শিরোনাম
◈ চট্টগ্রাম বন্দরে সাইফ পাওয়ার টেকের যুগের অবসান, এনসিটির দায়িত্বে নৌবাহিনী ◈ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজের খেলায় তালেবান, পেছনে চীন-রাশিয়া-ইরান-ভারত! ◈ পাকিস্তানকে ঠেকাতে গিয়ে ভারতে বন্যা, তোপের মুখে কঙ্গনা (ভিডিও) ◈ ৫ আগস্ট লক্ষ্য ছিল গণভবন, এবার জাতীয় সংসদ: নাহিদ ইসলাম (ভিডিও) ◈ গাজীপুরে মহানগর বিএনপির ৪ নেতা বহিষ্কার ◈ দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ : মির্জা ফখরুল ◈ রেস্ট হাউজে ‘নারীসহ’ ওসি, আটক করে ‘চাঁদা দাবি’ ছাত্রদল নেতার, সিসিটিভির ফুটেজ ফাঁস ◈ আর একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলে সীমান্ত অভিমুখে লংমার্চ: হুঁশিয়ারি নাহিদ ইসলামের ◈ ধামরাইয়ে ঋণ দেওয়ার কথা বলে গৃহবধুকে ধর্ষণ, আসামী গ্রেফতার ◈ গাজীপুরে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার বিএনপি নেতা স্বপন

প্রকাশিত : ৩১ মে, ২০২১, ০৪:০০ সকাল
আপডেট : ৩১ মে, ২০২১, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বদলে যাচ্ছে শিল্পাঞ্চল: শিল্প কমছেই বাণিজ্যিক ভবনের ছড়াছড়ি

নিউজ ডেস্ক: তেজগাঁও। নাম শুনলেই মাথায় চলে আসে শিল্প-কারখানার যন্ত্রের কর্কশ শব্দের আবহ। চোখে ভাসে ঘিঞ্জি বস্তির ছবি। রাজধানীর এই শিল্পাঞ্চলে একসময় ৮০ শতাংশ জায়গাজুড়ে ছিল কারখানার বহর। এখন সেখানে শিল্প-কারখানার সংখ্যা ১০ শতাংশের নিচে এসে ঠেকেছে। পুরো এলাকায় মোটে আট থেকে দশটি শিল্প-কারখানা সচল। সময়ের হাত ধরে সরকারের আধুনিক শহরের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সত্যিকারের দৃষ্টিনন্দন অঞ্চল হিসেবে বেড়ে উঠছে তেজগাঁও। আধুনিকতার মোড়কে বদলে যাচ্ছে এই শিল্পাঞ্চল। ওই এলাকায় এরই মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর। নতুন গড়ে উঠছে পাঁচতারা হোটেল, আধুনিক রেস্টুরেন্ট। সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে অনেক পুরনো ভবন।

সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে বিভিন্ন দপ্তর হয়ে শিল্প থেকে বাণিজ্যিক ভবনে স্থানান্তরের অনুমতি মেলে ১৩টি অট্টালিকার। অনুমতির জন্য আবেদন জমা আছে আরো অর্ধশতাধিক। অনুমতি পাওয়া সব কটি ভবনই এখন বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে; যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শোরুম ও মার্কেটই বেশি। যদিও সরকারি আবাসন ও বাণিজ্যিক ভবন এই তালিকার বাইরে। তাই মূল পরিবর্তিত সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি।

শিল্প-কারখানা মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, তেজগাঁওকে ঢেলে সাজানোর সরকারি সিদ্ধান্তের পরপরই অনুমতি না পেলেও অনেকেই বাণিজ্যিক ও আবাসিক হিসেবে ভবন ব্যবহার শুরু করেছে। এর প্রকৃত সংখ্যা কারো কাছে নেই। রাজউক হয়ে মন্ত্রণালয় ঘুরে বৈধ অনুমোদনের ব্যাপারটি দীর্ঘসূত্রতার গ্যাঁড়াকলে পড়ায় অনেকে এমনিতেই পুরনো ভবনগুলো বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করছে।

বদলে যাওয়া অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নকাজ। যেখানে একসময় এলাকাবাসীকে কারখানার ময়লা পানিতে ভোগান্তিতে পড়তে হতো, এখন মানসম্মত ড্রেনেজ লাইন আর স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় ভোগান্তি অনেকটা কমে এসেছে। তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া, ১২ নম্বর বেগুনবাড়ী, উত্তর ও দক্ষিণ বেগুনবাড়ী, পদ্মা গার্মেন্টস, নাসা গার্মেন্টস, সুজুকি মোটরসহ বিভিন্ন এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা পাল্টে গেছে। তবে সিদ্দিক মাস্টার ঢাল এবং দক্ষিণ বেগুনবাড়ী মাতৃছায়া এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার এখনো উন্নতি হয়নি। যদিও স্থানীয় কাউন্সিলর জানিয়েছেন, সব কটি এলাকার ড্রেনের জন্য বাজেট পাস হয়ে আছে। কিছুদিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।

রাজধানীর আবাসন সমস্যা মাথায় রেখে এবং শিল্পাঞ্চল শহর থেকে দূরে রাখতেই তেজগাঁও নিয়ে মহাপরিকল্পনা করে সরকার। সে অনুযায়ী তেজগাঁওয়ের ৫০০ একর ২০ শতাংশ জমি ঘিরে নতুন নতুন কর্মপন্থা হাতে নেয়। এর আগে ১৯৫০ সালে এই জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছিল সরকার। ৭০ বছর পর সেই জমিতেই ভারী শিল্প-কারখানার বদলে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত আসে। তেজগাঁওয়ের এই জমিতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্লট রয়েছে ৫৯১টি। এর মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্লট ১৮১টি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্লট ৪১০টি। মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই এলাকাকে শিল্পের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও আবাসিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০১৪ সালের অক্টোবরে মন্ত্রিসভা একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এরপর মন্ত্রিসভার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি কাজ করে।

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তত্কালীন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে সভাপতি করে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ২০ জুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই এলাকার ভূমি শিল্প কাম বাণিজ্যিক ও আবাসিক প্লট হিসেবে রূপান্তর করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত হওয়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের রূপান্তরিত প্লটসংক্রান্ত খসড়া বিধিমালায় ওই এলাকায় যত খুশি তত উচ্চতার বাণিজ্যিক ভবন করার সুযোগ রাখা হয়। তবে এ জন্য জুড়ে দেওয়া হয় কিছু শর্ত। অনুমোদনের পর তখন ইমারত নির্মাণের মূল বিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলে কেউ কেউ।

এর আগে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধনের পরই নগরবাসীর ব্যবহারের জন্য সেটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হলেও বেগুনবাড়ীর বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য কোনো সড়ক ছিল না। পরে বিষয়টি চিন্তা করে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে এলাকাটিতে একটি নতুন সংযোগ সড়ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ৬০ ফুট প্রশস্ত সড়কটি ঘিরে এলাকাবাসী ছিল বেশ উত্ফুল্ল। তবে সম্প্রতি সড়কের জায়গা থেকে অবৈধ উচ্ছেদের পর তেজগাঁওয়ের আধুনিক নগরের বিষয়টি আরো এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ড্রেনেজ ও সীমানাপ্রাচীরের কাজ। সড়কে পড়েছে কংক্রিট। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা।

এ ব্যাপারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী এবং হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, ‘রাস্তার জায়গা দখলমুক্ত করতে লম্বা সময় লেগেছে। দীর্ঘ সময় পর হলেও উচ্ছেদের মাধ্যমে সেটি উদ্ধার করা গেছে। রাস্তার কাজও শেষের দিকে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই উদ্বোধনের আশা করছি।’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সফি উল্লা বলেন, ‘শিল্পাঞ্চল থেকে বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের অনুমোদন এলাকাবাসীর পাশাপাশি শিল্প মালিকরাও চাচ্ছিলেন। এখন পরিবর্তন শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক আর আবাসিক ভবন করার জন্য আবেদন করা হচ্ছে। যোগাযোগের উন্নয়নে ইতিমধ্যে ১২০ কোটি টাকার অনুমোদন হয়েছে। আহ্বান করা হয়েছে দরপত্র।’ তিনি আরো বলেন, ‘তেজগাঁওবাসীর সুবিধার কথা চিন্তা করে সড়ক উন্নয়ন, সড়ক বাতি, ফুটপাত উচ্ছেদসহ বহুমুখী কাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাতিরঝিলের সংযোগ সড়ক বউবাজারের বেগুনবাড়ী সড়কটি। দ্রুতই রাস্তাটি খুলে দিলে এর সুফল পাবে এলাকাবাসী।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বউবাজার, রানার গ্রুপ ও বেগুনবাড়ী এলাকার হাজার হাজার মানুষের সুবিধার্থে সরু গলি পথের পাশে করা হচ্ছে ৬০ ফুট প্রশস্ত সড়ক। তেজগাঁওয়ে রূপালী ব্যাংকের সামনের প্রশস্ত সড়ক দিয়ে ঢুকতেই বাঁ পাশে চলছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছয়টি বহুতল ভবনের কাজ। এর মধ্যে দুটি ১২ তলা আর চারটি ১৩ তলা। ভবনগুলো বাস্তবায়নে কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। একটু সামনে যেতেই রিগান ক্যাফে রেস্টুরেন্টসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। লাভ রোড নামে পরিচিত সড়কটির দুই পাশে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও সরকারি দপ্তর দেখা গেল। এর মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, সরকারি দুটি হাসপাতাল ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের শিক্ষার্থীদের আবাসিক ভবন ও আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, এমএইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ, আইডিয়াল প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাই স্কুল, তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যতম। ভবন নির্মাণের কাজ চলছে সড়ক ও নিরাপত্তা বিভাগের সংরক্ষণ অফিসের। তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের পাশে শান্তা হোল্ডিংসের বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে।

পুরো তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ঘুরে সিদ্দিক মাস্টার ঢাল, দক্ষিণ বেগুনবাড়ীর কয়েকটি আট ফুট সড়ক ছাড়া বেশির ভাগ সড়কই প্রশস্ত দেখা গেছে। কলোনি বাজার এলাকায় রিকশাচালক আহমদ মিয়া বলেন, ‘এই জায়গায় রাস্তায় বইসা থাকতে হয় না। আগে পুরান ঢাকায় রিকশা চালাইতাম। পরে অন্যগো কাছে শুইনা এদিকে আসছি। তয় কিছু রাস্তা ভাঙ্গাচুরা আছে।’

সূত্র জানায়, খসড়া বিধিমালায় রূপান্তরিত প্লটে নির্মিত ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ ব্যবস্থা, ভবনের বাইরের খোলা জায়গায় বৃক্ষরোপণ, স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, ৫০০ বা এর বেশি আবাসন ইউনিটবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেসিন ও গোসলের পানি পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। ভবনে সৌরবিদ্যুত্ উত্পাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী প্লটের সঙ্গে ৬০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকলে যেকোনো উচ্চতার বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করার বিষয়টি ছিল, যেখানে তেজগাঁও এলাকার বেশির ভাগ রাস্তা ৮০ ফুট প্রশস্ত।

এ ব্যাপারে এনআরবি গ্রুপের প্রকৌশলী নুরুল আক্তার বলেন, ‘শিল্পাঞ্চল থেকে বাণিজ্যিক ও আবাসিকের বিষয়টির পরিকল্পনা অনেক আগের করা; যেখানে আধুনিক একটি শহরের চিন্তা করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি সম্পর্কে আমরা জেনেছি। তবে শিল্পাঞ্চলের নির্দিষ্ট জায়গা ও বাইরের ভবন করতে কিছু শর্ত এবং সুযোগ-সুবিধা রেখে করতে হবে।’

এ ব্যাপারে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ এমপি বলেন, ‘সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে সরকারের সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তেজগাঁও এলাকার পরিবর্তিত রূপের সঙ্গে উন্নয়নেরও পরিবর্তন আসবে। তবে মনে রাখতে হবে, শিল্পাঞ্চল হোক আর বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক, পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে বাসিন্দাদেরই।’ - কালের কণ্ঠ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়