রাশিদুল ইসলাম : [২] দু’কূল ভরা নদী পায়রা। গ্রীষ্মে জেগে ওঠা চর ভরবর্ষায় মুখ লুকোয়। জেলেদের ফেলা জাল ভরে ওঠে নদীর সোনালি শস্যে। ইলিশ বাংলাদেশের রফতানিকৃত অন্যতম পণ্যের নিশ্চিত আঁতুড় এই নদী। সম্প্রতি একে কেন্দ্র করেই ঘনিয়ে উঠেছে বিতর্ক। নেপথ্যে ছড়ি ঘোরাচ্ছে চীন। বাংলাদেশের পরিবেশবিদ ও সামাজিক সুরক্ষাকর্মীদের একটা বড় অংশ অন্তত এমনটাই অভিযোগ এনেছে। দি ওয়াল
[৩] বিষয়টা ঠিক কী? জানতে ফিরে যেতে হবে চার বছর আগে। ২০১৭ সালে পায়রা নদীর ধার ঘেঁষেই বড় মাপের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু করে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। নামে বাংলাদেশের ছোঁয়া থাকলেও এটি আদতে যৌথ উদ্যোগ। যার একদিকে রয়েছে বাংলাদেশি সংস্থা আইএসও টেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড। অন্যদিকে পাওয়ারচাইনার নজরদারি। হিসেবমতো উদ্যোগের ৯৬ শতাংশ শেয়ারই চীনা সংস্থার হাতের মুঠোয়। তাই পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের সিংহভাগই পাওয়ারচাইনা করে থাকে।
[৪] যার জেরে স্রেফ প্রভাব খাটিয়ে বরগুনা জেলার খোট্টার চর, যেখানে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি হচ্ছে, সেখানকার আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যূতের ভাঁড়ার বানানো হলে দেশের ইলেকট্রিসিটি সমস্যা চিরতরে নির্মূল হবে— এমন আশ্বাস শুনে এতদিন বহু পরিবারকে ভিটেমাটিছাড়া হতে হয়েছে। বদলে হাতে জুটেছে নামেমাত্র ক্ষতিপূরণ। এমনকী বাস্তুহারা মানুষদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, যে কাগজ দেখিয়ে তাঁদের সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, সেটাও আদতে ভুয়ো!
[৫] এই পরিস্থিতিতে হাত গুটিয়ে বসে নেই বাংলাদেশের জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন। সংস্থার প্রধান মুজিবর রহমান কাজ বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে জেলার শীর্ষ আধিকারিকদের দ্বারস্থ হন। খুলে দেখান ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে’র পাতা। যেখানে বলা হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে দিতে পারে, সরকারি কিংবা বেসরকারি— কোনও তরফের নির্মাণই বৈধ ও গ্রহণযোগ্য নয়। পায়রা নদীর প্রবাহ বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর জেরে ব্যহত হচ্ছে। তা ছাড়া যে কায়দায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেটাও আইনসম্মত নয়। তাই চীনা সংস্থাকে ফিরে যেতে বলা হোক।
[৬] কিন্তু প্রস্তাব শুনে বেঁকে বসেন খোদ জেলাশাসক হাবিবুর রহমান। তাঁর যুক্তি, ‘পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। আর যেখানে কেন্দ্রটি বসানো হচ্ছে, সেটাও কেনা জমি। সরকারি জমি জবরদখল করে নির্মাণ শুরু হলে আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারতাম। তাই এখন কাজ বন্ধ করা কিংবা বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণের সমস্যার কোনওকিছুতেই আমাদের অধিকার নেই।’
[৭] যদিও বাংলাদেশের সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত একাংশের মতে, সরকারি হিসেবে বিস্তর অসঙ্গতি রয়েছে। মোট ১২৫ হেক্টর জমির মধ্যে সংস্থাটি এখনও পর্যন্ত ৬৩ হেক্টর দখল করেছে। বাকিটা হাতে আনতে চলছে ভূমি উচ্ছেদ অভিযান। আপাতত ভুক্তভোগী ১৫৩টি পরিবার। বাসস্থান ছেড়ে এদিক সেদিক ছড়িয়ে গেছেন সকলে। আবার তাদের মধ্যে ১৪২টি পরিবার কার্যত ক্ষতিপূরণ ছাড়াই আস্তানা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ।
[৮] গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে পাওয়ারচায়না। এমনকী ঢাকায় সংস্থার অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাংবাদিকদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যদিও প্রকল্পের সুফল নিয়ে গোড়া থেকেই আশাবাদী তারা। এই প্রস্তাবিত প্রোজেক্ট বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে। এখনও পর্যন্ত দেশের ৯৪% নাগরিক বিদ্যুতের সুযোগ-সুবিধা পান। নয়া প্রকল্প সার্বিকভাবে জনসাধারণকে আলোর বৃত্তে আনবে বলে জানিয়েছে পাওয়ারচায়না।
[৯] কিন্তু এই ঘাটতি মেটানোর স্বপ্ন আখেরে কোনও ব্যাপকতর দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দেবে না তো? প্রশ্ন তুলেছেন দেশের পরিবেশবিদদের একাংশ। তাঁদের মতে, তালতোলির এই পাওয়ার প্ল্যান্ট কাজ শুরু করলে দৈনিক ৭ হাজার টন কার্বন নির্গমন হতে পারে। যা আশপাশের একাধিক অঞ্চল, বিশেষ করে লালদিয়া ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, ফতরার চর ফরেস্ট, টেঙ্গাগিরি অরণ্য এবং সোনাকাটা ইকো পার্কের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট।
[১০] শুধু তাই নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা দূষিত গরম জল পায়রা নদীর বুকে মিশে নদীর খাদ্যশৃঙ্খলকে নষ্ট করবে। বর্ষায় ভরে ওঠা রংচঙে ইলিশের ঝাঁক হয়তো আর দেখা যাবে না। যা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ধাক্কা হতে চলেছে।
আপনার মতামত লিখুন :