শিরোনাম
◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী 

প্রকাশিত : ০৩ মে, ২০২১, ০৫:৪২ বিকাল
আপডেট : ০৩ মে, ২০২১, ০৫:৪৪ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মুসলিম দেশে মদ-জুয়ার সমাহার!

আসাদুজ্জামান সম্রাট: মালয়েশিয়া ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে আমাদেও ভারত উপমহাদেশের অনেক পরে। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট দেশটি ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৩ সালে উত্তর বোর্নিও, সারাওয়াক ও সিঙ্গাপুর নিয়ে গঠিত হয় মালায়া ইউনাইটেড। সেখান থেকেই দেশটির নামকরণ করা হয় মালয়েশিয়া। মাত্র দুই বছর পরই ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়। স্বাধীন মালয়েশিয়া তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে যাত্রা শুরু করে আমাদের থেকে মাত্র ৬ বছর আগে। একই সময়ে যাত্রা শুরু হয় ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুরেরও। অথচ আজ তারা আমাদের থেকে কতো উন্নত ও সমৃদ্ধ। বিশ্ববাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে তাদের প্রভাবশালী অবস্থান। অথচ অনেক সম্ভাবনা থাকার পরেও আমরা কতো পিছিয়ে আছি।

রাতে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছে আক্ষেপ যেনো আরো বেড়েছে। ইমিগ্রেশনে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সঙ্গে মালয়েশিয়া পুলিশের ব্যবহার আমাকে যারপরনাই আহত করেছে। বিমান থেকে নামার পরে শ্রমিক ও ছাত্র ভিসায় যারা এসেছে তাদেরকে একটি লাইনে দাড় করিয়ে সবার ভিসা চেক করছে। আমাদের যাত্রা ছিল সোশ্যাল ভিসায়। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে একটি কনসার্টে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি। ফলে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা কোন বাক্য ব্যায় করলো না। খুব ভোরে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে পৌছে মোবাইলের সিম কার্ড নিয়ে শহরমুখী হলাম। মূল শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বিমান বন্দর। আমাদের যাত্রা চায়না টাউন। সেখানে থ্রিস্টার মানের একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো।

উঁচু-নিচু পাহাড়ঘেরা অসমতল এবং নানা ধর্ম-জাতি ও গোত্রের সমন্বয়ে দেশটি শুরুতে ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। পশ্চাৎপদ এলাকা ছাড়াও জাতি হিসেবে ছিল খুবই অলস প্রকৃতির। তবে দেশটির মেয়েরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। আশির দশকে দেশটির হাল ধরেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মাহাথির মোহাম্মদ। সেই থেকেই ধীরে ধীরে মালয়েশিয়া হয়ে ওঠে বিশ্বের রোল মডেল। রাজধানী কুয়ালালামপুর হয়ে ওঠে বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম একটি আধুনিক শহর। বিশ্ববাণিজ্যে মালয়েশিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক মাহাথির মোহাম্মদ এতোটাই জনপ্রিয় একজন মানুষ যে, নিজের হাতে গড়া দল থেকে বের হয়ে ছোট একটা দল নিয়ে নির্বাচন করেও বিজয়ী হন। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রনেতার এতো বেশি বয়সে নির্বাচনে জয়লাভের রেকর্ড নেই।

বলছিলাম মালয়েশিয়া মুসলিম দেশ হলেও আমাদের দেশের মতো মদ, জুয়া নিষিদ্ধ নয়। ফলে এটি কুয়ালালামপুরসহ উল্লেখযোগ্য শহরগুলোতে বহুজাতিক মানুষের অন্যতম ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়েছে। সারাবিশ্বের জুয়াপ্রেমী মানুষের অন্যতম আকর্ষণ গেংটিং হাইল্যান্ড। দাপ্তরিক ভাষায় রিসোর্টস ওয়ার্ল্ড গেংটিং। তবে সকলের কাছে এটি সিটি অব এন্টারটেইনমেন্ট। মালয়েশিয়ার একমাত্র এই নগরীতেই আইনসম্মতভাবে জুয়ার টেবিলে বসার সুযোগ রয়েছে। ছোটদের জন্য রয়েছে থিমপার্ক। এছাড়াও রিসোর্টগুলোতে রয়েছে ১০,০০০ কক্ষ, পঞ্চাশের অধিক ফান রাইড, ১৭০টি রেস্টুরেন্ট এবং খুচরা দোকান, বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী, বিজনেস কনভেনশন সুবিধাসহ পুরো নগরীই বিনোদন উপকরণে ঠাসা। গেংটিং হাইল্যান্ডে সবকিছু খুঁজে পাওয়া একই সঙ্গে সহজ এবং কঠিনও। সাধারন নগরীর মতো এখানে কোন রাস্তা নেই। আকাশচুম্বী সব ভবনগুলো করিডোর, টানেল, টিউব কিংবা চলন্ত সিঁড়ি দ্বারা সংযুক্ত। এর প্রতিটি স্থানেই অসংখ্য সিগন্যাল কিংবা নির্দেশনা রয়েছে যেগুলো সহজেই পথ ভুলতেও সহায়তা করে। তবে নিজের থেকে এ কিংবা বি সংকেত মনে রেখেও পথে এগুনো সম্ভব নয় সব সময়। এমন বিড়ম্বনা এড়াতে অনেক পর্যটকই সিটি ম্যাপ ব্যবহার করে থাকেন।

গেংটিং-এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৪০ মিটার বা ৫৭০৮ ফুট ওপরে। পুরো বছর জুড়ে গড় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেদিন কুয়ালালামপুরে বৃষ্টি হয় সেদিন গ্যাংটিং হাইল্যান্ড জুড়ে মেঘের দৌরাত্ম্য উপভোগ করা যায়। গেংটিং-এর নিকটতম বিমানবন্দর হিসেবে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরকেই ব্যবহার করা হয়। এখান থেকে সরাসরি বাস থাকলেও বাস্তবে সেগুলো কয়েকটি যাত্রা বিরতি দিয়ে থাকে। দ্রুত পৌঁছতে হলে ট্রেনে করে কেএল সেন্ট্রালে গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে যাওয়াই উত্তম। তবে মালয়েশিয়ার আকাশে অবস্থিত নগরীতে আকাশপথে যেতে হলে নিতে হবে সাবাহ এয়ারের সহযোগিতা। নির্দিষ্ট খরচের বিনিময়ে হেলিকপ্টার যোগে পৌঁছনো যাবে সব থেকে দ্রুততার সাথে। গো গেন্টিং এক্সপ্রেস বাস সার্ভিস-এর মাধ্যমে কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন স্থান এবং পুত্রজয়া থেকে সরাসরি গেংটিং-এর নীচে পৌঁছানো যাবে। কেএল সেন্ট্রাল, হেন্তিয়ান পাসারাইয়াত এবং গোম্বাক থেকে আধাঘন্টা থেকে এক ঘন্টা অন্তর বাস সার্ভিস রয়েছে। গেংটিং হাইল্যান্ডের সকল স্থান ঘুরে দেখতে আপনাকে কোন যানবাহনের ওপর ভরসা করতে হবে না। পুরো এলাকাটি অভ্যন্তরীন এবং ছাউনি দ্বারা আচ্ছাদিত পথের সমন্বয়ে তৈরী। তাই আগত কাউকেই বাইরে বের হতে হয় না। স্থানটির বিশেষ বৈশিষ্ট, এটি সকলের উপযোগী। এমনকি কোন পঙ্গু কিংবা অসুস্থ কেউ এখানে আসলেও তাকে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতে হবে না। পুরো এলাকাটি তিনি হুইল চেয়ারে করেই ঘুরে দেখতে পারবেন।

আমরা গেন্টিংসহ মালয়েশিয়ার দর্শনীয় স্থানগুলো একই দিনে পরিদর্শন করার জন্য মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক সাহাদাত হোসেনের সহযোগিতা নিলাম। সকালেই চায়না টাউনে আমাদের হোটেলের সামনে চলে এসেছে মাইক্রোবাস। আমরা দ্রুত হোটেলে কপ্লিমেন্টারী ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে চড়ে বসলাম। পথে কয়েকটি জায়গায় থেমেছি মূলত: ছবি তোলার জন্য। আমাদের মাইক্রোবাস গেন্টিংয়ের রোপওয়ের গোড়ায় থেমেছে। যেটাকে ওরা বেস ক্যাম্প বলে। সেখান থেকে সম্ভবত জনপ্রতি সাড়ে আট রিঙ্গিত টিকিকে রোপওয়েতে উঠলাম। এর আগে এর নিচে দোকানগুলো ঘুরে চেখে দেখার নাম করে বেশ কিছু ড্রাইফ্রুট খেয়ে নিলাম। আইডিয়াটা সাহাদাতের। বললো, এখন টেস্ট করে যান। যেগুলো ভালো লাগবে ফেরার পথে নিয়ে যাবেন। ফেরার পথে আমি আম, আনারস আর কিউই ফল নিয়ে এলাম। দামটা কিছুটা বেশিই মনে হলো।

আমরা ক্যাবল কার থেকে নামার আগে দুই ফটো গ্রাফার আমাদের ছবি তুললেন। কেনো তুললেন তা বুঝতে পারিনি। তবে ফেরার পথে ছবি প্রিন্ট করে দর্শনীয় এক ফ্রেমে হাজির হলে আমাদের কাছে। প্রতি ছবির জন্য ৫০ রিঙ্গিত বা প্রায় এক হাজার টাকা দাবি করলেন। একটা ফাইভ আর ছবি প্রিন্ট করতে আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ১২ টাকা নেয়া হয়। আর সেই ছবি প্রায় ১ হাজার টাকায় নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখলাম না। আমরা তিনজনেই না করে দেই। এমনিতেই আমাদের মোবাইলে অনেক ছবি জমা হয়ে আছে। অযথা এ ছবি নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম না।

গ্যান্টিংয়ের মূল আকর্ষণ ভাবা হয় এর বিশ্বখ্যাত ক্যাসিনোকে। দিন রাত ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে ক্যাসিনোগুলো। যদিও ২১ বছরের কম বয়সীদের প্রবেশের নিয়ম নেই। ক্যাসিনোগুলোতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ড্রেস কোড। এখানে টি-শার্ট, স্যান্ডেল, হাফ প্যান্ট পড়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। ক্যাসিনো খেলতে খেলতে কেউ মদ্যপান করতে চাইলে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। রৌলেট, ব্যাক্যারাট, তাই সাই, পাই গৌ, সলিটেয়্যারসহ হরেক ধরনের টেবিলে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বসে পড়ার সুযোগ থাকবে। পাশাপাশি অগণিত স্লটের মাধ্যমে ভাগ্য যাচাইয়ের সুযোগতো রয়েছেই। তবে জিতে নেয়া টাকা তোলার জন্য গেংটিং ওয়ার্ল্ড কার্ড ব্যবহার করতে হবে। গেংটিং হাইল্যান্ডের সবথেকে বড় ক্যাসিনোর নাম মন্তে কার্লো। বিদেশী পাসপোর্টধারীরা চাইলেই এর আন্তর্জাতিক রুম বা ভিআইপি রুমে প্রবেশের সুযোগ নিতে পারেন। তবে শর্ত হলো তাকে ওয়ার্ল্ড কার্ড-এর মাধ্যমে সাইন-ইন করতে হবে। এছাড়া রয়েছে হলিউড ক্যাসিনো। আধুনিক সকল সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ক্যাসিনো। স্বল্প থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বাজি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে স্টারওয়ার্ল্ড ক্যাসিনোতে। কোন ক্যাসিনোতেই ব্যাগ নিয়ে প্রবেশের অনুমতি নেই। ক্যাসিনোর বাইরে লকারের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহনের জন্য খরচ করতে হবে। ক্যাসিনোর অভ্যন্তরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ এবং দন্ডনীয়। এই নির্দেশনা দেখার আগেই আমি না বুঝেই একটি সেলফি তুলে ফেললাম।

ক্যাসিনো ছাড়াও গেন্টিংয়ে বিনোদনের আরো ব্যবস্থা রয়েছে। এ্যারিনা অব স্টারসে প্রতি ছুটির দিনেই পর্যটকদের বিনোদনের জন্য কনসার্টের আয়োজন থাকে। মালয়েশিয়ার সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত শপিং মল ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড প্লাজা। অভ্যন্তরীন থিমপার্কের পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য খুচরা দোকান। টাইম স্কয়ারে চলচ্চিত্র প্রেমীদের জন্য রয়েছে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড সিনেপ্লেক্স। ছোট আকারের দুটি সিনেমা থিয়েটার বিভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র বছরব্যাপী প্রদর্শন করে থাকে। গেংটিং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার সম্ভাব্য সকল আধুনিক সুবিধার সমন্বয়ে তৈরী করা হয়েছে। একসঙ্গে ২০০০ জনের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে সেন্টারটিতে। আউটডোরে রয়েছে থিমপার্ক। অসংখ্য রাইড সপরিবারে বিনোদনের জন্য আদর্শ স্থান। প্রতিদিনের আনলিমিটেড রাইডের জন্য খরচ পড়ে বড়দের জন্য ৫০ এবং ছোটদের জন্য ৩৫ আরএম। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ইনডোর থিম পার্ক। ফার্স্টওয়ার্ল্ড প্লাজার অভ্যন্তরে অবস্থিত থিম পার্কটিতে অগণিত রাইড রয়েছে। ডে পাস গ্রহনের মাধ্যমে পুরো দিন উপভোগ করা যাবে স্থানটি। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড হোটেলের কাছেই ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড প্লাজা। চাহিদা মতো উপকরন এখান থেকে সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। এখানে রয়েছে ৯০টিরও বেশি ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান।

গেংটিং-এ নিশি বিনোদনের সুযোগ খুবই সীমিত। পুরো কমপ্লেক্স জুড়ে চারটি বার। সাফারি, ক্লাউড ৯, অল স্পোর্টস বার এবং প্যাটিও বার এ্যান্ড লাউঞ্জ। ১০০০০ কক্ষ থেকে নিজের রাত যাপনের স্থান খুঁজে নিতে এই ছোট নগরীতে কোনই বেগ পেতে হয় না। বিশেষ করে যখন পর্যটন মৌসুম থাকেনা তখন খুবই সস্তায় রাত যাপন করার সুযোগ পাওয়াযায়। তবে বিপরীত চিত্র ফুটে ওঠে পর্যটন মৌসুমে এবং তখনকার ছুটির দিনগুলোতে। তখন এখানে হোটেলে রুম পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে যায়। কুয়ালালামপুর থেকে কাছেই হওয়ায় গেন্টিংকে বেশিরভাগ পর্যটক ডে ট্রিপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। আমরা এক অপার মুগ্ধতা আর অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ফিরে এলাম। আমাদের রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম বিচ, অপরূপ পার্বত্য অঞ্চল, সুন্দরবনসহ অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনা। আমাদের মনে রাখতে হবে, পর্যটকরা আমাদের দেশে কোন তীর্থস্থান মনে করে বেড়াতে আসেনা। তাদেরকে নিত্যদিনের পানাহার কিংবা জুয়ায় সময় কাটানোর সুযোগ দিতেই হবে। মাহাথিরের গড়ে তোলা মুসলিম দেশটিতে এর কোনো অভাব যেমন নেই, তেমনি নাইট লাইফ এন্টারটেইনমেন্টেরও অভাব নেই। তাহলে আমরা কেনো সবকিছু নিষিদ্ধ করে বসে আছি।

গ্যান্টিং থেকে ফেরার পথে আমরা গেলাম মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়ায়। স্থানীয়রা এর উচ্চারণ করে ফুটুরয়া। পরিকল্পিত ও সাজানো গোছানো শহর পুত্রাজায়া স্থাপত্য শৈলি আধুনিক ও গোছানো। ৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই শহরটি রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৬ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সঙ্গেই লেকবেষ্টিত দৃষ্টিনন্দিত পুত্রা মসজিদ দৃষ্টি কাড়ে পর্যটকদের। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের দেখা মেলে ঝিলপাড়ে। কুয়ালালামপুর শহরটি জনবহুল হওয়ায় ১৯৯৯ সালে প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রাজায়াতে স্থানান্তরিত করেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মাহাথির মোহাম্মদ। অবশ্য বর্তমানে এখানেও জনসংখ্যার আধিক্য দেখা দিয়েছে। ১৯৯৫ সালের আগস্টে নির্মাণকাজ শুরু হয় পুত্রাজায়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটা ছিল মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় বাজেট প্রকল্প। এটার বিশেষত্ব হচ্ছে, পুরো প্রকল্পের পরিকল্পনা, নকশা ও নির্মাণকাজ মালয়েশিয়ার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বিশেষ দিক হচ্ছে, ৩৮ ভাগ জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সবুজায়নে। প্রকল্পের কাজ শেষ দিকে থাকা অবস্থায় ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ পুত্রাজায়ায় স্থানান্তরিত হয়। আর পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব, বাগানসদৃশ পরিপাটি শহরের নাম দেওয়া হয় পুত্রাজায়া। ভবনের স্থাপত্যশৈলী, নকশা, চার পাশের গ্রিন স্পেস, মন মাতানো সাজসজ্জা যে কাউকে আকর্ষণ করবে।

পুত্রাজায়া প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীর আবাসিক কার্যালয় ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরগুলোর মধ্যে রয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। রয়েছে পারডানা লিডারশিপ ফাউন্ডেশন, বিচারালয়, হেরিটেজ স্কয়ার, ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ, লৌহ নির্মিত টুংকু জয়নাল আবেদীন মসজিদ, পুত্রাজায়া ল্যান্ডমার্ক, ওয়েটল্যান্ড পার্ক। মিলেনিয়াম মনুমেন্ট, ন্যাশনাল হিরোজ স্কয়ার ও স্বাধীনতা চত্বর। পুত্রাজায়ায় আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার (পিআইসিসি), লৌহ মসজিদ (স্টিল মস্ক), পুত্রাজায়া ব্রিজ, পুত্রাজায়া বোটানিকেল গার্ডেন, ইমিগ্রেশন অফিসও রয়েছে। লেকের পানিতে ভাসমান পুত্রা মসজিদ, পেছনে দৃষ্টিনন্দন পুত্রাজায়া সম্মেলন কেন্দ্র, সামনে সরলরেখাকৃতি পার্কসদৃশ সড়ক আর ডানে সমুদ্রসদৃশ লেকের অবশিষ্ট অংশ এবং তার তীরে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপনা। পরিপাটি সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে পর্যটকদের ভিড় বছরজুড়েই লেগে থাকে। প্রমোদ নৌবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী ৪-৬ আসন বিশিষ্ট গন্ডলা ধাঁচের পেরাহু নৌযানে ঘুরে দেখা যায় পুত্রাজায়া। ৭৬ আসন বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রমোদতরীও রয়েছে এখানে। যানটি বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে যাত্রাবিরতি দিয়ে পুরো পুত্রাজায়া ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

এরপরে আমরা যাই বাতু কেভ দেখতে। কোথাও চার কোটি আবার কোথাও চল্লিশ কোটি বছরের পুরনো বলা হয় এই গুহাকে। এই প্রাগৈতিহাসিক বাতু কেভ গুহা যতোটা ধর্মীয় তীর্থস্থান, তার চেয়েও বেশী ট্যুরিস্ট স্পট। পূজারি ছাড়াও নানা দেশের মানুষে তাই সরগরম থাকে বাতু কেভ। কেউ মালয়েশিয়ায় বেড়াতে গেলে তাদের ভ্রমণ তালিকায় এই স্পটটা থাকেই। যদিও মূলত এটা তামিল ভাষী হিন্দুদের তীর্থস্থান। ৪০ কোটি বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে গঠন হওয়া এ গুহায় একসময় বসবাস করতো তেমুয়ান নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠী। ওরা ছিলো মালয়েশিয়ার আদিমানব। উনিশ শতকে টিন খনিতে কাজ করতে আসা চাইনিজরা এ গুহার ইতিহাস একেবারেই ঘুরিয়ে দেয়। সবজি চাষের জন্য সারের প্রয়োজনে চুনা পাথরের এ পাহাড়ে এখানে-ওখানে খুঁড়তে থাকে তারা। এভাবে ১৮৬০ সালেই বাতু কেভের সন্ধান পেয়ে যায় চাইনিজরা। এর সিড়িগুলো ভেঙ্গে উঠতে উঠতেই দেখা মিলবে প্রচুর বানরের। ওদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে সতর্ক হয়েই আমরা ২৭২টি সিডি ভেঙ্গে উপরে উঠে ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরে পুজার জন্য বেশ কয়েকটি মন্ডপ রয়েছে। পুজারিরা পুজা করছে। দর্শনার্থীরা ছবি তুলছে। এখনও গুহা থেকে চুইয়ে পানি পড়ছে। ভেতরে কিছুক্ষণ থেকে বাইরে এসে খাবার কিনে কবুতরগুলোকে খাওয়ালাম। ওরাও আমার ঘাড়ে, মাথায় হাতের উপর বসে নিশ্চিন্তে খেয়ে নিল। কেভের বাইরে মুরুগানের বিশাল মুর্তির সঙ্গে ছবি তুললাম। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিন্দু দেবতার মূর্তি। হিন্দু পুরান মতে, গণেশের ভাই কার্তিকেরই আরেক নাম মরুগান। এটি এখন মালয়েশিয়ার অন্যতম পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে।

অন্য জায়গাগুলো ঘুরতে ঘুরতে মালয়েশিয়ার আইকন স্থাপনা পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সাহাদাত আমাদের আশ্বস্ত করলেন, আফসোস করার কিছু নেই। দিনের টুইন টাওয়ারের চেয়ে রাতের টুইন টাওয়ার অনেক বেশি বর্ণিল ও সুন্দর। পেট্রোনাস টাওয়ার কুয়ালালামপুরের জালান আমপাং এ অবস্থিত । গাড়ি থেকে নেমে দেখি পেট্রোনাস টাওয়ারের আশপাশে ভিড় করেছে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা। অধিকাংশ পর্যটকই ব্যস্ত ছবি তোলা নিয়ে। আমার সাথের বন্ধুরাও ছবি তোলার জন্য অস্থির হয়ে পড়লো। তাদের ছবি তোলার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। কিন্তু এত বড় টাওয়ার ছোট মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দী করা কঠিন। আমি মজা করে সানগ্লাস পড়ে ছবি তুললাম। এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে হাসির খোরাক তৈরি হলো।

৮৮ তলাবিশিষ্ট সুউচ্চ দালানটির মোট টাওয়ারের উচ্চতা ১৪৮৩ ফুট। উচ্চতার দিক দিয়ে এই টাওয়ারটি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ারের তালিকায় শীর্ষ স্থানে ছিল। অপরূপ সুন্দর এই টাওয়ারটির নকশা করেছিলেন আর্জেন্টাইন স্থপতি চেসার পেলী। এই দালান জোড়ার নিচে প্রায় ১২০ মিটারের ফাউন্ডেশন গাঁথুনি আছে। আরএই ফাউন্ডেশন গাঁথুনি করে দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ব্যাচি সোল্টাঞ্চ। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কংক্রিট পেট্রোনাস টাওয়ারের মূল উপাদান। এটি আসলে একজোড়া দালান। টাওয়ারটি বাস্তবায়নে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল জাপানভিত্তিক হাজামা করপোরেশন, দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন এবং কোরিয়াভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান কুকডোং ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন। বিল্ডিং দুটির মধ্যখানে একটি সংযোগ সেতু আছে, যা ৪১ এবং ৪২তম তলায় অবস্থিত। এই সেতুটি ৫৮ দশমিক ৪ মিটার লম্বা এবং এর ওজন প্রায় ৭৫০ টন। পেট্রোনাস টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১ মার্চ ১৯৯৩ সালে। দুই দফায় নির্মাণ কাজ শেষে ১৯৯৯ সালের ১ আগস্ট মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মুহাম্মাদ এটি উদ্বোধন করেন।

পেট্রোনাস টাওয়ার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মালয়েশিয়ার প্রধান তেলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পেট্রোনাসের অফিস এখানে। এই পেট্রোনাস কোম্পানির নামেই টাওয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে। এখানে আলজাজিরা, বোয়িং, আইবিএম, ক্রওলার নেটওয়ার্ক, মাইক্রোসফট, রয়টার্সসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দফতরের রয়েছে। পুরো টাওয়ারটির নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি ঠিকঠাক রাখার জন্য পেট্রোনাস টাওয়ারের পশ্চিম দিকে একটি 'সার্ভিস বিল্ডিং' আছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় এই 'সার্ভিস বিল্ডিং' থেকে তদারক করা হয়। এখানে রয়েছে ৮ তলাবিশিষ্ট শপিংমল। এই শপিংমলটির ৫তলা মাটির নিচে এবং বাকি ৩তলা সমতলে অবস্থিত।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে আয়োজন করা হয় ওয়াটার শো। অনেকে একে ওয়াটার ড্যান্সিং শোও বলে থাকে। বিভিন্ন মিউজিকের তালে পানির ফোয়ারা থেকে পানির নিসঃরন আর রঙিন আলো দেখলে মনে হবে যেন পানির কোমর দুলিয়ে নাচ করছে। পানির এমন নাচ দেখে অনেক তরুণ-তরুণীও নাচ শুরু করেন। আবার অনেকে ফ্রেমবন্দি করেন এই অপরূপ দৃশ্য। রাতের টুইন টাওয়ারের সৌন্দর্য দিনের টুইন টাওয়ারের চেয়ে আসলেই ব্যতিক্রম। রাতে এই এলাকার পরিবেশ দেখলে মনে হবে নতুন সাজে সেজেছে গোটা এলাকা। দৃষ্টি নন্দন এমন স্থানে প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করেন। উঁচু এই টাওয়ারে ওঠারও সুযোগ রয়েছে। দিনের বেলায় অনলাইন কিংবা কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে চড়া যাবে এই টাওয়ারে। খাওয়া যাবে একটি ঘুর্ণায়মান রেস্তোরাঁয় বসে। পর্যবেক্ষণ ডেক থেকে পুরো মালয়েশিয়া দেখা যাবে।

দিনভর মালয়েশিয়ায় ব্রিটিশ আমলের নির্মিত মসজিদ, শহরতলীর একটি উষ্ণ প্রসবন এলাকায় পরিদর্শন কর, প্রায় ৪ কোটি বছরের পুরনো বাতু কেভ, রাষ্ট্রপতির বাসভবন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত ছিলাম। টুইন টাওয়ারে খুব একটা সময় ব্যয় না করে হোটেলে ফিরলাম। সাংবাদিক সাহাদাতের পরামর্শে হোটেলের বারে উচ্চমূল্যে পানীয় না কিনে সামনেই স্ট্রিট সাইটের একটি বারে রাস্তার উপরে বসে ওয়াইনে গলা ভিজিয়ে রুমে চলে এলাম। মুসলিম এই দেশের সকল নিয়মকানুন কতোটা পর্যটন ফ্রেন্ডলি ভাবতেই অবাক লাগে। হয়তো এ কারনেই কুয়ালালামপুর আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বিজনেস হাবে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ার মেট্রোতে চলাচলের সময়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের দেখা মেলে। একটা মাল্টিন্যাশনাল সিটি এমনিতে আর একদিনে তৈরি হয়না। আমরা এ থেকে শিক্ষা নেবো সেই আফসোস নিয়েই কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিয়েছিলাম ব্যাংককের উদ্দেশ্যে।

লেখক: আসাদুজ্জামান সম্রাট, নগর সম্পাদক-দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও সম্পাদক-পার্লামেন্ট জার্নাল

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়