শারফিন শাহ্: একজন সৃজনশীল মানুষ সবসময়ই নিঃসঙ্গ। তার জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্তবিক কড়াকড়ির মধ্যে শিল্পস্রষ্টার প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় না কখনো। এজন্যই মহৎ শিল্পীদের দেখতে পাই, শেকল ছিঁড়ে ছুটে গেছেন ভালোবাসার সন্ধানে। একটা শব্দের জন্য, একটা নতুন চিন্তার জন্যে, একটা অনুভূতির জন্যে ভেঙে ফেলেছেন সমস্ত রীতিনীতির দেয়াল। বিদ্যাসাগর আধুনিক মানুষের কাছে দেবতুল্য। সার্ধশতবর্ষ ধরে তার চিন্তা ও কর্ম বাঙালিকে সবরকম কুসংস্কার ও চিরাচরিত নিয়মের বাইরে নবজীবনের সন্ধান দিয়েছে। কিন্তু এই বিদ্যাসাগরই কিনা শেষ জীবনে নগর কলকাতা ছেড়ে সাঁওতাল পল্লিতে চলে গিয়েছিলেন। ওখানেই খোঁজে পেয়েছিলেন বেঁচে থাকার সবটুকু আয়োজন।
রবীন্দ্রনাথকে বিলেতে পাঠানো হলো আইন পড়াতে। কিন্তু আইন ভাঙা যার কাজ তাকে কীভাবে আইন শেখানো যায়। উল্টো ফেরত এলেন বাংলার মাটি বাংলার জলে। বিয়ে, সংসার, সন্তান সবকিছুই ছিল তার। তবু তিনি ছিলেন একা এক পরিব্রাজক। মনের মতো সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন ভাবী কাদম্বরী দেবীকে। সৃষ্টির ইন্ধন জুগিয়ে অবশেষে তিনিও চলে গেলেন! রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই দুঃখের সঙ্গে যোগ হয়েছিল সন্তান হারানোর দুঃখ। তার কন্যারা বিবাহিত জীবনে ছিলেন অসুখী। আর স্ত্রী তো ওই সাধারণ বাঙালি ঘরের বউ, যার কাছে শিল্প বিরক্তিকর বিষয়। এজন্যই শান্তিনিকেতনে একান্তে শান্তি বুনেছিলেন তিনি। একবার সপরিবারে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে এসেছিলেন। গ্রাম্য পরিবেশ ভালো না লাগায় মাত্র কয়েকদিন পরই সবাই কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে একা করে। তাতে অবশ্য তার লাভই হয়েছে, একের পর এক গল্প, কবিতা, গান রচনা করেছেন শিলাইদহের প্রাকৃতিক লীলাভূমিকে কেন্দ্র করে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিতের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গেই কাটতো সারাবেলা। সেই বন্ধুরাই কিনা বাজি ধরিয়ে তাকে লেখক করে দিলো। সব ফেলে মানিক হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর লেখক। একটা কুঁড়ে ঘর, একটা তক্তপোশ আর কিছু বই নিয়েই কেটেছে তার জীবন। কারও সঙ্গে অপ্রয়োজনে দেখা করতেন না, এমনকি কাউকে কোনো বইও উৎসর্গ করেননি। মানিকের অন্য ভাইয়েরা সরকারি কর্মচারী হওয়ায় তাকে নানান রকম কটাক্ষও সইতে হয়েছে। সমরেশ বসু যথার্থই বলেছেন, ‘মানিক বাবুর মতো দুঃখী ও সাহসী আর কোনো লেখক বাংলা সাহিত্যে নেই।’
সৈয়দ মুজতবা আলী কতো দেশে কতো মানুষের সাথে মিশেছেন। বড় বড় ডিগ্রি নিয়েছেন। সেই তিনিই কিনা লেখকজীবন কাটিয়েছেন চার দেয়ালের ভেতরে। কেবল সারাদিন পড়া আর লেখায় কেটেছে তার সময়। বলেছেন, ‘মা ছাড়া আর কারও প্রতি আমার কোনো কমিটমেন্ট নেই।’ সমরেশ বসু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু জনপ্রিয় হলেও তার জীবন ছিল জনবিরল। একবার মুণ্ডা আদিবাসী সমাজে গিয়ে পুরোপুরি ওদের সঙ্গে মিশে গেলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, সবাই ভাবলেন সমরেশ বসু মুণ্ডাদের ছাড়তে পারবেন না, ওখানেই বাকী জীবন কাটবে তার। যদিও পরে অনেক চেষ্টায় ফিরেছিলেন সভ্য মানুষের জগতে।
জীবনানন্দ দাশ তো আমৃত্যু মুখচোরা ছিলেন। কারও দেখা পেলেই লুকিয়ে পড়তেন। এই কবির অবস্থা এমন ছিল যে, নিজের লেখাগুলোও রাখতেন লুকিয়ে। স্ত্রীর সঙ্গে তার কী পরিমাণ দূরত্ব ছিল তা ‘মাল্যবান’ পড়লেই বুঝা যায়। শিক্ষক জীবন, চাকরি জীবন আর সংসার জীবন কোনোটাই তাকে স্বস্তি দিতে পারেনি, কেবল লেখা তাকে বাঁচিয়েছে, হয়তো মেরেও ফেলেছে!
লাবণ্য-ঝরা কবি আবুল হাসান ছিলেন পুলিশ পিতার সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ইংরেজি পড়তে। পরীক্ষার ফিস দিতে না পারায় নাম কাটা যায়। পরে আর পড়াই হয়নি তার। কবিতাকে আশ্রয় করে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জুটে অনেক সঙ্গী। সুরাইয়া খানমের মতো বিদুষীর প্রেমস্পর্শও তাকে অমর করেছে। তবু তিনি লিখে গেছেন, ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা/ মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা।’ হুমায়ূন আহমেদ মাঝেমধ্যে রাইটার্স ব্লকে পড়তেন। যখন কিছুই লিখতে পারতেন না তখন চলে যেতেন নুহাশ পল্লির জঙ্গলে। এজন্যই তার মতে, সন্তানদের কাছে, পরিবারের কাছে তিনি একজন ব্যর্থ মানুষ, গর্তজীবী মানুষ।
একজন সৃজন-মুখর মানুষের কাছে প্রথাবদ্ধ, সংকীর্ণ, শৃঙ্খলিত জীবন বরাবরই উপেক্ষিত। শুধু বাংলা সাহিত্য কেন, বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালেও দেখবো এমন চিত্র। দান্তে, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, গোর্কি, বোদলেয়ার কী জগতে সুখের হাওয়ায় ভেসেছেন? তারাও ছিলেন বাঁধনহারা ও নির্জন প্রজাতির মানুষ। তবে তাদের আলাপ হবে আরেকদিন।
আপনার মতামত লিখুন :