মাসুদ রানা: ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনাধীন যে-বিভিন্ন জাতি তাদের নিজ-নিজ ভাষায় কথা বলে, নিজ-নিজ সংস্কৃতির চর্চা করে, এবং নিজ-নিজ দেশে বাস করে, তাদেরকে একত্রে ‘ভারতীয় জাতি’ বলা ভুল। এমনটি বলা হচ্ছে একটা দীর্ঘ-লালিত হিন্দু-সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ, যা অতীতের তুর্কী-মুঘল ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে আগ্রহী।
‘ভারতীয় জাতি’ বলতে কোনো কিছু নেই, যদিও বহুবচনে ‘ভারতীয় জাতিসমূহ’ বলা যেতে পারে সে-অর্থে, যে-অর্থে আমরা ইউরোপীয় জাতিসমূহের কথা বলি। অর্থাৎ, ভারত-উপমহাদেশ বলতে যে প্রায়-মহাদেশ আছে, তার অন্তর্গত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন বাস করছে, যা তুর্কী-মুঘল-ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে পাওয়া এবং বর্তমানে নানা প্রান্তে সামরিক শক্তি-স্থাপনা করে ধরে রাখা হয়েছে।
ভারত-রাষ্ট্রের মতো পাকিস্তানও অভিন্ন তুর্কী-মুঘল-ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার ধারণ-করা রাষ্ট্র, যা তার শাসনাধীন বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিকে সামরিক শক্তির জোরে একটি অভিন্ন ‘পাকিস্তানী’ জাতি হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে শুধু একটি জাতি, খণ্ডিত হলেও, তাদের জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তাদের প্রাকৃতিক বাসভূমি বাংলার পূর্বখণ্ডে, যা প্রথমে ‘বাংলা দেশ’ ও পরে ‘বাংলাদেশ’ নাম পরিচিত, যদিও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ বলতে পূর্ব ও পশ্চিম-বাংলার মিলিত স্থল-জল-অন্তরীক্ষকে বুঝায়, যা উত্তর হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র-দু’টি তাদের নাগরিকদেরকে-যে সামরিক শক্তির জোরে যথাক্রমে ভারতীয় ও পাকিস্তানী জাতি বানানোর চেষ্টা করছে, তার ভাবাদর্শ হলো ধর্মবাদ। ভারত-রাষ্ট্র জন্ম থেকে অদ্যাবধি হিন্দু-ধর্মকে ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র নাম দিয়ে প্রকৃতপক্ষে একটি ‘হিন্দু-জাতি’ বানানোর চেষ্টা করছে। আর, পাকিস্তান শুরু থেকেই সরাসরি ধর্মের নামেই একটা মুসলিম-জাতি বানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সমগ্র বাঙালী জাতি যদি তাদের সমগ্র বাংলা নিয়ে একটি অভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রে বাস করতে পারতো, এ-জাতি তার উর্বর নদীমাতৃক ভূ-প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, অতীত ইতিহাস, বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এবং সর্বোপরি সংখ্যাগুরুত্বে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষাজনজাতি হওয়ার কারণে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে নয়, সমগ্র এশিয়া ও বিশ্বে একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী জাতি হিসেবে বিশ্বমানবতায় ও সভ্যতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতো।
দুর্ভাগ্যবশতঃ বাংলার ও বাঙালী জাতির বিভক্তির কারণে এ-দেশ ও জাতি তার শক্তিকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করে কাজে লাগাতে পারছে না। উপরন্তু, তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট নানাভাবে ও নানা মাত্রায় তাদের জাতিগত অস্তিত্বকেই হুমকির মধ্যে ফেলছে। বাঙালী জাতির মুসলিম-গরিষ্ঠ পূর্ব-বাংলা বা বাংলাদেশ প্রায়-ঔপনিবেশিক ধর্ম-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার কারণে তার বাঙালী আত্মপরিচয়ের সঙ্কটটি প্রধানতঃ অভ্যন্তরীণ, কিন্তু হিন্দু-গরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী কার্যতঃ হিন্দু সাম্রাজ্যবাদী ভারতের একটি উপনিবেশ হিসেবে অবস্থান করার কারণে, তাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে যাওয়ার একটি ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
আজ হিন্দু-গরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ শাব্দিক অর্থেই একটি হিন্দুস্থানী উপনিবেশ রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে তাদের এই সঙ্কট কিন্তু শেষপর্যন্ত হিন্দু-গরিষ্ঠ বাঙালীর সঙ্কট হিসেবে থাকবে না। এটি বিশ্ব-বাঙালীর অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি করতে পারে। অবস্থা সত্যিই খারাপ। এ-পরিস্তথিতিতে আমি মনে করি, ধর্মীয় পরিচয়কে গৌণ করে, ঐতিহাসিক ঋণাত্মক স্মৃতি ও অভিযোগ-পাল্টা-অভিযোগ ভুলে সমগ্র বাঙালী জাতিকে দূরদৃষ্টি নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার কথা ভাবতে হবে। আমি বিশেষভাবে মনে করি, মুসলিম-গরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের বাঙালীর এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। ইতিহাস তাদেরকে ইতোমধ্যে সেই নেতৃত্বের ভূমিকায় স্থাপন করেছে, আর কিছু না হলেও অন্ততঃ একটি স্বাধীন বাঙালী জাতি-রাষ্ট্রের মালিক হওয়ার কারণে। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
আপনার মতামত লিখুন :