লিহান লিমা: [২] দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। এর প্রেক্ষিতে অনেক সমালোচক শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে লিজ দেয়ার ঘটনা তুলে ধরে বলছেন, চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা দেশকে চীনের ঋণের জালের ফাঁদে ফেলবে।
[৩] ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিন্ম মধ্যআয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার তিনটি শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এই তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে।
[৪] ১৯৯৯ সালে শ্রীলংকা মধ্যআয়ের দেশের মর্যাদা পায়। কিন্তু ভুল অর্থনৈতিক নীতি দেশটিকে অর্থনৈতিক মন্দায় ফেলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ধার দিতে সম্মত হয়েছে যা দেশটিকে নিজেদের টলটলায়মান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।
[৫] নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের বিষয় কিন্তু একই সঙ্গে আসন্ন দিনের অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে বাংলাদেশকে শ্রীলংকার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
[৬] বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার অর্থনৈতিক দুর্বলতার জায়গাটি একইরকম। দুই দেশেই কর ও জিডিপি অনুপাত প্রত্যাশিত নয়। এই দুই দেশের অর্থনীতিই একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল-বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও শ্রীলংকা পর্যটনের ওপর। বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর হলো যখন শ্রীলংকা নিজেদের অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তখন বাংলাদেশের কাছে আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ঠ সময় রয়েছে।
[৭] ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এলডিসিভূক্ত দেশহিসেবে বিশ্বব্যাংক (ডব্লিউবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) সহ বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলির কাছ থেকে সর্বনিম্ন সুদের হারে ঋণের সুবিধা পাবে। বর্তমানে ডব্লিউবি, আইএমএফ’এর মতো দাতারা ২ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। এই ঋণগুলো ২৫-৪০ বছর মেয়াদী, এগুলোর ছাড়ের সময়কাল ১০-১২ বছর পর্যন্ত। ২০২৭ সালের পর বাংলাদেশকে উচ্চতর সুদের হার দিতে হবে।
[৮] শ্রীলংকা যেহেতু একটি মধ্যম আয়ের দেশ তাই তাদের উচ্চ সুদের হার প্রদান করতে হয় এবং দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ পরিশোধের জন্য সময়ও কম পায়। এছাড়া শ্রীলংকা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বন্ডের মাধ্যমে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নেয়। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, শ্রীলংকা সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে যে ঋণ গ্রহণ করেছে তা দেশটির বর্হিঋণের প্রায় ৫০ভাগ।
[৯] দাতা সংস্থাগুলোর থেকে ঋণ গ্রহণ আর সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। দাতা সংস্থাগুলো নমনীয় শর্তে, কম সুদে ও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ প্রদান করে। অন্যদিকে বন্ড লোন দেয়া হয় উচ্চ সুদ, কম সময় ও এর কোনো ছাড়ের সময়সীমা নেই। সাধারণত এই লোন ১০ বছরের মধ্যেই পরিশোধ করতে হয়।
[১০] স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যমআয়ের দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য এই পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকেও শ্রীলংকার মতো অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হবে। তবে বাংলাদেশ বিদেশী ঋণে ভারাক্রান্ত এ প্রচলিত ধারণাটি ভুল। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এর ‘বাংলাদেশে বাহ্যিক সম্পদের প্রবাহ’ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১২-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বাহ্যিক ঋণ ছিলো ৪৪০৯.৫১ কোটি মার্কিন ডলার (৩,৭৪,৮৯৮.৩৫ কোটি টাকা)। এই হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যা মাথাপিছু হারে ঋণ ২৩,৪২৫ টাকা।
[১১] আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, কোনো দেশের ঋণ কেবলমাত্র তখনই বিপজ্জনক হয় যখন বর্হিঋণ জিডিপির ৪০শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশেল মোট বার্হিক ঋণ জিডিপির ১৫ শতাংশেরও কম, যা বিপদচিহ্ন থেকে অনেক দূরে। মজার বিষয় হলো, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বর্হিঋণ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, যা দেশটির জিডিপির ১০২ শতাংশ। তবে দেশটির অর্থনৈতিক গতির পেছনে রয়েছে মার্কিন ডলারের মূল্যমান।
[১২] চীনের ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলংকার মতো হবে এমন প্রচারণা রয়েছে। বাংলাদেশের বর্হিঋণের বেশিরভাগই ব্যবহৃত হয় ঘাটতি বাজেট মেটাতে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ বর্হিঋণের ৩৮শতাংশ বিশ্বব্যাংক থেকে, ২৪.৫ শতাংশ এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক থেকে, ১৭ শতাংশ জাপান থেকে, ৩ শতাংশ চীন ও ১ শতাংশ ভারত থেকে গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ঋণের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা থেকে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘কৌশলগত সম্পর্ক’তে রুপান্তরিত করে। সম্প্রতি এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো দক্ষিণ এশিয়ায়ও চীনের তহবিল বাড়ছে। এটি বাংলাদেশের মতো দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দেশের জন্য একটি ভালো সুযোগ কারণ চাইনিজ ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স (ডিএফআই) বাংলাদেশকে ঋণের বিকল্প উৎসের সন্ধান করে দিয়েছে। চীনা ডিএফআইগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই বিকল্প তহবিল উৎস তৈরি করেছে। এখন ভারত ও জাপান বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার সময় নমনীয় শর্তের দিকে মনোনিবেশ করেছে। তাই আর্থিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটি স্পষ্ট, বাংলাদেশ চীনের ঋণ জালের ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছে এটি মিথ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আপনার মতামত লিখুন :