নিউজ ডেস্ক: ঈদের সালামি মানে নতুন টাকা। বিশেষ করে ছোটদের ঈদ আনন্দ বড় হয়ে ওঠে নতুন টাকার সালামিতে। এ জন্য ঈদ এলেই বেড়ে যায় নতুন টাকার চাহিদা। করোনার কারণে এবার সর্বসাধারণের মাঝে নতুন টাকা বিনিময় বন্ধ থাকলেও মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশে (সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে) ও গুলিস্তানের ফুটপাতে দেদার বিক্রি হচ্ছে ঝকঝকে নতুন টাকার নোট। ছোট ছোট টুল ও ফলের ঝুড়ি উল্টো করে বিভিন্ন মূল্যমানের নতুন টাকা সাজিয়ে বিক্রি করছেন দোকানিরা। নিয়মিতদের পাশাপাশি মৌসুমি কারবারিরাও এ ব্যবসায় নেমেছেন। অনেকেই নতুন টাকা কিনতে আসছেন। এ জন্য ১০ থেকে ২০০ টাকা মূল্যমানের একটি নতুন নোটের পেছনে দুই থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে।
এদিকে ফুটপাতে নতুন টাকার কারবার ঘিরে ডিল মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি চক্র। ওই চক্রের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু বাড়তি টাকার বিনিময়ে নানা পন্থায় চক্রের সদস্যদের কাছে নতুন টাকা সরবরাহ করা হয়। সারা বছরই এ ধরনের বাণিজ্য চললেও নীরব বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবার ঈদের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছাড়ে। এবারও ছেড়েছে। তবে করোনার সংক্রমণ রোধে এবার ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন টাকা বিনিময় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিবর্তে লেনদেনের সময় গ্রাহকদের নতুন টাকা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। নতুন টাকার বিনিময় বন্ধ রাখার পরও ফুটপাতের ব্যবসায়ীর কাছে কিভাবে আসছে কাঁড়ি কাঁড়ি নতুন টাকা। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রবিবার দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বললে তাঁরা মতিঝিলে সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ ও সংবাদপত্র নামে পত্রিকার স্টল দেখিয়ে বলেন, ওই স্টলে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে ওই স্টলের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মানুষের জট লেগে আছে। দোকানের ভেতরে তিনজন কাজে ব্যস্ত। একজন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট গুনছেন। তাঁর হাতের পাশেই রাখা কয়েকটি বড় ব্যাগ। ততক্ষণে তিনি একজনের কাছে চার লাখ টাকার নতুন নোট বিক্রি করলেন। গ্রাহক সেজে ওই ব্যক্তির ভিজিটিং কার্ড সংগ্রহ করার পর বিষয়টি আরো স্পস্ট হলো যে উনিই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে নতুন টাকার বেশির ভাগই সরবরাহ করে থাকেন। তাঁর কার্ডে লেখা ডিল মোহাম্মদ, প্রপাইটর ডিনা এন্টারপ্রাইজ। কার্ডের বাঁ পাশে লাল কালিতে লেখা প্রাইজ বন্ড ক্রয়-বিক্রয়। আর নিচে সবুজ কালিতে লেখা—এখানে ছেঁড়া, ফাটা, পোড়া ও নতুন টাকা বদলানো হয়। ঠিকানা দেওয়া আছে, ১০ টয়েনবি সার্কুলার রোড, ঢাকা।
দোকানে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে নতুন টাকার খুচরা এক বিক্রেতাকে ওই কার্ড দেখিয়ে একে চেনেন জিজ্ঞাসা করতেই বলে ওঠেন, ‘চিনব না। উনিই নতুন টাকার কারবারিদের গদফাদার।’ উনি নতুন টাকা কোথা থেকে পান প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন।’
বিকেল পৌনে ৪টার দিকে গ্রাহক সেজে ডিল মোহাম্মদকে ফোন করে নতুন টাকা পাওয়া যাবে কি না জানতে চাইলেন তিনি বলেন, ‘আপনি কে, আপনার দোকান কোথায়?’ আমি বললাম আমি মৌসুমি ব্যবসায়ী, বসুন্ধরা এলাকা থেকে বলছি। তিনি বললেন তাহলে আজ নতুন টাকা দেওয়া সম্ভব না। কাল (আজ) দেওয়া যাবে, এতটুকু বলেই ফোন কেটে দেন। পরে আবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন টাকার বিনিময় বন্ধ রাখার পরও ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছে কিভাবে নতুন টাকা যাচ্ছে প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এটা নতুন জিনিস না। যুগ যুগ ধরেই এ রকম হয়ে আসছে।’ এতটুকু বলেই তিনি তাঁর বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মাকসুদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মাকসুদুজ্জামান বলেন ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এভাবে নতুন টাকা বের হওয়ার সুযোগ নেই। তবে আমরা যখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে টাকা সরবরাহ করি, তখন নতুন টাকাও দেওয়া হয়। ওই টাকার একটা অংশ তাঁরা গ্রাহকদের না দিয়ে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকতে পারে। তিনি জানান, বিদ্যমান আইনে নতুন টাকা কেনাবেচা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় ফুটপাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এর আগে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে গিয়ে অন্তত নতুন টাকার ২০টি খুচরা দোকান দেখতে পাওয়া যায়। এখানে ৩০ বছর ধরে নতুন টাকা বিক্রি করছেন ষাটোর্ধ হুসনেআরা বেগম। তিনি বলেন, সারা বছরই তিনি নতুন টাকা বিক্রি করেন। তবে ঈদের আগে নতুন টাকা বিক্রি বেশি হয়। কোথা থেকে সংগ্রহ করেন প্রশ্ন করতেই তিনিও বলেন, ‘যান যান (পত্রিকার ওই স্টল দেখিয়ে) ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন।’
নতুন টাকার কেনাবেচা হয় রাজধানীর গুলিস্তানেও। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনেই রয়েছে নতুন টাকার প্রায় ৪০টি দোকান। দুপুর পৌনে ১টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, ভিড় করেছে ক্রেতারা। রাজধানীর সবুজবাগ থেকে এসে বেসরকারি চাকরিজীবী সোলায়মান সেখ দোকানির কাছ থেকে ১০ টাকার এক বান্ডেল কিনলেন। ১০ টাকার বান্ডেলে অতিরিক্ত ২০০ টাকা গুনতে হয়েছে তাঁকে। তিনি বলেন, তাঁর বোন ও ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের ঈদের সালামির জন্য তিনি নতুন টাকা সংগ্রহ করতে এসেছেন। এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সময় দেখা গেল, কিছু ভাসমান পাইকারি বিক্রেতা দোকানে দোকানে গিয়ে নতুন টাকা লাগবে কি না জিজ্ঞাসা করছেন। দোকানিদের উদ্দেশ করে কেউ কেউ বলছেন, কাল (সোমবার) ব্যাংক বন্ধ। তাই ব্যাংকের কর্মকর্তারা নতুন টাকার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
২৫ বছর ধরে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের ফুটপাতে নতুন টাকার ব্যবসা করেন আসলাম মোল্লা। বেচাকেনা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে এত দিন ব্যবসা তেমন জমেনি। তবে আজ (রবিবার) একটু ক্রেতা বেশি আসছেন।’
ফুটপাতে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ১০ টাকার। ১০ টাকার এক বান্ডেল (প্রতি বান্ডেলে ১০০টি নোট) ১১৫০ থেকে ১২০০ টাকা, ২০ টাকার এক বান্ডেল ২১৫০ থেকে ২১৮০ টাকা, ৫০ টাকার এক বান্ডেল ৫১৫০ থেকে ৫২০০ টাকা, ১০০ টাকার এক বান্ডেল ১০১৫০ থেকে ১০২০০ টাকা এবং ২০০ টাকার এক বান্ডেল ২০৩০০ থেকে ২০৫০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়।
-কালের কণ্ঠ