কামরুল হাসান মামুন: ঘুম থেকে উঠেই বেশ কয়েকটা মেসেজ পেলাম। সবগুলোই একই বিষয়ে। যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়েন তারা নিশ্চই জানেন যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিশেষ আশাবাদী ছিলাম।
এই বিশ্ববিদ্যালয় যখনই কোন ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই স্টেটাস লিখে তার প্রশংসা করেছি এবং উৎসাহিত করেছি। এতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। যার জন্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমি আশাবাদী হয়ে উঠছিলাম সেই মানুষটি হলো মাহবুব মজুমদার।
মাহবুব মজুমদার কেবল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কেই সার্ভ করেনি বিনে পয়সায় গণিত অলিম্পিয়াডের মেন্টর ও কোচ হয়েও কাজ করে বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার মত বিশ্বমানের কোচিং এর কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড এমআইটিতে ভর্তি হচ্ছিল।
আর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাহবুব মজুমদার কি করেছে তা দেখে এবং জেনে আমি অভিভূত হই। এই প্যান্ডেমিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষকদের বেতন পর্যন্ত ঠিকমত দিতে পারতো না। এই পরিস্থিতির ব্যতিক্রম ছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
মাহবুব মজুমদারের একক প্রচেষ্টায়। গত বছরের গ্রীষ্মে মাহবুব মজুমদার যখন আমেরিকায় ছিলেন তখন সে এমআইটির সাথে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশে প্রথম ইন্টিগ্রেটেড অনলাইন প্লাটফর্ম চালু করেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে BU-X!
এছাড়া কেবল মাহবুব মজুমদারকে দেখে বাংলাদেশের ভালো স্কলাররা যারা বিদেশে ছিল তারাও দেশে ফিরে আসতে শুরু করে। যারা ইতিমধ্যেই ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে অন্যতম Tibra Ali! সে বিশ্বখ্যাত পেরিমিটার ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে এসেছে। তীব্র নিজেই বলে তার ফিরে আসার জন্য যে সবচেয়ে বেশি মোটিভেট করেছে সে হলো মাহবুব মজুমদার।
এছাড়া আমার জানা মতে আরো অনেকেই আসার জন্য পাইপ লাইনে ছিল। তাছাড়া কেবল মাহবুব মজুমদারকে দেখে গণিত অলিম্পিয়াডে মেডেল পাওয়া অনেকেই আমেরিকায় না গিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শুরু করেছে।
কে এই মাহবুব মজুমদার? মাহবুব মজুমদার আমেরিকায় জন্ম নেওয়া বাংলাদেশী পিতামাতার সন্তান। স্কুলে পড়াকালীন সময় মাহবুব দুই দুইবার প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।
সে আন্ডারগ্রাজুয়েট করেছে এমআইটি থেকে, মাস্টার্স করেছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান পড়তে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় এবং সেখান থেকে পিএইচডি ও প্রফেসর সালাম যেখানে শিক্ষক ছিলেন সেই ইম্পেরিয়াল কলেজে পোস্ট-ডক করেছেন। এতকিছু করে স্বেচ্ছায় তার বাবা মায়ের দেশে চলে এসেছেন। এসে আমাদের স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করেন।
সে একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য দরখাস্ত করেছিল। তৎকালীন প্রশাসন তাকে শিক্ষক হিসাবে নেয়নি। কেন নেয়নি? অজুহাত দেখিয়েছে তার আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রী ফিজিক্সে না। এইবার বুঝুন কেমন মানুষদের আমরা ভিসি প্রোভিসি বানাই আর কাদের আমরা নিয়োগ বোর্ডের সদস্য বানাই।
তাকে মাপার যোগ্যতাই ওই বোর্ডের ছিল না। যার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আমিআইটিতে ডিগ্রী স্বত্বেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Department of Applied Mathematics and Theoretical Physics (DAMTP) তাকে ভর্তি করতে পারে এবং তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি দিতে পারে তাকে যদি তোমারতো ভাই ফিজিক্সে আন্ডারগ্রাজুয়েট নাই এই বলে ফিরিয়ে দেই কেমন শোনায়? কেমন লাগে? প্রফেসর ডিরাকের আন্ডারগ্রাজুয়েট ছিল ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ।
সেই ডিরাক সর্বকালের সেরা পদার্থবিদদের একজন। গণিতে ফিল্ড অ্যাওয়ার্ড পাওয়া প্রফেসর এডওয়ার্ড উইটেন এর আন্ডারগ্রাজুয়েট ছিল সাইন্স কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এও না।
তার আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রী ছিল আর্টসে। সেই এডওয়ার্ড উইটেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন এবং এখন বিশ্বসেরা পদার্থবিদ। যারা ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা আর্টস পড়েও ফিজিক্সে পিএইচডি করতে পারে তাদের ফ্লেক্সিবিলিটি কোন পর্যায়ে সেইটা মাপতে পারার মত যোগ্য শিক্ষকদের আমরা ভিসিও বানাই না আর নিয়োগ বোর্ডের সদস্যও বানাই না তাই সেই লেভেলের শিক্ষকও আমরা পাই না। তারাতো হীনমন্যতায় ভুগে।
আজকে শুনলাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় মাহবুব মজুমদারকে ডাটা সাইন্স ও সাইন্স ফ্যাকাল্টির ডিন পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে বা সাসপেন্ড করেছে। শুধু তাই না। একই সাথে এসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (একাডেমিক) পদ থেকেও সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমার মতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির চাকাটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো।
যারা মাহবুব মজুমদারকে চেনে না তারা কল্পনাও করতে পারবে না কি মডেস্ট একটি মানুষ। আমাদের ইয়ং মাইন্ডদের উপর সে কি পরিমান ইনফ্লুয়েন্স করতে পারে। কথাবার্তা কাজে কর্মে অসম্ভব সৎ এবং ভালো মানুষ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের পরে হয়ত আমরা তাকে হারিয়ে ফেলব। আসলে এতদিন সে কিভাবে এই দেশে survive করল সেটাই আশ্চর্য।
আমি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা সুযোগ হিসাবেও দেখি। সারা পৃথিবীর বিশ্ব মানের বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষক হান্ট করে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এই সুযোগটা নিতে পারে। আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা হতাম যত দ্রুত সম্ভব তার সাথে যোগাযোগ করে দরকষাকষি করে নিয়ে আসতাম।
এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ১০০ বছর পূর্তি উদযাপনটা মহিমান্বিত করতে পারতো। তবে আমি জানি এইটা বর্তমান বাস্তবতায় অবাস্তব চিন্তাভাবনা। কিন্তু তবুও কল্পনা করতে ভালো লাগে।
গত ১০০ বছরে যত খারাপ কাজ করেছি সেটাকে neutralized করতে এই সিদ্ধান্ত অনেকটা সহায়ক হতো। মাহবুব মজুমদার আসা মানে আরো অনেক যোগ্য শিক্ষকদের আসা। আশা করি আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টা ভেবে দেখবেন। আমাদের নতুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে কিছু একটা করেন।