শিরোনাম
◈ সাতক্ষীরায় এমপি দোলনের গাড়িতে হামলা ◈ চুয়াডাঙ্গার পরিস্থিতি এখন মরুভূমির মতো, তাপমাত্রা ৪১ দশমিক  ৫ ডিগ্রি ◈ ফরিদপুরে পঞ্চপল্লীতে গণপিটুনিতে ২ ভাই নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১ ◈ মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৫৯.৭ শতাংশ  ◈ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী

প্রকাশিত : ২৪ জুন, ২০২১, ০৫:০৩ বিকাল
আপডেট : ২৪ জুন, ২০২১, ০৫:০৩ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সভ্যতা বিকাশে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা

ড. সৈয়দ আবু আব্দুল্লাহ : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের অভ্যুদয় মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী বিপ্লব হিসেবে পরিচিত। ইসলামকে কেন্দ্র করেই সভ্যতার ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছে এক নবতর অধ্যায়। মানবতার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে ইসলামি সভ্যতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশ্বসভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের জাগরণ ও উন্নতি একমাত্র ইসলামের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল। এগুলোর অন্যতম হলো- ব্যক্তির উন্নয়ন, মানবতার বিকাশ, নৈতিকতার জাগরণ, বৈষয়িক কলা-কৌশল, আবিষ্কার ও প্রয়োগবিদ্যা এবং আধ্যাত্মিক বিকাশ। সভ্যতা বিকাশের অন্যতম হাতিয়ার হলো শিক্ষা। ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের সর্বপ্রথম বাণী হলো : ‘পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ শিক্ষার প্রতি ইসলাম সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করে থাকে। পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে শিক্ষার অনুপ্রেরণা পেয়ে মুসলিম জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এবং শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিস্তারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। মুসলিমগণ সমগ্র বিশ্বের আলোকবর্তিকারূপে আবির্ভূত হয়। শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তারে মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদান রেখেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে ‘সভ্যতা বিকাশে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা’ বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।

সভ্যতা কী

সভ্যতা শব্দটি ‘সভ্য’ শব্দ থেকে গৃহীত। যার অর্থ হলো ভদ্র, শিষ্ট, মার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন, ভালো, পরারষরধহ, ঢ়ড়ষরঃব, পড়ঁৎঃবড়ঁং, সধহহবৎষু. সভ্যতা হলো সমাজ বিকাশের পদ্ধতি বা পর্যায় বিশেষ, জীবনযাত্রার কলা-কৌশল শিক্ষা, মানুষকে জ্ঞানে আলোকিত ও রুচি-মার্জিত করা। সভ্যতা বলতে সুসংহত নগর বা রাষ্ট্রের নাগরিক জীবনের অর্জিত গুণাবলির সমগ্রকে বুঝায়। অনেকে সভ্যতা বলতে বস্তুগত সংস্কৃতিকে বুঝিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব বস্তুগত আবিষ্কারের ফলকে একত্রে সভ্যতা বলা হয়। সভ্যতা হচ্ছে কুসংস্কারবর্জিত সমাজের চূড়ান্ত রূপ। মানবজাতি সম্বন্ধে সর্বাধুনিক অনুসন্ধানে জানা যায় মানুষ একেবারে নগণ্য অবস্থায় জীবনারম্ভ করেছিল। ক্রমশ ধাপে ধাপে সে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা অর্জন করে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হয়। কালের বিবর্তনে আমরা যা ব্যবহার করি তাই হলো-সভ্যতা। মানুষের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলোর সাথে তার মানবিক দিকগুলোর সংযোগের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা গড়ে ওঠে।

মানবসভ্যতা ও ধর্ম

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে জানা যায় ধর্মের বাণী প্রচার করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মানবসমাজের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর কাছে নবি-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানবসভ্যতা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যুগে যুগে মানুষ যতটা ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার জন্য ততোটা মাথা ঘামায়নি। মানবইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার প্রভাবের চেয়ে ধর্মের প্রভাব অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। আর এই অতি প্রাকৃতিক বাস্তবতাই মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পচিন্তার পেছনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। মানবজাতির বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে প্রায়ই কোনো না কোনো দিক দিয়ে ধর্মের একটা সম্পৃক্ততা দেখা যায়। মানুষ যুগে যুগে ধর্মীয় আদর্শের জন্য স্বীয় আরাম-আয়েশ ও ধন-সম্পদ সবকিছুই অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে। এমনকি নিজেদের প্রিয় জীবনকে উৎসর্গ করেছে। সুতরাং বুঝা যায়, ধর্ম একটি বুনিয়াদি বিষয়। ধর্মানুভূতি ব্যতীত সবকিছুই অন্তঃসারশূন্য। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন ও ধর্মের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককেই গুরুত্ব দেয়। মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতি সাধনের মাধ্যম এবং জ্ঞান ও বিবেকের সাথেও এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও প্রত্যাদেশ এগুলোর প্রতি বিশ্বাসের দিক বিবেচনায় একমাত্র ইসলামই সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ ধর্ম।

ইসলামি সভ্যতা

মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে এক নতুন দর্শন নিয়ে আসে ইসলাম। সূচনা হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি স্বতন্ত্র ধারার। পর্যায়ক্রমে যা ইসলামি সভ্যতায় রূপ লাভ করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে শিক্ষা মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত করেছিল, তা-ই সমুজ্জ্বল ইসলামি সভ্যতা গড়ে ওঠা ও তা বিকশিত হবার ক্ষেত্র তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামি সভ্যতা অতীত সভ্যতাগুলোর নেতিবাচক ও কুসংস্কারাছন্ন দিকগুলোকে সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইতিবাচক দিকগুলোকে লালন করে পূর্ণতা লাভ করেছে এবং বিকশিত হয়েছে। পবিত্র চিন্তা-চেতনার উপর ভিত্তি করেই ইসলামি সভ্যতা গড়ে উঠেছে। পরকালে জবাবদিহিতা ইসলামি সভ্যতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। দুনিয়ার কর্মফল পরকালে পাওয়া যাবে; এ দৃঢ় বিশ্বাস ছাড়া কারো পক্ষে নৈতিক মান রক্ষা করা সম্ভবপর নয়।

ইসলামি সভ্যতার উপাদানসমূহ

ইসলামি সভ্যতার কতিপয় স্বতন্ত্র উপাদান রয়েছে। যা একে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও সুস্পষ্ট গুণাবলিতে উজ্জ্বল করে রেখেছে। যদিও এর কতিপয় উপাদান অন্যান্য সভ্যতার সাথে কিছুটা সাদৃশ্যমান। কিন্তু ইসলামি সভ্যতার কতিপয় উপাদান, যেমন : ঈমান, তাওহিদ, সাম্য, আখলাক, আত্মিক জিহাদ ও পরিশ্রম, নায্যতা, ন্যায়-বিচার, দাসত্ব প্রথার অবসান ও ক্ষমার আদর্শ অন্যান্য সভ্যতা হতে স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা প্রদান করেছে। ইসলামি সভ্যতায় রয়েছে সর্বজনীন কল্যাণের প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও মানবজাতিকে পরিচালনার শক্তি। সর্বক্ষেত্রে সুখ-শান্তি লাভ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা গঠনের মূল নিয়ামক হলো- আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করা। যে সকল সভ্যতা আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর তাওহিদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা অন্তঃকলহ ও পরস্পর বিবাদে লিপ্তÑ যা ধ্বংসের কারণ। কেননা, সে সভ্যতায় আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য ইলাহকে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর অন্যান্য ইলাহকে গ্রহণ মানুষের জীবনকে বিনষ্ট করে দেয় ও দুঃখ-দুর্দশা বয়ে আনে। আল্লাহ বলেন-
لَو كانَ فيهِما الـِهَةٌ إِلَّا اللَّهُلَفَسَدَتا فَسُبحٰنَ اللَّهِ رَبِّ العَرشِ عَمّا يَصِفونَ.
‘যদি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকত, তবে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব, তারা যা বলে, তা থেকে আরশের প্রভু আল্লাহ পবিত্র।’

নবি (সা.)-এর ভূমিকা

নবি মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.) ধর্মের মাধ্যমে আরববাসীদের সমাজ ও রাজনীতিতে অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তাঁর পদচারণা ছিল অতীব বলিষ্ঠ। ইসলামি সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর পদক্ষেপের মধ্যে জ্ঞানার্জন তথা শিক্ষা-সভ্যতার বিস্তার, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা, ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তকরণ, জীব-জন্তুর প্রতি ভালোবাসা, সহ-অবস্থান, সহিষ্ণুতা ও পরধর্মের প্রতি সহনশীলতা প্রভৃতি অন্যতম। নবি মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.)-এর গৃহই ছিল অন্যতম শিক্ষালয়। তিনি নিজেই লোকদের শিক্ষা দিতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) আজীবন নারীদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর অন্য স্ত্রীদের গৃহ নারী শিক্ষার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নে এতো গুরুত্ব দিতেন যে, বদর যুদ্ধের শিক্ষিত যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলেন কয়েকজন নিরক্ষর মুসলিমকে শিক্ষা দান করার মাধ্যমে।

খোলাফায়ে রাশেদার ভূমিকা

খোলাফায়ে রাশেদার যুগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল শিক্ষা-সভ্যতার বিকাশ ও মুসলিম রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে। হযরত উমর (রা.) তাঁর শাসনামলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শিক্ষা প্রদানের জন্য যোগ্যতাসম্পন্নদেরকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করতেন এবং বায়তুল মাল থেকে তাঁদের বেতন-ভাতা দিতেন। হযরত উমর (রা.)-এর সময়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, সড়ক, নগর ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। হযরত উসমান (রা.)-এর সময়ে ইরাক ও আর্মেনিয়ায় কুরআনের পঠনে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলে তিনি মহানবি (সা.)-এর স্ত্রী হাফসা (রা.)-এর নিকটে সংরক্ষিত কুরআনের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপির কপি রেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য পাণ্ডুলিপির কপিগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও স্মৃতিশক্তির জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি একজন অসাধারণ মুফাস্সিরে কুরআন ও কবি ছিলেন। হাদিস বর্ণনাকারী হিসাবেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন।

উমাইয়্যা শাসকগণের ভূমিকা

খোলাফায়ে রাশেদার পর মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন উমাইয়্যা শাসকগণ (৬৬৩-৭৫০ খ্রি.)। উমাইয়্যা শাসনামলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হয়। উমাইয়্যা শাসনামলের অন্যতম শাসক ওমর ইবনে আব্দুল আযিযের সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হাদিস সংকলনের কাজ সুষ্ঠুরূপে সম্পাদন করা হয়। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদিসচর্চা ও শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা হতে প্রচুর পরিমাণে শিক্ষার্থী এসব শিক্ষাকেন্দ্রে আসত। এ সময়ে ফিক্হ চর্চা ও সম্পাদনার কাজও সুচারুরূপে চলতে থাকে। এছাড়া উমাইয়্যা শাসনামলে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়। বিজ্ঞানবিষয়ক অনেক বই-পুস্তক আরবিতে অনূদিত হয়। জ্যোতির্বিদ্যা, ক্ষেত্রতত্ত্ব, চিকিৎসা, বীজগণিত, নৌ-চালনা ও ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ের উন্নতির সূচনা হয়।

আব্বাসি শাসকগণের ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাসে আব্বাসি খেলাফত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিশেষত ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে আব্বাসিদের অবদান অবিস্মরণীয়। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৫০৮ বছরের ইতিহাসে ৩৯ জন আব্বাসি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা নতুন মাত্রা লাভ করে। খলিফা মামুনের প্রতিষ্ঠিত মান-মন্দির, যা ‘বায়তুল হিকমা’ নামে খ্যাত, আরব মুসলিমদের জ্ঞানচর্চা বিপ্লবের সূচনা করে। সাম্রাজ্যের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অসংখ্য শিক্ষা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভায় উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। শিক্ষাকে সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় অসংখ্য পাঠাগার। সেসব পাঠাগারে শোভা পেত অগণিত বই। পাঠাগারে থাকত গবেষণা ও অনুবাদের সুযোগ। আব্বাসি যুগকে ইসলামি জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার স্বর্ণযুগ বলা হয়। আব্বাসি শাসকদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহের কারণে এ সময় মুসলিম বিশ্ব বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা ও শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ বিশ্বের জ্ঞানকে আরবিতে অনুবাদ করার কাজে নিয়োজিত হন। হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল এমন অনেক ধ্রুপদি কাজ আরবি ও ফারসিতে এবং পরে তুর্কি, হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গমস্থলে পরিণত হয়। প্রাচীন রোম, চীন, ভারত, পারস্য, মিসর, উত্তর আফ্রিকা, গ্রিক ও বাইজান্টাইন থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

মুফাস্সিরদের অবদান

ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে জ্ঞানের যেসব শাখা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এগুলোর অন্যতম হলো ইলমে তাফসির। যুগে যুগে অনেক মুফাস্সিরে কুরআন ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। যুগশ্রেষ্ঠ মুফাস্সিরদের অন্যতম হলেন ইমাম আবু বকর আহমাদ ইবনে আলী আল জাসসাস (৩৭০ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘আহকামুল কুরআন’; ইসমাঈল হাকী (১১২৭ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে রুহুল বায়ান’; কাজী সানাউল্লাহ পানিপথি (১২২৫ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে মাযহারী’; শিহাবউদ্দিন মাহমুদ আলূসী (১২৭০ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে রুহুল মাআনী’; আলী ইবনে মুহাম্মাদ আত তাবারী (৩১০ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে তাবারী’; আব্দুল্লাহ ইবনে বায়যাভী (৬৮৫ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে রুহুল বায়যাভী’, ইসমাঈল ইবনে আমর দিমাশকী (৭৭৪ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’, জালালুদ্দিন মুহাল্লী (৮৬৪ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে জালালাইন’ ও মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল কুরতুবী (৬৭১ হি.), তাঁর রচিত তাফসিরের নাম ‘তাফসিরে কুরতুবী’।

সাহিত্যিকদের অবদান

সাহিত্য কলা মানবসভ্যতার দর্পণ। সাহিত্যেও ইসলাম ও মুসলিমদের অবদান ব্যাপক। ইসলাম সাহিত্যকে দিয়েছে সুন্দর, সুষমামণ্ডিত ও পরিশীলিত ধারার ব্যঞ্জনা। ইসলাম-পূর্ব যুগে সাহিত্যে যে কদার্য ছিল, ইসলাম সেসকল কলুষ ও কালিমা দূর করে ইসলামি সাহিত্যকে পরিচ্ছন্ন, মানবিক-নৈতিক এবং প্রাণরসের সঞ্জীবনী ধারায় উন্নীত করেছে। সাহিত্যে ইসলামের মৌলিক সফলতা এখানেই। আল্লাহর বাণী কুরআন মাজিদ এক অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্য। কুরআন নাজিলের প্রভাবেই অশ্লীল কাব্যচর্চা বন্ধ হয়ে শ্লীল, মার্জিত ও রুচিসম্মত কাব্যচর্চা শুরু হয়। মহানবি (সা.)-এর বাণী হাদিসশাস্ত্রও উঁচুমানের সাহিত্য। হাদিস আরবি সাহিত্যের অমূল্য ভাণ্ডার। মহানবি (সা.) নিজেও সাহিত্যের সমঝদার ছিলেন। তিনি কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পুরস্কৃত করে উৎসাহিত করতেন। তিনি কবি হাস্সান বিন সাবিত (রা.)-কে পৃষ্ঠপোষকতা ও পুরস্কৃত করেন। চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) ছিলেন একজন সুপণ্ডিত, সুবক্তা, সুলেখক ও সুকবি। তাঁর রচিত ‘নাহজুল বালাগা’ ও ‘দিভানে আলী’ খুবই প্রসিদ্ধ। আরবি ও ফারসি সাহিত্য স্বীয় রূপ মাধুর্যের মধ্য দিয়ে অনুভূতি ও কল্পনাকে নাড়া দেয়। খলিফা আল-মনসুর ছিলেন একজন কাব্যরসিক শাসক। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রচেষ্টায় প্রাচীন আরবি কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়। খলিফা হারুন-অর-রশীদ নিজে কাব্যচর্চা করতেন। তাঁর সময়েই বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ (হাজার ও এক রজনী) গ্রন্থখানা রচিত হয়েছিল। পারস্যের মালিক শাহ ও গজনীর সুলতান মাহমুদ প্রমুখ স্ব-স্ব রাজধানীকে সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠে পরিণত করেন। মুসলিম কবিদের অন্যতম হলেন কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি, কবি হাকিম সানায়ী, মাওলানা ফরিদউদ্দিন আত্তার, মাওলানা জালালউদ্দিন রূমি, কবি নিযামী গাঞ্জুবী, মাওলানা আব্দুর রহমান জামি, কবি হাফিজ শিরাজী, কবি আবুল ফারাজ, আহমাদ ইবনে হুসাইন আল-মুতানাব্বী, অন্ধ কবি আল-মাআরবি, কবি রুগগি, কবি শেখ সা’দি, মহাকবি ইকবাল, কবি আলতাফ হোসাইন হালি, মির্যা গালিব, কবি নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ।
ঐতিহাসিকদের অবদান

ইতিহাস অতীতের দর্পণ। ইতিহাস অতীত ঘটনাবলির উজ্জ্বল প্রতীক। মহানবি (সা.)-এর আগমনের পর হতেই মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইতিহাস রচনার অনুপ্রেরণা দেখা দেয়। মহানবি (সা.)-এর বিচিত্র কর্মমুখর জীবনের নানা খুঁটিনাটি বিষয় জানার আগ্রহ এবং হাদিস চর্চা করতে গিয়েই ইতিহাস চর্চার উন্মেষ ঘটে। মহানবি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর বাণীসমূহ সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও পরবর্তীদের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা, তাঁর পরিবারের সাথে বংশগত সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ এবং মুসলিম রাজ্য বিস্তারের বর্ণনা ও মুসলিম বিজেতাদের বীরত্বগাথা রচনা ইতিহাস চর্চার অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত। ইতিহাস রচনায় যেসকল মুসলিম পণ্ডিতগণ অবদান রেখেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন মুহাম্মাদ ইবনে জারীর আত-তাবারী, ইবনে কুতায়বা, বালাযুরী, আহমদ ইবনে আবি তাহির, আবু হানিফা, ইয়াকুবী, আল-মাসুদী, হামযা আল-ইসফাহানী, সাবিত বিন সিনান, মুহাস্সিন ইবনে আলী আত-তানুখী, ইবরাহিম ইবনে হিলাল আস-সাবী ও মিসকাওয়াহ প্রমুখ। ইবনে আসির ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আরব ঐতিহাসিক। ইবনে খালদুন ছিলেন কালজয়ী প্রতিভার অধিকারী। ‘কিতাব-আল-ইবার’ ছিল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।

দার্শনিকদের অবদান

দর্শন হলো সত্যে উপনীত হবার যৌক্তিক পদ্ধতি। জ্ঞানের অনুশীলন ও সত্য অনুসন্ধান করাই হলো দর্শন। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ছেড়ে নিরূপণসাপেক্ষ বস্তুর যথার্থ রূপ বিশ্লেষণের সত্যিকার জ্ঞানই দর্শনশাস্ত্র। দর্শন মানুষকে প্রকৃত পথে পরিচালিত করে সত্যে উপনীত হতে সাহায্য করে। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হওয়ার জন্য বিশ্ব প্রকৃতির চর্চাকে ইসলামি দর্শন বলে। সুতরাং ইসলামি দর্শনই প্রকৃত দর্শন। মুসলিম জাতির চিন্তা-ধারার বহিঃপ্রকাশ এবং জীবন ও জগতের সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন প্রয়াসই ইসলামি দর্শন। মুসলমানগণ দর্শনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের পুরাধা ছিলেন। মুসলমানগণ মোঙ্গলদের মত বর্বর হলে ইউরোপের পুনর্জাগরণ আরো শতাধিক বছর বিলম্বিত হতো। মুসলিম দার্শনিকদের অন্যতম হলেন হযরত আলী (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইমাম জাফর সাদেক, ইমাম আল-রাজি, ইমাম গায্যালী, আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশ্্দ, ইবনে তুফায়েল প্রমুখ।

রসায়নবিদদের অবদান

রসায়নশাস্ত্রের উন্নতির জন্য মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। পৃথিবীর জ্ঞানাগারে তাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ এবং বৈজ্ঞানিক সূত্র ও পদ্ধতির উন্নতি বিধান। মুসলিম আলকেমিস্টরা মধ্যযুগের ইউরোপীয় আলকেমিস্টদের প্রভাবিত করেন। বিশেষত জাবির ইবনে হাইয়ানের রচনার মাধ্যমে। আধুনিক রসায়নশাস্ত্র মুসলমানদের উদ্ভাবন এবং এ বিষয়ে কৃতিত্ব অতুলনীয়রূপে চিত্তাকর্ষক। মুসলমানগণ সীসা, পারদ, রৌপ্য, তাম্র ও স্বর্ণের রাসায়নিক সাদৃশ্যের সন্ধান করেন। তাঁরা ধাতুর সাথে অম্লজান মিশ্রণ ও হিসেব নিরূপণের রাসায়নিক পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। মুসলিম স্পেনেই প্রথম রসায়নশাস্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে যাঁরা রসায়নশাস্ত্রে অবদান রেখেছেন তাদের অন্যতম হলেন আধুনিক রসায়নের জনক জাবির বিন হাইয়ান, যিনি পাশ্চাত্যে জেবের নামে পরিচিত। তিনি রসায়নশাস্ত্রের উপর প্রায় পাঁচশত গ্রন্থ রচনা করেন। এ সমস্ত গ্রন্থের অন্যতম হলো ‘আর রহমাহ’, ‘কিতাব আল-তাজমী’, ‘আল-জিবাক’ ও ‘আশ শারকী’। অন্যান্য বিখ্যাত মুসলিম রসায়নবিদ হলেন যথাক্রমে আল-রাজি ও আলী ইবনে সিনা। ব্রেডলি স্টেফেনস ইবনে আল-হাইসামকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিকাশ ঘটানোর জন্য ‘প্রথম বিজ্ঞানী’ হিসাবে উল্লেখ করেন।

গণিত শাস্ত্রবিদদের অবদান

গণিতশাস্ত্র জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি মৌলিক শাখা। মুসলিম পণ্ডিতগণ ধর্মীয় অনুশাসন পালন করার তাগিদেই গণিতশাস্ত্রের উপর গবেষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দৈনিক পাঁচবার নামায আদায়ের সময় নির্ধারণ, যাকাত আদায়ের হিসাব-নিকাশকরণ, রমযান মাসের রোযা পালন ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বণ্টন ইত্যাদি প্রশ্ন সমাধানের জন্য তাঁরা গণিতশাস্ত্রে গবেষণা করতে উৎসাহিত হন। গণিতশাস্ত্রের আবিষ্কার, অগ্রগতি, অগ্রযাত্রা ও উৎকর্ষ সাধনে মুসলমানদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানী আল-খাওয়ারিজমি তাঁর গ্রন্থ ‘কিতাব আল-জাবর ওয়াল মুকাবালাতে’ বীজগণিত নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ গ্রন্থ থেকে ইংরেজি ‘অ্যালজেব্রা’ শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। তাই তাঁকে বীজগণিতের জনক বলা হয়। মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে আরো যাঁরা গণিতশাস্ত্রে অবদান রেখেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন আবুল ওয়াফার, আল-বিরুনি, ওমর খৈয়্যাম, জাবির ইবনে আফলাহ, আল-বাতানী, মুহাম্মাদ বিন ঈসা আল-মাহানী, মুহাম্মাদ বিন তাইয়্যের আল-সারাখশী, নাসিরউদ্দিন আল-তুসি, আলী-বিন মুহাম্মাদ আল-কালাহাদী, আল-ইয়ামি, আল-ফারাবি, আবুল কাসিম মাসলামা, আলী ইবনে সিনা, আল-কিন্দি, হাসান বিন আল-হাসান, বাহাউদ্দিন আমির প্রমুখ।

চিকিৎসাবিদদের অবদান

চিকিৎসাশাস্ত্র বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এর অগ্রযাত্রা ও উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম পণ্ডিতগণ পবিত্র কুরআন ও হাদিস হতে চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। ইবনে বাত্তাল, মাসার যাওয়াহ প্রমুখ চিকিৎসাবিদগণ একাধিক চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন। ওমর ইবনে আব্দুল আযিয আলেকজান্দ্রিয়া হতে মেডিকেল স্কুল ও চিকিৎসকদের ইরাকে স্থানান্তর করেন। এর ফলে মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। নবম শতকে বাগদাদে ৮০০ জন চিকিৎসক ছিলেন এবং এনাটমিও রোগের উপর ব্যাপক আবিষ্কার সম্পন্ন হয়। হাম ও গুটি বসন্তের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় সম্ভবপর হয়। খ্যাতনামা পারসিয়ান বিজ্ঞানী ইবনে সিনা, যিনি পাশ্চাত্যে আভিসেনা নামে পরিচিত, তিনি বিজ্ঞানীদের অর্জিত বিশাল পরিমাণ জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করেন এবং ‘কানুন ফিত-তিব’ ও ‘কিতাবুশ শিফার’ মাধ্যমে পেশ করেন। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশ্বকোষ হিসাবে খ্যাত। চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে আরো যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন আত-তাবারী, আল-রাজি, আলী ইবনে আব্বাস আল-মাজুসী, আলী ইবনে ঈসা ও আম্মার, হুনাইন বিন ইসাহাক, আবুল কাসিম আয যাহরাবী, ইবনে আল-কিফতি, ইবনে যুহর, ইবনে আল-বায়তার প্রমুখ।

ভূগোলবিদদের অবদান

ভূগোলশাস্ত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। পবিত্র হজ পালন, নামাযের জন্য দিক নির্ধারণ, বিশাল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যোগাযোগ স্থাপন, অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়, বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক পথ ও বাজারের সন্ধানে এবং ভারতীয় ও গ্রীকদের প্রভাবে মুসলিম পণ্ডিতগণ ভূগোলচর্চায় মনোনিবেশ করেন। মুহাম্মাদ মূসা আল-খাওয়ারিযমী রচিত ‘কিতাব আল-খাওয়ারিযমী’ গ্রন্থটি আরবি ভাষায় ভূ-বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ে রচিত ভৌগোলিক তথ্য সম্বলিত গ্রন্থসমূহ মুসলমানদের প্রথম স্বাধীন ও স্বতন্ত্র আরবি ভূগোল গ্রন্থ। এসব গ্রন্থের মধ্যে বিখ্যাত ভূগোলবিদ ইবনে খুরদাদবিহ রচিত ‘আল মাসালিক ওয়াল মামালিক’, কুদামার রচিত ‘কিতাব আল-খারাজ’, ইয়াকুবীর ‘কিতাব আল-বুলদান, ইবনে রুস্তাহর ‘আল-আ’লাক আন-নাফীসাহ’, ইসতাখবী রচিত ‘আল মাসালিক ওয়াল মামালিক’ এবং মুকাদ্দিসীর ‘আহসান-আত-তাকাসিম ফি মারিফাত আল-আকালিম’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পরিব্রাজক ‘নাসির-ই-খসরু’ এবং ইবনে জুবাইর তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তে মুসলিম বিশ্বের অনেক এলাকার চিত্তাকর্ষক বর্ণনা তুলে ধরেছেন। এছাড়াও আরেকজন বিখ্যাত পরিব্রাজক ‘ইবনে বতুতা’ তাঁর ‘রেহালাত’ গ্রন্থে দেশ-বিদেশের অনেক তথ্যসমৃদ্ধ ও মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়ে ইতিহাসে বর্ণনামূলক ভূগোলবিদ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। উপরোল্লেখিত খ্যাতিমান ভূ-বিশারদ ও ভূগোলবিদ ছাড়াও অসংখ্য ভূগোল বিশেষজ্ঞ ছিলেন যাঁরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও গবেষণা দ্বারা মূল্যবান ভূগোলবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

উপসংহার

বিশ্বসভ্যতায় মানবতার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে ইসলামি সভ্যতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশ্বসভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের জাগরণ ও উন্নতিতে একমাত্র ইসলাম ধর্মই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মহানবি (সা.), চার খলিফা, উমাইয়্যা ও আব্বাসি খলিফাদের আমলে বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের অবদান এক গৌরবময় ঐতিহ্যের ইতিহাস গড়ে তুলেছে। নবি (সা.)-এর সময়ে মসজিদে নববীতে ‘আহলে সুফফাদের’ জ্ঞানার্জন, খোলাফায়ে রাশেদার যুগে পবিত্র কুরআনকে একত্রিত করে গ্রন্থকারে সংকলন, উমাইয়্যা শাসকদের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা, আব্বাসি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা বিশ্বসভ্যতার সমৃদ্ধি ও বিকাশে অসামান্য অবদান রেখেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়