স্বপ্না রেজা: কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে ১ জুলাই থেকে। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, ম্যাজিস্ট্রেসি আদালত রাস্তায়। যখন এই লেখাটা লিখছি তখন করোনা শনাক্ত ২৪ ঘন্টায় ৮ হাজারের উপরে। সংক্রমণের হার ২৮ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাতে মহাসংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যদিনা এই সংক্রমণ রোধ করা যায়। এদিকে প্রচারমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে অক্সিজেন, ন্যাজাল মাস্ক, আইসিইউ এর সংকটের কথা। প্রায় প্রতিটি জেলায় মৃত্যু বাড়ছে। স্বজন হারানোর আহাজারি প্রায় প্রতিদিন। এসবের মাঝে আরও আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ছি পোশাক শ্রমিকদের দেখে।
করোনা সংক্রমণ রোধে সারা বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মার্কেট, শপিংমল বন্ধ। রিকশা ছাড়া সকল ইঞ্জিনচালিত যান চলাচলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খোলা শুধু উৎপাদনমূখী শিল্প কলকারখানা। যার মধ্যে পোশাক শিল্প অন্যতম। পোশাক শ্রমিকরা মানুষ কিনা, এই প্রশ্নটা আজ কঠিনভাবে করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কাকে করবো, সেটাও আর এক প্রশ্ন। পোশাক শ্রমিকেরা কী করোনা প্রুফড ?
সব বন্ধ। সবাই ঘরে। পোশাক শ্রমিকেরা বাইরে। কর্মস্থলে মেশিন চালাচ্ছেন। রপ্তানী আয় বাড়াতে মালিকেরা তাদেরকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। পোশাক মালিকেরা কিন্তু ঘরে। তাদের চোদ্দগুষ্ঠি ঘরে। তারা সংক্রমণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে। অন্যদিকে মাইলের পর মাইল হেঁটে শ্রমিকেরা তাদের ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছেন। শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মাথায় বৃষ্টির জল, মনে করোনার ভয় নিয়ে আর জীবিকার ব্যবস্থাকে না হারানোর চেষ্টায় তাঁরা হাঁটছেন। সাংবাদিককে একজন বললেন, মিরপুর থেকে তিনি সাভারে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। রিকাশায় এতো দূরে যাবার আর্থিক সামর্থ নেই। সারি বেঁধে তাই ওরা হেঁটে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছেন। শিল্পকারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত কী কী শর্তে ও ব্যবস্থাপনায় খোলা রাখা হয়েছে জানা জরুরি। মালিকপক্ষ কোন বিবেচনায় ভয়ংকর পরিস্থিতিতে কারখানা খোলা রাখছেন। যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমর্থন থাকে খোলা রাখার বিষয়ে, তাহলে মন্ত্রণালয় কী খোঁজ খবর রাখছেন, কীভাবে ও ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকেরা কাজে যাচ্ছেন, কাজ করছেন ? খবর না রাখলে, খবর না জানলে তা হবে মর্মান্তিক ও চরম অমানবিক।
ব্রিটিশ আমলের গল্প শুনেছি। চোখে দেখিনি। পোশাক শ্রমিকদের জীবন দেখলে সেই আমলের ছায়া দেখা যায়। মালিক ও শ্রমিকের ব্যবধান স্পষ্টত হয়। যেখানে মানবতা নেই। আছে স্বার্থ মালিকের এবং সেটা বেপরোয়া। ফ্যাক্টরির দামী দামী মেশিনের প্রতি মালিকের যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায় থাকে, শ্রেিমকর জীবনের প্রতি থাকে না।
পোশাক শিল্পের মালিকের মতো কী সরকার ভেবে নিয়েছেন, শ্রমিকেরা করোনা আওতামুক্ত ? কিংবা করোনা প্রুফড ? হতে পারে। নতুবা শ্রমিকেরা কেনো এতটাই অরক্ষিত, যেখানে সকলকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা চলছে। সরকারের উচিত, যে সকল মালিক তার শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেননি, তাদেরকে শ্রমিকদের সাথে পায়ে হাঁটিয়ে ফ্যাক্টরিতে পাঠানো। কেননা একই রাষ্ট্রে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দুইটা নিয়ম থাকতে পারে না। একই নিয়ম ও আইন চালু রাখতে হবে।
সেই সাথে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে বীমা, চিকিৎসা সেবা এবং বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মালিকশ্রেণি তা করছে কিনা সরকারকে তা দেখতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্য দূর হোক। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। প্রতিটি জীবন সুরক্ষিত হোক।
স্বপ্না রেজা: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আপনার মতামত লিখুন :