শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৭ জুন, ২০২১, ১০:২৩ দুপুর
আপডেট : ১৭ জুন, ২০২১, ১০:৪১ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন এবং ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্স এখন জরুরি: ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম

ভূঁইয়া আশিক রহমান : [২] বিশেষ সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, সরকার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে সমর্থ হয়েছে, বিগত দুটো ওয়েভে কোনোবারই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েনি [৩] এতোদিন পর্যন্ত আদি করোনাভাইরাস দেশে ব্যাপক ক্ষতি সাধন না করলেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আসতে পারে বিপর্যয় [৪] এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে জেনম সিকোয়েন্সিংয়ের সংখ্যা খুবই নগন্য [৫] মহামারি থেকে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান পেতে টিকাই একমাত্র পন্থা [৬] অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন এবং ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্স এখন জরুরি, সময়মতো সঠিক মিটিগেশন মেজার নিলে হয়তো করোনার তৃতীয় ঢেউকে সহনীয় পর্যায় রাখা সম্ভব হবে।

[৭] বাংলাদেশে এখন করোনা পরিস্তিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। দেশের পশ্চিম এবং উত্তর দিকের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহে করোনা শনাক্তের হার গড়ে ২৫-৬৫ শতাংশ। প্রতিদিন কোভিডে মোট মৃত্যুর অর্ধেকই হচ্ছে এসব অঞ্চলে। এসব অঞ্চলের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। (এক) ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতি। (দুই) স্বাস্থ্যবিধি না মানা এবং (তিন) ওসব অঞ্চলের মানুষের শরীরে করোনারভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটির অভাব। মহামারীর প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ হয়েছিলো মূলত ঢাকা এবং এর নিকটবর্তী জেলাসমূহ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ফলে ওসব অঞ্চলের মানুষের শরীরে কিছু ইমিউনিটি তৈরি হলেও করোনা প্রতিরোধে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষেরা অনেকটাই আনকোরা। অন্যদিকে ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্ট পূর্বের মূল ভাইরাসের চেয়ে অনেক দ্রæত রোগ বিস্তার করে। এ কারণেই এখনকার সংক্রমণ এতো দ্রæত ছড়াচ্ছে।

[৮] আসলে গোটা বিশে^র যা অবস্থা এবং ভারতের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা যা দেখলাম, সেই বিচারে বাংলাদেশের করোনা পরিস্তিতি অনেকটাই ভালো বলতে হবে। সরকার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউ বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে সমর্থ হয়েছে। বিগত দুটো ওয়েভে কোনোবারই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েনি। তবে সরকার শুরু থেকেই যেসব দিকে অনেকটা পিছিয়ে আছে, তার মধ্যে প্রধান দুটি হলো পর্যাপ্ত টেস্ট এবং ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্স। এ বছরের শুরু থেকে করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পরছে গোটা বিশে^ই। অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্ট আবার অতিসংক্রামক এবং ভ্যাকসিনবিরোধী। অন্য দেশ থেকে আমাদের দেশে এসব ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করছে কিনা তা দেখার জন্য ভ্যারিয়েন্ট সার্ভাইল্যান্সের কোনো বিকল্প নেই। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে জেনম সিকোয়েন্সিংয়ের সংখ্যা খুবই নগন্য। এ কারণেই আমরা দেখেছি বাংলাদেশে একের পর এক করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতি।

[৯] ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয় শুরুতে সরকার বেশ দক্ষতার সঙ্গে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছিলো। তবে পরবর্তী সময়ে ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাংলাদেশ বেকায় পরে যায়। দেশব্যাপী টিকা কার্যক্রম থমকে যায় হঠাৎ করেই। তবে সরকার কিন্তু এই সমস্যা মোকাবেলায় চেষ্টা করছে অন্য কোম্পানি থেকে ভ্যাকসিন ক্রয়ে। এরই মধ্যে যোগাড় করে ফেলেছে প্রায় দশ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও হয়তো সরকার এবং প্রবাসীদের উদ্যগে আরও ১০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এসে যাবে দ্রæতই। তবে বাংলাদেশের জন্য ভ্যাকসিন লাগবে অন্তত ১৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ শতাংশ মানুষকে এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং টিকা প্রদানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

[১০] সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী কিন্তু অত্যন্ত কার্যকরী একটা পদ্ধতি। মহামারীর ঢেউ যখন দ্রæত বাড়তে থাকে তখনই লকডাউন দেওয়া হয়। লকডাউন হতে পারে অঞ্চলভিত্তিক, আবার হতে পারে দেশব্যাপী। তবে লকডাউনে জনজীবন এবং অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর এ কারণেই লকডাউন হচ্ছে মহামারী দমনে সর্বশেষ প্রশমন পদ্ধতি। এখন যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে করে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনই বেশি উপোযোগী। যেসব জেলাগুলোতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পরেছে সেসব জেলাগুলোকে কন্টেইনমেন্টের আওতায় এনে ভ্যারিয়েন্টের আন্তজেলা বিস্তার রোধ করা যেতে পারে। তবে মহামারী থেকে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান পেতে টিকাই একমাত্র পন্থা।

[১১] এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যু অপেক্ষাকৃত সহনীয় পর্যায় আছে বলেই আমার কাছে মনে হয়। আমাদের পাশর্^বর্তী ভারতে করোনার যে বিপর্যয় আমরা দেখেছি, সেই তুলনায় আমরা অনেকটাই ভালো আছি। কেন বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণ অপেক্ষাকৃত কম তা বলা মুশকিল। তবে যেকোনো সময় অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ জেঁকে বসেছে। এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি আমাদের গোত্রের মানুষকে সংক্রমণ করছে বেশি। সুতরাং এতোদিন পর্যন্ত আদি করোনাভাইরাস আমাদের দেশে ব্যাপক ক্ষতি সাধন না করলেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আসতে পারে বিপর্যয়।

[১২] বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়া রোধ করা। আমরা এতোদিন জানতাম যে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট বা আলফা ভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে সবচেয়ে সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট, যা মূল ভাইরাসের চেয়ে ৫০-৭০ শতাংশ দ্রæত সংক্রমণ ছড়ায়। তবে যুক্তরাজ্যের সা¤প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আলফা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও ৫০-৬০ শতাংশ দ্রæত গতিতে ছড়ায়। এছাড়া এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকরিতাও কিছুটা কমে গেছে। পাবলিক হেলথ্ ইংল্যান্ডের সা¤প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের দুটো ডোজে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে কার্যকারিতা মাত্র ৬০ শতাংশ। পূর্বে মূল ভাইরাসের বিপরীতে এই কার্যকারিতা ছিল ৮৩ শতাংশ। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হওয়া সংক্রমণের ঢেউ অস্বাভাবিক রকম বড় হতে পারে যা আমরা দেখেছি ভারত এবং নেপালে। বাংলাদেশের রাজশাহী এবং খুলনা অঞ্চলে আমরা দেখছি অতি দ্রæত সংক্রমণ বিস্তার করছে। এর পেছনে দায়ী হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। অতএব এ ভাইরাসটি যদি দেশের মধ্যাঞ্চল তথা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তাহলে মহামারীর তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে।

[১৩] বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রমে নিবন্ধনের দরকার আছে। তবে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি আরও সরল করা যেতে পারতো। এছাড়াও মোবাইলে শুধু এসএমএস-এর মাধ্যমে নিবন্ধনের পদ্ধতি চালু করা যেতে পারতো। যারা নিবন্ধন করতে সক্ষম নয়, তাদের জন্য অন্য পদ্ধতি, যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে পাশাপাশি।

[১৪] আমার কাছে মনে হয় চীনা এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া ঠিক হয়েছে। চীনা ভ্যাকসিন সিনোফার্ম এবং সিনেভ্যাক বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে এরই মধ্যে। সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা একাত্তর শতাংশ এবং সিনোভ্যাকের কার্যকারীতা ৫১-৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা ৯১ শতাংশ। [১৫] যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন তাদের প্রথম ডোজের ৮-১২ সপ্তাহের ভেতরে অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজটি নিতে হবে। এক অ্যাস্ট্রাজেনকা, আরেক ডোজ অন্য টিকাÑ এভাবে টিকা গ্রহণ করা যাবে না।

[১৬] গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ লম্বা সময় নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ যদি নিজেস্ব প্রযুক্তিতে নিজেদের ভ্যাকসিন নিজেরাই তৈরি করতে পারে, তাহলে দেশের ব্যাপক ভ্যাকসিন চাহিদা মেটাতে দেশীয় কোম্পানি বেশ বড় ভ‚মিকা রাখতে পারতো। ভারত এবং ইরান কিন্তু এরই মধ্যে তাদের নিজস্ব কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলেছে।

[১৭] সময়মতো সঠিক মিটিগেশন মেজার নিলে হয়তো করোনার তৃতীয় ঢেউকে সহনীয় পর্যায় রাখা সম্ভব হবে। মানুষের ভেতরে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাদের অবহিত করতে হবে যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অত্যন্ত ছোঁয়াচে, ফলে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। জনগণ যদি সচেতন না হয় এবং সময়মতো যদি সঠিক মিটিগেশন মেজার না নেওয়া হয়, তাহলে মহামারীর তৃতীয় ঢেউ মারাত্মক আঁকার ধারণ করতে পারে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যে কতোটা ভয়ানক হতে পারে তা আমরা দেখেছি ভারত এবং নেপালে। যেসব জেলায় যতো তাড়াতাড়ি দেশের মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে ততো তারাতারি আমরা করোনা বিদায় জানাতে পারবো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়