষম্য বছরে পর বছর চলতে চলতে তা আসমান-জমিন পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ক্ষুধার্ত, পীড়িত ও নিপীড়িতের গগনবিদারী হাহাকার, অন্যদিকে বিলাসিতা, মাদকতা ও নর্তকীর চরম উপভোগ্য নৃত্যধ্বনির ঝংকার। পাঁচতারা হোটেলের পাশের রাস্তায় নদী সিকস্তি পরিবারের কেউ ফুটপাতেও রাত কাটাতে পারে না। বস্তির ঝুপড়িতেও থাকার ভাড়া নেই তার। অথচ এক সময় তার ঘর বাড়ি জমি জিরাত সবই ছিল। জীবনের সীমাহীন প্রয়োজন পূরণে সম্পদ বা অর্থের যে বাধ্যবাধকতা আছে, ইসলাম কিছুতেই তা অস্বীকার করে না। তাই বলে পরকালের অনন্ত অসীম জীবনের কথা ভুলে গিয়ে কেবল দুনিয়া নিয়েই ব্যস্ত আর তাকেই আখেরী নিশানা বানিয়ে রাখতে ধর্ম নিষেধ করে।

নিঃসন্তান ব্যক্তি বোঝেন সন্তান আল্লাহর কত বড় নেয়ামত। আবার কারো মাদকাসক্ত সন্তান পরিবারটিকে আর সবার চোখের সামনে কিভাবে ধংসের প্রান্তসীমায় নিয়ে যান তাও আমরা দেখি। কিন্তু টাকা বলুন আর অর্থ সম্পদ বলুন তা আমাদের চোখে অনেক সময় ঠুলি পড়িয়ে দেয়। আমরা সজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কারণ অর্থ ব্যক্তিকে একধরনের স্বায়ত্তশাসন বা নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেয়। এমনকি সেঅন্যকে সহজেই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা লাভ করে। এধরনের ধনীরা আত্মমুগ্ধতায় ভোগে। সবাই তাকে তেল দিয়ে চলে। চাটুকারিতার বৃত্তে সে বন্দী হয়ে পড়ে হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য হয়ে পড়ে। সে মনে করে যে তারা গড় ব্যক্তির চেয়ে বেশি সক্ষম এবং দক্ষ। তারা মনে করে অন্যকে সে সহজেই উপলব্ধি করতে পারে, চিনতে পারে বা বুঝতে পারে। কিন্তু ধনী ব্যক্তি হওয়ার কারণে অন্যরা যে তার সঙ্গে ভান ধরে বিশেষ আচরণ করে তা অনেক সময় ধনী ব্যক্তি বুঝতে ব্যর্থ হয়। দুজনের আচরণ, লেনদেন দুজনের সঙ্গে কৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। অভিনয় হয়ে দাঁড়ায়। মজার কথা হচ্ছে অর্থ সম্পদ দুজনের ব্যক্তিত্বেই পরিবর্তন আনে। অভাবের সময়, সংকটের সময় তা আরো প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। তারা তাদের শিক্ষা, তাদের পেশাগত অবস্থান, সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণ, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব যা কিছু আছে তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে শুরু করে টাকা। আপনার কাছে টাকা আছে বা নেই, সেটি বড় কথা নয়, কথা হচ্ছে অর্থের প্রভাব থেকে দূরে থাকা কঠিন। অর্থ নাটকীয়ভাবে আমাদের চারপাশ পর্যন্ত পরিবর্তন করে তার মানে আমরা কীভাবে বিশ্বকে দেখি। মানুষ তার অর্থ দিয়ে সমাজে কী করে, বা অর্থই ব্যক্তির অবস্থানকে কিভাবে পরিবর্তন করে তার চিন্তাধারাকে কলুষিত বা উন্নত করে যা এক স্থায়ী সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ধনীর অর্থ বৈভব সামাজিক চাহিদাও তৈরি করে। ধরুন কোনো গ্রামে যখন কোনো আসবাব ছিল না তখন সেখানকার মানুষ মাটিতে মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে বা টুলে অথবা পিড়িতে বসে ভাত খেত। একদিন ওই গ্রামের কোনো এক ঘরে একটি চেয়ার এল। ব্যস চেয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গাছ কেটে কাঠ স’মিলে নেওয়া শুরু হল। অমুকের ঘরে চেয়ার আছে, সোফা সেট আছে আমার ঘরে নেই, মানুষ এধরনের অভাব বোধ করতে শুরু করল।

আবার সম্পদ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর এমনকি অনৈতিক করে তোলে। টাকা মানে তার কাছে যা কিছু করার লাইসেন্স। কারণ সে টাকার মালিক নিজেকে ভাবতে শুরু করে। সুতরাং তার ইচ্ছাই চূড়ান্ত হয়ে দাঁড়ায় তার সম্পদ ব্যবহারে। ধনী ব্যক্তিরা ধনসম্পদকে একটি ভালো জিনিস হিসেবে যুক্তিযুক্ত করে তোলে এবং মনে করে তার সৃষ্টিই হয়েছে সমাজে অভিজাত শ্রেণী হিসেবে এবং তার সম্পদে যে অন্যের শ্রম ও ঘাম বা অধিকার জড়িয়ে আছে তা সে থোরাই কেয়ার করে বরং ভাবে এটা তারই নৈপুণ্য, সে যেনো জন্মেছে সমাজে এক বিশেষাধিকার নিয়ে। আদতে সে ততক্ষণে নিজের খেয়াল খুশির দাস বনে গেছে।
এখন কেউ যদি কেউ ধনী না হয়, ধনী ব্যক্তিরা যুক্তি দেখান তাদের প্রতিভা নেই বা তার মত একই স্তরে পৌঁছানোর মেধার অভাব রয়েছে। কিন্তু সে যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ সন্ধানী সে কথা ঘুণাক্ষরে টের পেতে দেন না। যেসব রাজনীতিবিদ নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইন প্রণয়নের প্রবণতা দেখান না বা তা অনুসরণ করেন না এদের সঙ্গে সমাজের উুঁচুতলায় ধনীদের একই সঙ্গে বসবাস। তারা মনে করেন কঠিন পরিশ্রম করেই তারা অর্থ উপার্জন করেন আসলে অর্থ তাদের এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে নিকেশ করে ফেলে। কারণ সে তার নিজের লক্ষ্যে মনোনিবেশ করার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ভাবে। কারো পরোয়া সে করে না।

যারা অর্থকষ্টে ভোগেন বিপরীতভাবে, তারা ধনীদের চেয়ে পরিবেশের উপর কম নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং অন্যদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল এবং উদার হতে দেখা যায়। এর কারণ সম্পদের অভাবে তাদের একে অপরের উপর নির্ভর হতে হয় তবেই তারা চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। নিজেদের বৃহত্তর উদ্বেগের কথা ভেবে দরিদ্ররা তাদের সম্পদের একটি বড় অংশ দাতব্য কাজে দেয়। ধনীরাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেও তাদের দানের আকার বিশাল হয়। তবে গরিবদের উদ্বেগ নিরন্তর তাদের মানবসম্পদ গ্রাস করে এবং তারা প্রযুক্তি ও পুঁজির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে উদ্যোক্তাদের বিকাশ করতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু গরিব মানুষ এমন এক আয়ের স্তরে জন্ম গ্রহণ করে যার হাতে কোনো সময় একগুচ্ছ দক্ষতা কখনোই থাকে না। এক্ষেত্রে টাকাওয়ালাদের মস্তিষ্ক খুব সহজেই অন্যান্য বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারে। সে তার সম্পদ নিয়ে যখন রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে যায় তখন তা গরিবদের জন্য বরং আরো ক্রমবর্ধমানভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে। গরিবরা তাই সমাজে টিকে থাকতে হিমশিম খায় এবং ধনীরা অবলীলায় সমাজে বাস করে। ধনীরা বলেন তারাই নাকি সম্পদের জন্ম দিয়ে থাকেন। কার্যত গরিবদের অভাবই প্রকৃত চাহিদা তৈরি করে ধনীদের আরো ধনী হতে সাহায্য করে। সম্পদের অভাবে একপর্যায়ে গরিব যখন নিজেকে অসমর্থ ভাবতে ভাবতে অক্ষম মনে করেন তখন ধনীরা ভেঙে পড়েন না। সে কেবল আরও সচেতন হয় পাছে তার সম্পদহানি না ঘটে। কিন্তু দুষ্টচক্রের সঙ্গে পক্ষপাত হবার প্রবণতা, নৈতিক শক্তির অভাব ধনীদেরকেও কাহিল করে তোলে। কোরআন একারণেই অর্থ উপার্জনের পথে মানুষকে সাহায্য করতে উৎসাহিত করে। মানুষের সামনে সম্পদ বিলিয়ে দাঁড়িয়ে অক্ষমের মনে আশা সৃষ্টির তাগিদ দেয়। এ মানবিকতা গরিবদের অনিবার্যভাবে ক্ষমতায় নিয়ে যায়। এভাবে একটি সুন্দর সমাজও গড়ে উঠতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়