শিরোনাম
◈ যুক্তরাষ্ট্র সরে এলে বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে কে: বাইডেন ◈ মিয়ানমার সেনাসহ ২৮৮ জনকে ফেরত পাঠালো বিজিবি ◈ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বিএনপির ৬৪ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ◈ বর্ধিত ভাড়ায় ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু ◈ বাড়ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি ◈ মা হিসেবে পূর্ণ অভিভাবকত্ব পেয়ে দেশের ইতিহাসে নাম লেখালেন অভিনেত্রী বাঁধন ◈ আরও তিন মামলায় জামিন পেলেন মামুনুল হক ◈ সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯ ◈ তাপপ্রবাহে উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিশুরা,  বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ ইউনিসেফের ◈ মন্ত্রী ও এমপিদের নিকটাত্মীয়রা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ওবায়দুল কাদের 

প্রকাশিত : ২৮ জুলাই, ২০২১, ০৪:৩৮ সকাল
আপডেট : ২৮ জুলাই, ২০২১, ০৪:৩৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস : কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): বাংলাদেশে লিভারের খারাপ রোগগুলো অর্থাৎ লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের প্রধান কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এদেশে সত্তর ভাগেরও বেশি লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী হচ্ছে এ দুটি ভাইরাস। তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি আবার এক ডিগ্রি এগিয়ে। এ ভাইরাসটি একাই ষাট শতাংশের বেশি লিভার সিরোসিস আর লিভার ক্যান্সার করে থাকে বাংলাদেশে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমিত আর এদেশে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দশমিক আট শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় এক শতাংশ ছুই-ছুই। এ দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মেডিসিন ডিপার্টমেন্টগুলোতে প্রতি বছর যে সংখ্যক রোগী হন তাদের প্রায় দশ থেকে বারো শতাংশ লিভার রোগে আক্রান্ত আর বছর শেষে হিসাব কষতে বসলে দেখা যায় এ হাসপাতালগুলোর মেডিসিন বিভাগগুলো থেকে যে হতভাগ্য রোগীরা আর সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরত যাননি তাদের মধ্যে লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশে যেকোনো বয়সের মানুষই হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এটি বিশেষ করে প্রযোজ্য হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে, কারণ এ দেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমনের ধরনটা হচ্ছে আর্লি হরাইজেন্টাল, অর্থাৎ জন্মের ঠিক পর থেকে শুরু করে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে এদেশের বেশির ভাগ হেপাটাইটিস বি রোগী এই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে পরেন। তবে একটা সুখের বিষয় হচ্ছে এই যে আমাদের দেশে যে সফল ইপিআই কর্মসূচিটি চলমান, সেখানে গত ষোলো বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে নবজাতক শিশুদের হেপাটাইটিস বি’র টিকাটিও দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু আমাদের ইপিআই কর্মসূচির সাফল্য পঁচানব্বই শতাংশের বেশি, আমরা ধরে নিতেই পারি যে ষোলো বছর বা তার কম বয়সী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভবিষ্যতে এই ভাইরাসটি নিয়ে আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আর ধরারই-বা কী আছে। সুখবরটা তো জানিয়ে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয় কোভিড প্যান্ডেমিক শুরুর ঠিক আগে-আগে। সফল ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের হাতেগোনা গুটিকয়েক দেশের মধ্যে বাংলাদেশও পাঁচ বছর বয়সীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি’র প্রার্দুভাব এক শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৩.৩-তে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসেবে আমরা ঠিক পথেই হাঁটছি। কারণ ২০৩০ সালের সেই লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জনের প্রথম ধাপটি নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালের মধ্যে পাঁচ বছর বয়সীদের মাঝে হেপাটাইটিস বি’র প্রার্দুভাব ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা, যা আমরা করে দেখিয়েছি নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই।

হেপাটাইটিস বি আর সি হচ্ছে রক্তবাহিত ভাইরাস। এরা ছড়ায় শরীরে দূষিত রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া হেপাটাইটিস বি বা সি দিয়ে দূষিত কোনো সুই, রেজার, ক্ষুর, ব্লেড ইত্যাদি এ ভাইরাস দুটিতে আক্রান্ত নন এমন কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা হলেও ভাইরাস দুটো ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস বি এবং সি প্রতিরোধে তাই জোর দিতে হবে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের ওপর। আমাদের দেশে এটি একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা হলেও, আর দশটি আইনের মতো অনেকক্ষেত্রেই আমরা এই আইনটিরও ব্যত্যয় হতে দেখি। সেই প্রেক্ষাপটে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই আইনটির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এছাড়াও ব্যবহৃত সুই এর পুনঃব্যবহার প্রতিরোধ নিশ্চিত করাটাও জরুরি। আর সবচেয়ে যা জরুরি তাহলো এই বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করা।

পাশাপাশি আমাদের কোভিড টিকা সম্প্রসারণেও জোর দিতে হবে। বিশেষ করে ষোলো বছরের বেশি বয়সীদের জন্য এডাল্ট ভ্যাকসিনেশন এবং যারা ইপিআই কর্মসূচিতে হেপাটাইটিস বি’র টিকা নানা কারনে নিতে পারেননি তাদের জন্য ক্যাচআপ ভ্যাকসিনেশনের ব্যবস্থা করা জরুরি এবং এই টিকাকেও সরকারি ভাবে বিনামূল্যে সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হয় কিনা সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। যে দেশ তার আশি ভাগ নাগরিককে বিনামূল্যে কোভিডের টিকা দিতে পারে তার জন্য এটি কোনো বড় বিষয় হতে পারে না। বিশেষ করে দেশেই যখন একাধিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এরই মধ্যে হেপাটাইটিস বি’র টিকা উৎপাদন করছে।

হেপাটাইটিস বি এবং সি সত্যি-সত্যি যদি নির্মূল করতে হয় তাহলে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে আমাদরে প্রস্তুতিতে এখনও যথেষ্ট ঘাটতি আছে, যদিও এ কথাও সত্যি যে আমরা এরই মাঝে এগিয়েছিও অনেকটা পথ। ২০০৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন দ্বিতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তখন এদেশে এক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজে হেপাটোলজির সহকারী অধ্যাপকের একটি মাত্র শূন্যপদ ছিল, আর এখন তা বেড়ে প্রায় ত্রিশ ছুঁই-ছুঁই। দেশের প্রায় বিশটি সরকারি মেডিকেল কলেজসহ একাধিক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে লিভার বিষেশজ্ঞরা কর্মরত আছেন। দেশে বেড়েছে লিভার বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও। এক সময় দেশে হাতে গোনা কয়েকজন লিভার বিশেষজ্ঞ থাকলেও এখন আমরা সংখ্যায় বেড়ে শাতাধিক। এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস আর ময়মনিসংহ মেডিকেল কলেজে হেপাটোলজি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ আছে।

দেশেই এখন লিভার ফেইলিওরের জন্য প্লাজমা এক্সচেঞ্জ ও লিভার ডায়ালাইসিস, লিভার সিরোসিসের রোগীদের জন্য অটোলোগাস হেমোপয়েটিক স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন ও হেপাটিক ভেনাস প্রেসার গ্রেডিয়েন্ট মাপা এবং লিভার ক্যান্সার রোগীদের জন্য ট্রান্সআর্টারিয়াল কেমোএম্বোলাইজেশন ও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এবলেশনের মতন আধুনিক চিকিৎসাগুলো করা সম্ভব হচ্ছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে স্বতন্ত্র ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন। এখান থেকে লিভার রোগীরা এক দিকে যেমন এসব আধুনিকতম চিকিৎসাসেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন, তেমনি সামনে এখানে এডভান্স ফেলোশিপ প্রোগ্রাম চালু হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লিভার বিশেষজ্ঞরা এখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এই সেবাগুলো সাড়া দেশে ছড়িয়ে দিতে পারবেন।
বাংলাদেশে একই সময় ওষুধ শিল্পের যে ব্যাপক অগ্রগতি তার সুফল পাচ্ছেন আমাদের দেশের লিভার রোগীরাও। এদেশে এখন হেপাটাইটিস বি ও সি, লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সারের আধুনিকতম ওষুধগুলো খুব তাড়াতাড়ি এবং তুলনামূলক কম দামে পেয়ে যাচ্ছেন। আরেকটি বড় অগ্রগতি হয়েছে কোভিডের কারণে। প্যান্ডেমিকের শুরুতে দেশে যেখানে সরকারের হাতেগোনা দুয়েকটি পিসিআর ল্যাব ছিল এখন তা সংখ্যায় বেড়ে শতাধিক। কোভিড একবার নিয়ন্ত্রণে চলে এলে আমরা সামনে এই পিসিআর ল্যাবগুলোকেই হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের ডিএনএ ও আরএনএ নির্ণয়ের কাজে লাগাতে পারবো।

তারপরও অবশ্য কথা থেকে যায়। সতের কোটি মানুষের দেশ থেকে হেপাটাইটিস বি এবং সি’র মতো ভাইরাসকে ঝেটিয়ে বিদায় করার জন্য এইটুকু প্রস্তুতি নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে যেখানে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে সংক্রমিত পাঁচ শতাংশ মানুষও জানেন না যে তারা এ দুটো ঘাতক ভাইরাসে আক্রান্ত। করোনাকালে অন্যান্য নন-কোভিড রোগগুলোর মতো হেপাটাইটিসের চিকিৎসাও ব্যহত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও ডেলিভারী ব্যবস্থাপনা কোভিড ভ্যাকসিন কেন্দ্রিক হয়ে পরায় তার কিছুটা প্রভাব চলমান ইপিআই ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমমের ওপর পরবে। তবে এটাও ঠিক যে এটাই আজকের নিউ নরমাল বাস্তবতা। আমরা যেভাবে কোভিডের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের জীবনযাত্রাকে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিচ্ছি, তেমনি একইভাবে হেপাটাইটিসসহ আমাদের বিভিন্ন নন-কোভিড চিকিৎসাসেবাকে আমাদের ধীরে ধীরে যতোটা পারা যায় স্বাভাবিক করে নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নয়তো আজকে যেভাবে কোভিড সভ্যতাকে থামিয়ে দেওয়ায় চোখ রাঙ্গাচ্ছে, তেমনি আগামীকাল যে হেপাটাইটিস বি বা সি বা অন্য কোন নন- কোভিড ভাইরাস আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না এ কথা কিন্তু হলফ করে বলতে পারা যাবে না।

শুধু বাংলাদেশেই প্রতি বছর লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ, যা এ পর্যন্ত এদেশে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। আর এই কোভিডকালীন সময় যখন নন-কোভিড স্বাস্থ্য সেবা ব্যহত হচ্ছে সেখানে এই সংখ্যা যে বেড়েছে বই কমেনি তাতো চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। আর এই সংখ্যাগুলো কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই দেওয়া। অথচ খেদের বিষয় হচ্ছে যে অন্যান্য অনেক রোগের তুলনায় হেপাটাইটিস বি ও সি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা নেই বললেই চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হাতেগোনা যে কটি দিবস কে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। অথচ তারপরও নেই যথেষ্ট প্রচারণা। এর একটি বড় কারণ সম্ভবত এই যে কোভিডের মত হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হঠাৎ করেই মৃত্যুবরন করেন না। তারা ধীরে ধীরে বহু বছর ভুগে তার পর এক সময় অমোঘ পরিণতি বরণ করেন। সেই প্রেক্ষাপটে হেপাটাইটিস বি বা সি সম্বন্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলায় সরকার, লিভার বিশেষজ্ঞ, লিভার রোগী, সিভিল সোসাইটি এবং সর্বোপরি মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া

 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়