সাদিয়া নাসরিন: আবু ত্ব-হা আদনানের খোঁজ মিলেছে। রংপুরে একটি বাড়িতে (শোনা যাচ্ছে প্রথম স্ত্রীর বাড়িতে) তাকে পাওয়া গেছে। তিনি কি আত্মগোপনে ছিলেন, না কি তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো সে বিষয়ে কোন বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। অপেক্ষা করি।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো, হয় তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, অথবা বড় কোন পরিকল্পনা নিয়ে তাকে আরো জনপ্রিয় করে তোলার জন্য গোপন করে রাখা হয়েছিলো। দ্বিতীয়টা হয়ে থাকলে সে উদ্দেশ্য আপাতত সফল। তার নামও যারা জানতোনা তারাও এখন তার কয়েকটা ভিডিও দেখে ফেলেছে (ইনক্লুডিং মি)।
যাই হোক, তার লুকিয়ে থাকা বা রাখার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে, জেহাদে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করা বা আরো বড় কোন পরিকল্পনার জন্য তৈরী হওয়া। আদনানের ভিডিও বয়ান বা ‘খুৎবা’ খুচরা খাচরা শুনলেও যে কোন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এমনটাই ধারণা হবে।
আবু ত্ব-হা আদনান তার প্রায় সকল বয়ানেই দজ্জাল বিরোধী জনমত গঠন করার নামে ধর্মের জন্য নিজেকে ‘কোরবানি’ করা, জেরুজালেম গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, জিহাদ করতে আফগানিস্তান যাওয়া ইত্যাদি ফায়সালা দিয়েছেন এবং এর পক্ষে প্রচুর মাসালা প্রচার করেছেন, জেহাদরত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীর জন্য পুরস্কারের মাসালাও দিয়েছেন।
অন্যান্য ওয়াজীদের মতোই আদনানও নারীর প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করেছেন, নারীরা দাজ্জালের অনুসারী বলে ফতোয়া দিয়েছেন। প্রচলিত সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমত প্রচার করেছেন। এবং আধুনিক সভ্যতার সকল ‘নেয়ামত'কে অস্বীকার করার 'দাওয়াত' দিয়ে, আধুনিক শিক্ষাকে 'বাতেল' এর খাতায় রেখে 'ইসলামিক' শিক্ষাকেই কেবল জ্ঞান বলে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
অথচ এসব ‘দাওয়াত’ দেওয়ার জন্য আধুনিক সভ্যতার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ‘নেয়ামত’ এর উপরই ভরসা করেছেন এবং ফেইসবুক ইউটিউবে ভিডিও বয়ান প্রচার করেছেন যা (তার ভাষাতেই) ইসলামে না যায়েজ বা ‘বাতেল জ্ঞান’।
স্বাভাবিকভাবেই আদনানের 'দাওয়াত'এর প্রধান অডিয়েন্স 'মুসলিম উম্মাহ'। এবং তিনি মনে করেন এই দেশ চালায় ‘র’ এবং মোসাদ। এই অবস্থা থেকে দেশকে বাঁচাতে তিনি দেশের দেওবন্দি (কওমী), আহলে হাদিস, চরমোনাই, জামাতে ইসলাম সহ সকল তরীকার মুসলমানদের 'ছোটখাট' ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে অবস্থান এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দেন।
এখন, সাধারণ মুসলমানের কাছে আদনানের এই আকাঙ্খা আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ মনে হতে পারে। কিন্তু ক্রিটিক্যাল এনালিসিস করলে বুঝা যাবে, আদনান কি আসলেই ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ঐক্য চাইছে নাকি ইসলামের নামে বিভিন্ন তরীকায় যারা ধর্মীয় সহিংসতা ও জঙ্গীবাদকে উস্কে দেয়ার চক্রান্তে ব্যস্ত তাদের ঐক্য চাইছে?
এই একটি প্রশ্নেই অন্যান্য ওয়াজী বা তথকথিত ‘ইসলামী বক্তা’দের চেয়ে আদনান একটু বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ, আদনান তার এসব জেহাদী বয়ান প্রচার করেছেন খুব শান্তভাবে, বিনয়ী উপস্থাপনায়, যা তাকে সাধারণ মুসলমানের কাছে ইসলামী ‘দ্বায়ী’ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে। বলাই বাহুল্য, এটা ভয়ঙ্কর পন্থা। কারণ, এই পন্থায় সাধারণকে বিভ্রান্ত করা যায় সহজে।
মনে করে দেখুন, ২০১৬ সালে সারা বাংলাদেশ থেকে যখন দু’শরও বেশি তরূণ হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো, সরকারের কাঁধে গুমের দায় বাড়ছিল, হঠাৎ করেই তাদের বেশিরভাগেরই খোঁজ মিলেছিলো মধ্যপ্রাচ্যে এবং তারা কোন জঙ্গীগোষ্ঠির জেহাদী প্ররোচনায় পরিবার পরিজন কাউকে কিছু না জানিয়ে সিরিয়া, ইরাক, আফগানে (তাদের ভাষায়) জিহাদ করতে গেছে।
এখনও কি এমন হতে পারে যে, গত কয়েকবছরে দেশে আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর জঙ্গিবিরোধী তৎপরতায় দেশীয় জেহাদীগোষ্ঠি তাদের কৌশল পরিবর্তন করে আবু ত্বোহা আদনানের মতো মিষ্টভাষি তরুণদের সাধারণ মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয় করে জেহাদী নেতৃত্বে নিয়ে এসে ‘জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র বাণী প্রচার করে তরুণ শিক্ষিত মুসলিমদের জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত করতে চাইছে?
ফেসবুক
আপনার মতামত লিখুন :