শিরোনাম
◈ চট্টগ্রাম বন্দরে সাইফ পাওয়ার টেকের যুগের অবসান, এনসিটির দায়িত্বে নৌবাহিনী ◈ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজের খেলায় তালেবান, পেছনে চীন-রাশিয়া-ইরান-ভারত! ◈ পাকিস্তানকে ঠেকাতে গিয়ে ভারতে বন্যা, তোপের মুখে কঙ্গনা (ভিডিও) ◈ ৫ আগস্ট লক্ষ্য ছিল গণভবন, এবার জাতীয় সংসদ: নাহিদ ইসলাম (ভিডিও) ◈ গাজীপুরে মহানগর বিএনপির ৪ নেতা বহিষ্কার ◈ দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ : মির্জা ফখরুল ◈ রেস্ট হাউজে ‘নারীসহ’ ওসি, আটক করে ‘চাঁদা দাবি’ ছাত্রদল নেতার, সিসিটিভির ফুটেজ ফাঁস ◈ আর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলে সীমান্ত অভিমুখে লংমার্চ: হুঁশিয়ারি নাহিদ ইসলামের ◈ ধামরাইয়ে ঋণ দেওয়ার কথা বলে গৃহবধুকে ধর্ষণ, আসামী গ্রেফতার ◈ গাজীপুরে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার বিএনপি নেতা স্বপন

প্রকাশিত : ১০ জুলাই, ২০২১, ০৪:৪৭ সকাল
আপডেট : ১০ জুলাই, ২০২১, ০৪:৪৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

নদীভাঙনে ঘর বাড়ি হারাচ্ছে হাজারো মানুষ

নিউজ ডেস্ক: হাতিয়ার তমরুদ্দির রাবেয়া বেগমের বিয়ে হয়েছে ৩০ বছর আগে। এ সময়ে চোখের সামনে একে একে তলিয়ে যেতে দেখেছেন শ্বশুরের ভিটেবাড়ি, ফসলি জমি ও অন্যান্য সম্পদ। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় তিনবার মেঘনার ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে তার পরিবারকে। সহায়সম্বল হারিয়ে রাবেয়া চার ছেলেমেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে আশ্রয় নেন নতুন জেগে ওঠা চর হাতিয়ার জনতাবাজার এলাকায়। কিন্তু মাস দুয়েক আগে আবার রাক্ষুসে মেঘনা গিলে খেল সব। উত্তাল স্রোতে বাড়িঘর হারিয়ে রাবেয়া আশ্রয় নিয়েছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তিনি বলেন, নদী তাদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। আগে যে স্থানে জমি হারিয়েছেন, সেখানে নতুন চর জেগে উঠলেও প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে।

ছয়বার নদীভাঙনের শিকার হয়ে হাতিয়া থেকে ১৫ বছর আগে সুবর্ণচরের চরক্লার্কের মোহাম্মদপুর এলাকায় আশ্রয় নেন ৮০ বছরের মমিনুল হক। মাস তিনেক আগে ছলছলে নদী হানা দিল তার বাড়ির উঠোনে। স্ত্রীকে নিয়ে মমিনুলের ঠাঁই হয়েছে একটি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে। কখনও দু'বেলা-দু'মুঠো খাবার মেলে, আবার কখনও কিছুই মেলে না। সমকাল

প্রায় ২০ বছর আগে হাতিয়া থেকে নদীভাঙনের শিকার মানুষ গিয়ে বসবাস শুরু করেন সুবর্ণচরের পাশে জেগে ওঠা বিভিন্ন চরাঞ্চলে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নদীভাঙনে এখানকার বাসিন্দারা অস্তিত্বের সংকটে। গত দুই মাসে সুবর্ণচর ও হাতিয়ার অর্ধশত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। ভেঙেছে স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদ। বর্ষা মৌসুমে ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে নদী-তীরবর্তী অঞ্চলের চিত্র এমনই।

বর্ষার বৃষ্টি ও উজানের পানির তোড়ে দেশের সবক'টি নদনদীর পানি দ্রুত বাড়ছে।

সেইসঙ্গে নদীভাঙনও শুরু হয়েছে। এ বছর নদীভাঙনে দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) গত জুনে এমন পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটি গত বছর থেকে দেশের ১৩ জেলায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে বলে পূর্বাভাস দিলেও বাস্তবে ভেঙেছে ৩৮ বর্গকিলোমিটার। সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের এক হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

এদিকে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) বৈশ্বিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বন্যা, নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সংঘাতের কারণে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছেন অন্তত চার কোটি পাঁচ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ২৩০ জনই বাংলাদেশের। তাদের প্রায় সবাই নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছেন। বাংলাদেশে সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ২৩০ জন। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাস্তুচ্যুতদের অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরের বস্তিতে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। ভাঙনে কোনো কোনো পরিবার ২৭ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙন তীব্র হচ্ছে। অকালবৃষ্টি ও বন্যা, নদীর দিক পরিবর্তন এবং সুরক্ষা বাঁধ না থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। বাস্তুহারা মানুষ কোথায় ঠাঁই পাবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে- তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। নদীতে বিলীন হওয়া স্থানে আবার চর জাগলেও জোতদারদের দখল ও আইনি জটিলতায় সে জমি ফিরে পান না প্রকৃত মালিকরা। সিকস্তি-পয়স্তি আইন অনুযায়ী, ৩০ বছরের মধ্যে নদীতে ভেঙে যাওয়া জমি জেগে উঠলে সে জমি প্রকৃত মালিক ফেরত পাবেন। কিন্তু জমি ফিরে পেতে গেলে মামলা-হামলা, দখল-পাল্টা দখল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জানান, দেশে বর্তমানে নদীতে বিলীন হওয়া জমির (সিকস্তি) পরিমাণ পাঁচ লাখ ১৪ হাজার ৬৭১ দশমিক ৯৫ একর। প্রচলিত বিধি অনুযায়ী সিকস্তি জমির খাজনা আদায়ের সুযোগ নেই।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের (আইপিসিসি) পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বন্যা, ঝড়, নদীভাঙন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এক কোটি ৬০ লাখ থেকে দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্থানান্তরিত হবে। এর মধ্যে ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ নদীভাঙনের কারণে স্থানান্তরিত হবে।

সিপিআরডির নির্বাহী পরিচালক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো. শামছুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙনসহ বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষ গৃহহীন ও স্থানান্তরিত হবে। এ নিয়ে দ্রুত নীতি-পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, বেড়িবাঁধগুলো ঠিকমতো মেরামত হলে উদ্বাস্তুর সংখ্যা কমে আসত। নদীভাঙন রোধ করতে হলে প্রতিটি নদী সম্পর্কে সঠিক সমীক্ষা থাকতে হবে। পদ্মার মতো ভয়ংকর আগ্রাসী নদীর ভাঙন ঠেকাতে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা যমুনা বা ব্রহ্মপুত্রের জন্য প্রয়োজন হবে না। আবার তিস্তার জন্য অন্য রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য কোন নদীর গতি কেমন, মাটির ধরন কেমন- এসব বিষয় সামগ্রিক সমীক্ষা থাকতে হবে। তারপর ভাঙন রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে প্রকল্পের টাকা পানিতে ভেসে যাবে।

নেটওয়ার্ক অব ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশের (এনসিসিবি) প্রকল্প ব্যবস্থাপক ড. মুহাম্মদ ফররুখ রহমান বলেছেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত। বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক সমীক্ষার মাধ্যমে নদীভাঙন রোধে এলাকাভিত্তিক টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নদীভাঙনের শিকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি রোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলাদা তহবিলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, নদীভাঙনে ঘরবাড়ি ছাড়া মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন পুনর্বাসনের কাজ হচ্ছে। বাস্তুচ্যুতরা অন্য স্থানে পুনর্বাসিত হচ্ছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়