শিরোনাম
◈ ঝালকাঠিতে ট্রাকচাপায় নিহতদের ৬ জন একই পরিবারের ◈ গাজীপুরের টঙ্গি বাজারে আলুর গুদামে আগুন ◈ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনোয়ারুল হক মারা গেছেন ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শনিবার ঢাকা আসছেন ◈ দুই এক পশলা বৃষ্টি হলেও তাপদাহ আরো তীব্র হতে পারে  ◈ এথেন্স সম্মেলন: দায়িত্বশীল ও টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত প্রয়াসের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ◈ কেএনএফ চাইলে আবারও আলোচনায় বসার সুযোগ দেওয়া হবে: র‌্যাবের ডিজি ◈ ওবায়দুল কাদেরের হৃদয় দুর্বল, তাই বেশি অবান্তর কথা বলেন: রিজভী ◈ মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী ◈ বাংলাদেশ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে: অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত : ৩০ জুলাই, ২০২১, ০৩:২৫ রাত
আপডেট : ৩০ জুলাই, ২০২১, ০৩:২৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. সেলিম জাহান: ‘যদি মন কাঁদে’- সন্তানদের নির্দ্বিধায় ও নির্বিবাদে কান্নার স্বাধীনতা দিন!

ড. সেলিম জাহান: ‘গেলো, গেলো, গিলে ফ্যালো’, বেশ জোর গলা শোনা গেলো। বোঝা গেলো, এক মা তাঁর শিশুশন্তানটিকে ধমকাচ্ছেন। মনে হতে পারে, মা’টি শিশুটিকে ওষুধ গিলতে বলছেন। কিংবা তাঁর সন্তানটি আর পাঁচটি বাচ্চার মতো খাবার মুখে নিয়ে বসে আছে, গিলছে না। তাকিয়ে দেখি, শিশুটি বোরুদ্যমান, তার গাল লাল, ঠোঁট ফোলাÑ প্রাণপণে কান্না চাপছে সে মার ধনকে। বোঝা গেলো, ‘গেলো, গিলে ফ্যালো’ কোনো ওষুধের বা খাবারের ব্যাপার নয়। মা তার সন্তানটিকে কান্না গিলে ফেলতে বলছেন।

আসলে কান্নার ক্ষেত্রে এ কোনো নতুন দৃশ্য নয়, অহরহ দেখেছি এটা। বাড়িতে, রাস্তায়, ইস্কুলে। এমন ক্ষেত্রে অনেক সময়ে লক্ষ্য করেছি যে যাদের বলা হচ্ছে, তারা দৌড়ে বাথরুমে ঢোকে এবং তাদের হৃদয়ের কান্না উগরে দেয়। আমরা বড় হয়ে গেলেও ওই বাথরুমই রয়ে যায় আমাদের ক্রন্দনের জায়গা। আমার লোকের অলক্ষ্যে কাঁদার জন্যই কাঁদতে হলে লুকোও এমন জায়গায়, যেখানে কেউ তোমাকে দেখবে না, কেউ তোমার কান্নার শব্দ শুনবে না। তোমার কান্না লজ্জা তোমারই থাক।

আসলে ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়, সবার সামনে হাসতে পারো, কিন্তু জনসমক্ষে কাঁদতে পারবে না। মানুষকে হাসি দেখাতে পারো, কিন্তু কান্না- নবৈ নবৈ চ। আমার মনে হয়, হাসি ও আনন্দকে সমার্থক করা হয় শক্তির সঙ্গে, দুঃখ ও কান্নাকে দেখা হয় দুর্বলতা হিসেবে। মানুষ তার শক্তিকে প্রকাশ করুক, সেটা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু দুর্বলতা যেন কোনোভাবেই প্রকাশ না পায়। ‘হাসলে মানুষকে সুন্দর দেখায় আর কাঁদলে মানুষ কদর্য লাগে,’ এমন একটা ধারণাও আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে হাসি আদৃত, কান্না পরিত্যাজ্য। হাসি-আনন্দ আর কান্না-দুঃখ মানুষের জীবনের এ-পিঠ, ও-পিঠ। তাহলে হাসিকে কেন দেখানো যাবে, আর কান্নাকে কেন লুকিয়ে রাখতে হবে? আমাদের সবাইকে শেখানো হয়েছে যে, কান্না দুর্বলতার লক্ষণ আর দুর্বলতা অন্য কাউকে দেখাতে নেই।আমরা অন্যের সামনে আবির্ভূত হতে চাই শক্তিমান হিসেবে, দুর্বল হিসেবে নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের অস্তিত্বের একটা দিকই কেন আমরা অন্যকে দেখাবো? একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষ তার শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে। সুতরাং তার ভঙ্গুরতা লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে কি? হাসি নয়, কান্নাই হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সহমর্মিতার ভাষা। তাহলে অন্যের উপস্হিতিতে কাঁদলে অসুবিধে কী? আমাদের সন্তানদের কেন শেখাতে হবে যে কান্না মানেই দুর্বলতা, কাঁদতে হলে লোকের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে হবে? হাসি মানে যৌথতা, আর কান্না মানেই একাকীত্ব? কেন? তাছাড়া সব হাসিই সুন্দর নয়, বহু হাসির কদর্যতা আমরা প্রায়শই দেখি। তেমনি, কান্না কেন অসুন্দর হবে, যেখানে বহু ক্রন্দনের সৌন্দর্য্য আমাদের চোখে পড়ে এখানে-ওখানে।

হাসি কান্না সম্পর্কে দুটো কথা প্রায়ই শোনা যায়Ñ একটি মেয়েদের ব্যাপারে, আর একটি ছেলেদের প্রেক্ষিতে। সামাজিক অনুশাসনের ফলে মেয়েদের জোরে হাসা একদম নিষেধ। সংসারে মেয়েদের হাসির দমক একটু উঁচু পর্দায় উঠলেই শোনা যায় তর্জনী সংকেতÑ ‘এই আস্তে, আস্তে’। মেয়েদের উচ্ছ্বাস-দেখানো, আনন্দ-প্রকাশের বিরুদ্ধে আছে বহু বাধা- নিষেধ। কিন্তু মেয়েদের দুঃখপ্রকাশে, উচ্চস্বরে কান্নায় কোনো বাধা নেই। যেন ওটাই প্রত্যাশিত।

অন্যদিকে ‘ছেলেরা কাঁদতে নেই’ এমন একটা অনুশাসন তৈরি করে সমাজ ছেলেদের স্বাভাবিক একটি মানবিক অভিব্যক্তি প্রকাশে বাধা দিচ্ছে, তাদর বশ কিছু সুকুমার বৃত্তিকে নষ্ট করছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বহু মানবিক বোধ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটের আরেকটি মাত্রিকতা কিন্তু আছে। এর ফলে সমাজ যেন বলেই দিচ্ছে যে ছেলেরা শক্তিবান আর মেয়েরা দুর্বল।

আমার এক বন্ধুর কথা বলি। তাঁর ছেলেমেয়েরা যখন ছোট, তখন তাদের ব্যাপারে বন্ধুটির ব্যবহার খুব দাগ কেটেছিল আমার মনে। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষ তাঁর সন্তানেরা যখন বোরুদ্যমান অবস্থায় তার সামনে এসে দাঁড়াত, তখন তাদের লাল গাল, ঠোঁট ফোলানো, টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু নরম করে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী, কান্না পাচ্ছে?’ তাঁদের সম্মতিসূচক মাথা দোলানো দেখে তিনি মৃদুস্বরে শুধু বলতেন, ‘আচ্ছা, কেঁদে ফেলো’। অনুমতি পেয়ে উচ্চস্বরে ফুঁপিয়ে উঠত তারা, গালে নামত জলধারা। একসময় তিনি তাদের বুকের মাঝে চেপে ধরতেন, কপালে চুমু দিতেন। তারা শান্ত হলে তবেই অন্যান্য কথাবার্তা শুরু হতো। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, সন্তানদের নির্দ্বিধায় ও নির্বিবাদে কান্নার স্বাধীনতা দিয়ে আমার বন্ধুটি উপর্যুক্ত বিষয়গুলোকে মুক্তি দিয়েছিলেন। লেখক : অর্থনীতিবিদ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়