শিরোনাম
◈ ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা ◈ আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম  ◈ চলচ্চিত্র ও টিভি খাতে ভারতের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলেই ব্যবস্থা: ইসি আলমগীর  ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন না দেওয়াকে কর্মসূচিতে পরিণত করেছে সরকার: মির্জা ফখরুল ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ মিয়ানমার সেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না: সেনা প্রধান ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ৩০ এপ্রিল, ২০২১, ০৫:০৮ বিকাল
আপডেট : ৩০ এপ্রিল, ২০২১, ০৫:০৮ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মোনালিসা’র মোহে হারিয়ে যায় বিশাল সংগ্রহ!

আসাদুজ্জামান সম্রাট : ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শিল্প ও সাংস্কৃতির শহর প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। যা কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিজ, সংক্ষেপে কপ নামে পরিচিত। এটি ছিল ২১তম সম্মেলন বা কপ-২১। ‘জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (ইউএনএফসিসি) কাঠামোর আওতায় প্রতিবছর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। এ যাবতকালে জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মধ্যে সবচে’ সফল এই সম্মেলনে স্বাক্ষরিত হয়েছিল প্যারিস এগ্রিমেন্ট। যাতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানোর বিষয়ে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

এই সম্মেলন কভারের জন্য আমার পত্রিকার পক্ষ থেকে আমি যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটিই ছিল প্যারিসে আমার প্রথম সফর। সম্মেলনের মধ্যে দু’দিনের সাপ্তাহিক ছুটিকে আমি এবং আমার সফরসঙ্গী বন্ধু দু’টি ভাগে ভাগ করে ভ্রমণের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করি। প্রথমদিন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্ট মিউজিয়াম ল্যুভর এবং দ্বিতীয় দিন ভার্সাই প্যালেস দেখবো বলে ঠিক করি। ভার্সাই নামটির সঙ্গে ছোট বেলা থেকেই পরিচিত মাইকেল মধুসুধন দত্তের কারনে। বহু কষ্ট-ক্লিশে তিনি এই শহরে ছিলেন। কোথায় ছিলেন সেখানেও যাওয়ার ইচ্ছে। প্যারিস প্রবাসী আমাদের বন্ধু সাংবাদিক মাহমুদ দোলন ভ্রমণের পুরো আয়োজন করেন। প্রথম দিনে আমরা ল্যুভর মিউজিয়াম দেখার জন্য বের হই। সার্সেল থেকে মেট্রো ধরে প্রথমে যাই বাস্তিল। বাস্তিল দুর্গ দেখে রওয়ানা হই ল্যুভরের দিকে। বাস্তিল দুর্গ ভ্রমণের গল্প আরেক লেখায় বলবো। আসলে শিল্প-সাংস্কৃতির শহর প্যারিসের প্রতি কোনায় কোনায় লুকিয়ে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য। দু’চার দশদিনে প্যারিসের সেসব ঐতিহাসিক স্থান দেখে শেষ করা অসম্ভব। এ জন্যই আমরা নির্দিস্ট কয়েকটি স্থানকে বেছে নিয়েছিলাম।

বাস্তিল দুর্গ দেখতে আমি একটু বেশি সময়ই ব্যয় করেছিলাম। ল্যুভর মিউজিয়ামে আগে থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন অন্য দুই বন্ধু। তারা আগেই পৌছে দোলনের ডিএসএলআর ক্যামেরায় ছবি তুলছিলেন। আমি গিয়ে যুক্ত হলাম গ্লাস পিরামিডের সামনে। সেখান থেকে আশেপাশে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু ছবি তুলে ল্যুভরের মূল প্রবেশদ্বারে গেলাম। সেখানে লম্বা সারিতে আমাদের দাড় করিয়ে টিকিট কিনে এনেছেন দোলন। জানালেন, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ল্যুভরে এখন দর্শনার্থী কম। বিশেষ করে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পরে বিদেশী পর্যটক অনেক কমে গেছে। তবে পৃথিবীর সবচে’ জনপ্রিয় মিউজিয়ামের খেতাব ধরে রেখেছে সগৌরবে। বিশ্বের কোন জাদুঘরগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বেশি যায়, এমন এক জরিপের শীর্ষে রয়েছে ল্যুভর মিউজিয়াম। তালিকার দি¦তীয় স্থানে আছে চিনের বেইজিংয়ের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়না, তৃতীয় স্থানে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট ইন নিউইয়র্ক, চতুর্থ ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম এবং পঞ্চম লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম। আমি অনেক সৌভাগ্যবান যে, আমি ল্যুভর ছাড়াও ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম দেখার সুযোগ পেয়েছি। যে কোনো দেশ ভ্রমণে ওই দেশের মিউজিয়াম দেখা আমার অন্যতম লক্ষ্য থাকে।

প্যারিসে প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে বিশ্ব বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘর। এটি বিশ্বের পুরনো জাদুঘরগুলোর একটি। শুধু জাদুঘর নয়, রয়েছে আর্ট গ্যালারিও। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ১৮৪৮ অর্থাৎ ১৯ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা শিল্পের এক বিশাল সমাহার রয়েছে ল্যুভরে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। দর্শণার্থীরা যে ভবনে শিল্প আর সভ্যতার নিদর্শনগুলো দেখতে যায়, সেটি নিজেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারন এটি মিউজিয়াম হিসেবে নয়, নির্মিত হয়েছিল দুর্গ হিসেবে। তবে এই দুর্গ ছাড়াও পরে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হয়েছে। তাই এখানে শুধু শিল্প আর সভ্যতার নিদর্শনগুলো নয়, লক্ষ্য করা যায় ১২ শতক থেকে ২১ শতকের স্থাপত্য বিবর্তনের নিদর্শনও।

লাইনে দাড়িয়ে সিকিউরিটি চেক করতে করতে এর নাম নিয়ে একটু বিভ্রান্তিতেই পড়ে গেলাম। ছোট বেলায় বইয়ে এর নাম পড়েছি লুভ মিউজিয়াম। যেখানে মোনালিসার ছবি সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এখানে সবাই এর উচ্চারণ করছে ল্যুভর হিসেবে। তাহলে কী আমরা ভুল পড়েছি। লাইনে দাড়ানো এক ফরাসি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘ল্যুভর না ল্যুভ? কোন উচ্চারণটা ঠিক?’ ভদ্রলোক আমাকে আপাদমস্তক দেখে হেসে এড়িয়ে গেলেন। আমার ইংরেজীতে করা প্রশ্নটি হয়তো তিনি বুঝতেই পারেননি। এবার সিকিউরিটি চেকের সময়ে আরেক ভদ্র লোককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন,‘আমার পক্ষেও বলা কঠিন।’ সবাই যখন ল্যুভর বলছেন, আমিও মেনে নিলাম ‘ম্যুজে ডি ল্যুভর’ ফরাসি এই শব্দের যার বাংলা দাড়ায় ‘ল্যুভর মিউজিয়াম’।

ল্যুভরে ডুকে প্রথমেই পেলাম ‘উইংস ভিক্টোরী অব সামোথ্রেস’কে। খ্রিস্টপূর্ব ২শ’ বছর আগে এটি আবিস্কার করা হয়। এটি সামোথ্রেসের নাইক নামেও পরিচিত। ১৮৮৪ সাল থেকে এটি ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। এটিকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ভাস্কর্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ‘উইংস ভিক্টরী অফ সামোথ্রেস’ এই প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্যে এক ডানাওলা নারী, যার মুখ নেই, দাঁড়িয়ে আছে, জাহাজের ডেকের মতো এক পাটাতনের ওপরে। পাথরে নির্মিত এই ভাস্কর্যের সূক্ষ্মতা তার পোশাকের নিখুঁত ভাঁজে ভাঁজে ছন্দময় লীলায়িত ভঙ্গি। ভাস্কর্যটির স্কন্ধকাটা, ভাস্কর্যের ওই উন্মুক্ত আকাশে বিহঙ্গের বিচরণের মতো নির্ভার ভঙ্গিমায় দু’ডানা মেলে আছে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম ২২০০ বছর আগের তৈরি এই ভাস্কর্যকে। ভাস্কর্যটির ডান পাখাটি অরিজিনাল পাখা নয়। গ্লাস দিয়ে বাম পাখার আদলে এটি তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি কার নিপুণ হাতে তৈরি তা এখনও আবিস্কৃত হয়নি।

ল্যুভর মিউজিয়ামের অন্যান্য চিত্রকর্ম ঘুরে দেখার সময়ে মনোযোগ নষ্ট হয় কখন ‘মোনালিসা’ দেখবো এমন ভাবনায়। আমার বন্ধুরাও তার ব্যতিক্রম নন। আমি উইংস ভিক্টোরি অব সামোথ্রেস, নেপোলিয়ন এ্যাপার্টমেন্ট, রাফায়েলের আঁকা ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্টসহ ভাস্কর্য ও পেইন্টিং দেখার লক্ষ্য নির্ধারণ করি। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ের তৈজসপত্র, ফার্নিচার, পোষাক সামগ্রী ও ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট লুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত থাকলেও তা স্বল্প সময়ে দেখা যাবেনা বলে সেদিকে পা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। ‘উইংস ভিক্টোরী অব সামোথ্রেস’ দেখে আমরা সামনে এগুতে থাকি। সামনেই পড়ে গেলো একটি রোমান আমলের নগ্ন নারীর ভাস্কর্য। বলা হচ্ছে, এটি খৃষ্টপূর্ব ৩৯৫ সালে তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি কোথায় পাওয়া গেছে সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। ভাস্কর্যটির হাত নেই। পরেই দেখলাম অন্তেষ্টিক্রিয়ার এক কর্মীর ভাস্কর্য। যা খৃষ্টপূর্ব ১০৬৯ থেকে ৬৬৪ সালের কোনো এক সময়ের তৈরি। এটি ফ্রান্সের লোয়েস লিয়ন এলাকা থেকে পাওয়া গেছে। এরপরে আরো অনেক ভাস্কর্য দেখেছি, পেইন্টিংও দেখেছি। সবগুলোর নোটও নেয়া হয়নি। সহযাত্রী বন্ধুদের বিরক্তিতে আমাকেও পা বাড়াতে হলো মোনালিসা দেখার জন্য।

মোনালিসা দেখার অভিজ্ঞতা বলার আগে ল্যুভর নিয়ে প্রচলিত একটি ভুল ধারনা সম্পর্কে বলি। অনেকেই মনে করেন, ল্যুভরকে জাদুঘর করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো। আর এ ধারণাটিকে আরো জোরালো করে ল্যুভরে অবস্থিত কাঁচের পিরামিডটি। অনেকের জন্য এটা বিশ্বাস করা কঠিন হতে পারে, যে জাদুঘরে মোনালিসার মতো জগৎ বিখ্যাত চিত্রকর্মের ঠাই হয়েছে, সেটি ছিলো প্রকৃতপক্ষে এক দুর্গ। সিন নদীর তীরে আবস্থিত এ দুর্গটিতে পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা বসবাস করেছেন। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের শাসনামলে, বারো থেকে তেরো শতকের মাঝে ল্যুভর তৈরি করা হয় দুর্গ হিসেবে। অনেকের ধারণা, রাজা ফিলিপ অগাস্টের নির্দেশে ১১৯০ সালে দুর্গটির নির্মাণ শুরু হয়। ক্রুসেডের যুদ্ধে যাওয়ার আগে প্যারিস শহরকে ভাইকিং দস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি এ দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সিন নদী আর শহরের সংযোগস্থলে নির্মিত হয় ল্যুভর। শহরকে বহিরাক্রমণ হতে রক্ষার জন্য এই স্থানটি ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। ল্যুভরের অবস্থান এখন যেমন শহরের কেন্দ্রে, তখন এর অবস্থান এমন ছিলো না। এর অবস্থান ছিলো শহরের বাইরের দিকে আর এর কাজ ছিলো শহরের উপর প্রতিরক্ষামূলক নজরদারি করা। প্রতিরক্ষার দিকে খেয়াল রেখেই করা হয় এ দুর্গের নকশা। ভবনের আকৃতি ছিলো চতুষ্কোণ, যার চারপাশ ছিলো পরিখাবেষ্টিত। প্রাচীরের সাথে চারদিক দিয়ে ছিলো বেশ কিছু প্রতিরক্ষামূলক টাওয়ার। প্রধান টাওয়ারটি ছিলো ঠিক মাঠের মাঝখানে আলাদা এক পরিখায় ঘেরা। আরো ছিলো রাজসিন্দুক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কারাদণ্ডের জন্য বিশেষ সিলিন্ডার আকৃতির এক ভবন। তবে পরবর্তীতে নগরের পরিধি বাড়ার ফলে প্রতিরক্ষার কাজে এ দুর্গটি আর ব্যবহৃত হয়নি। এখনও জাদুঘরের বেইসমেন্টে পুরনো সেই দুর্গের অংশ দেখা যায়। যা সেইন্ট লুইসের (১২২৬-৭০) আমলে তৈরি। বিভিন্ন নথিপত্র ও এর আগের নকশা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ফিলিপ অগাস্ট যে ল্যুভর তৈরি করেছিলেন, সেটিকে কোনোভাবেই রাজপ্রাসাদ বলা চলে না, বরং এটি ছিলো পুরোদস্তর গ্যারিসন।

১৫৪৬ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিস এতে থাকার ব্যবস্থা করে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। এরপর থেকেই পর্যায়ক্রমে এটি ফরাসি রাজাদের প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। প্রথম ফ্রান্সিসের সময় বর্তমানে যে প্রাসাদটি দেখা যায় তার অল্পই তৈরি হয়েছিলো। তার আমলে ল্যুভরের কাজ হয়েছিলো পিয়েরে লেসটের তত্ত্বাবধায়নে। ল্যুভরের বেশিরভাগ কাজ হয়েছিলো সতের শতকে ত্রয়োদশ লুইস ও চতুর্দশ লুইসের সময়। তাদের দুজনেরই শিল্পের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিলো। তাদের মন্ত্রীগণ তাদের জন্য নানা স্থান থেকে মূল্যবান শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতো। ১৬৪২ সালে চতুর্দশ লুইস ল্যুভরকে রাজসংগ্রহ প্রদর্শনীর জন্য ছেড়ে দিয়ে ভার্সিলিসে (আমাদের কাছে ভার্সাই) চলে যায়। তখন ল্যুভরে ঠাঁই হয় বিভিন্ন আর্ট একাডেমির। এই একাডেমিগুলো নিয়মিত তাদের সদস্যদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতো।

ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় ১৮ শতকে। ফরাসি বিপ্লবের সময় চতুর্দশ লুইস ও তার স্ত্রীকে টুইলারিস প্রাসাদে কারারুদ্ধ করা হয় এবং ১৭৯৩ সালে সেখানেই তাদের শিরোচ্ছেদ করা হয়। টুইলারিস প্রাসাদটি ছিলো ল্যুভর সংলগ্ন। সে বছরই আগস্টে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্দেশে ল্যুভরকে জাদুঘর হিসেবে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ৫৩৭টি চিত্রকর্ম নিয়ে ল্যুভর আনুষ্ঠানিকভাবে গণ-জাদুঘর হিসেবে এর যাত্রা শুরু করে। জ্ঞানের স্বার্থে অনেকেই রাজ সংগ্রহের গণপ্রদর্শনীর দাবি করছিলেন বহুকাল ধরে। এর ফলে মাঝে মাঝে জনগণের জন্য কিছু প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলেও স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। ফরাসি লেখক ও দার্শনিক ডেনি ডিডোরো তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন, যাঁরা প্রথম জাতীয় পর্যায়ের একটি জাদুঘরের দাবি তুলেছিলেন। তবে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের একটি স্থায়ী জাদুঘর তৈরির কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। ১৭৯৩ সালের ১০ আগস্ট ফ্রান্সের বৈপ্লবিক সরকার ল্যুভরের গ্র্যান্ড গ্যালারিতে ‘মিউজি সেন্তাল ডি আর্টস’ চালু করে।

নেপোলিয়নের সময় ল্যুভরের সংগ্রহ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ফরাসি সৈন্যদের লুট করা সব শিল্পকর্ম আসতো এখানে। সেই সময়ে তিনি ল্যুভরকে নিজের নামে নামকরণও করেন। তবে ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ানের পরাজয়ের পর অনেক বস্তুই তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এ কথা না বললেই নয় যে, এখন ল্যুভরে মিশরীয় পুরাকীর্তি বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগ সমৃদ্ধ হয়েছে নেপোলিয়নের অভিযানগুলোর ফলে। তৃতীয় নেপোলিয়ানের শাসনামলে ১৯ শতকে ল্যুভরের আরো দুটি অংশ বর্ধিত করা হয় এবং ১৮৫৭ সালের মধ্যে বহু ভবন বিশিষ্ট ল্যুভরের স্থায়ী কাঠামোটি সম্পূর্ণ হয়েছিলো। গত শতাব্দীর ৮০ ও ৯০-এর দশকে জাদুঘর হিসেবে ল্যুভরে আধুনিক সরঞ্জামাদি যুক্ত করা হয় ও প্রদর্শনীর স্থান কয়েক হাজার বর্গমিটার বৃদ্ধি করে ল্যুভরকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্র্যান্ড ল্যুভর নামকরণ করা হয়। ল্যুভরে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে কাঁচের পিরামিডটি তৈরি করা হয়। এটি স্থপতি আই. এম. পে নির্মাণ করেন ল্যুভরের মূল প্রবেশ পথে। পিরামিডটি ১৯৮৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। এটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ল্যুভরে যেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক সমন্বয় তৈরি হয়েছে। ল্যুভরে একটি অংশ ফরাসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিলো। এ অংশটি ১৯৯৩ সালে ল্যুভরের ২০০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর তখন থেকেই পুরো ল্যুভর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে।

সারা পৃথিবী থেকে যারাই ল্যুভর মিউজিয়ামে যান তাদের কারো পক্ষেই ল্যুভরের এতোসব সংগ্রহ দেখার সময় ও সুযোগ থাকেনা। এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, দর্শকদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই ভাগ দর্শক শুধু লিওনার্দোর আঁকা ‘মোনালিসা’র সামনে ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করেন, ফটো কিংবা সেলফি তুলে জীবন সার্থক করেন। আমার সহকর্মী বন্ধু আমাকে ঠেলে আগেই চলে গেছেন মোনালিসার ছবির সামনে। আমি পৌছতে না পৌছতেই তাদের সেলফি তোলা প্রায় শেষ। আমি সেলফি তোলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দোলনের নির্দেশে দাড়িয়ে ছবির পোজ দিয়েই ফিরে তাকালাম মোনালিসার দিকে। এতো ছোট্ট একটা ছবি নিয়ে বিশ্বব্যাপী এতো আলোচনা-সমালোচনার হিসেব মেলাতে যখন মন দিবো তখনই নিরাপত্তারক্ষী সরে যাওয়ার ইশারা করলেন। বিদেশী অনেক দর্শকও ঠেলাঠেলি শুরু করলেন। বস্তুত যেখানে ‘মোনালিসা’ ছবিটি বিশেষভাবে সুরক্ষিত করা আছে সেখানে দর্শকদের ছবির কাছে একেবারেই পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না। বিশেষত: ছবির নিবিড় দর্শকদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি তৈরির ভাষা পড়ে নিতে দেওয়া হচ্ছে না। সেই ঘরে ঢোকার আগেই বিশাল হলঘরের দেওয়ালে লিওনার্দোর আঁকা বেশ কিছু শিল্পকর্ম রয়েছে যার এক ফুটের মধ্যে দর্শক অবলীলায় চোখ নিয়ে যেতে পারে। শিল্প হিসেবে তাঁরা কোনোভাবেই ‘মোনালিসা’র চেয়েও কম নয়। অথচ মোনালিসায় মশগুল দর্শকরা একবার সেসব ছবির সামনে দাঁড়াচ্ছেন না।

আমি দীর্ঘ সময় মন জুড়িয়ে মোনালিসার ছবি দেখতে না পেয়ে মন খারাপ করে লিওনার্দোর আঁকা, ‘ভার্জিন অফ দ্য রক্স’ দেখতে থাকি। ইতালির মিলানে বসে প্রথম আঁকা এই ছবিটি ল্যুভরের দেওয়ালে একা ঝুলে আছে। পিরামিডের মতো ত্রিভুজাকার একটি কাঠামোর ওপর আঁকা এই ছবিটি। এক অস্ফুট আলোর মায়ায় যিশু, ভার্জিন মেরি ও সেন্ট জনকে এঁকে ধর্মীয় ছবির মধ্যেও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন শিল্পী। ছবিতে এক অভাবনীয় মানবিক স্পর্শের ছোঁয়া রেখে দিলেন তিনি। কিছু দূরে দেওয়ালে লিওনার্দোর আঁকা আরেকটা ছবি, ‘লা বেল ফেরোনিয়ের’। এ ছবি ‘মোনালিসা’র অন্তত দশ বছর আগে আঁকা। লিওনার্দোর আঁকা রহস্যময় ছবি ‘সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট’ যা তাঁর আঁকা শেষ চিত্র বলে ভাবা হয়।

কাছেই ছিল রেমব্রান্টের আঁকা ‘বাথশেবা অ্যাট হার বাথ’। বাইবেলের ডেভিড আর বাথশেবাকে নিয়ে গল্প রেমব্রান্টের হাতে পড়ে কী এক অলৌকিক জাদুজগতে পরিণত হয়েছে তা ছবিটা সামনা-সামনি না দেখলে বোঝা যাবে না। আরও কিছুটা দূরে দেয়ালে রাখা আছে রাফায়েলের আঁকা ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট’। অপার সৌন্দর্যের এক মায়াবী আকর্ষণে ছবিটি জীবন্ত হয়ে আছে। যা শিল্পী রাফায়েলের ছবির বৈশিষ্ট্য। অসাধারণ ভারসাম্যে ও ছন্দে রচিত হয়েছে এ ছবি। কোথাও বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি নেই। মিথ আছে, রাফায়েলের ছবির কৃত্রিম ফল দেখে বিভ্রমে পড়তো পাখিরা। তারা ঠুকরে খেতে আসতো। বেশ কিছুটা গেলে দেলাক্রোয়া, তাঁর আঁকা সেই মর্মান্তিক ছবি ‘দ্য ডেথ অফ সারডানাপালুস’। গ্রিক ঐতিহাসিক ডিওডোরাসের লেখা থেকে অনুপ্রেরণায় কবি বায়রন লিখেছিলেন সারডানাপালসের ট্রাজেডির ওপর এক করুণ গাঁথা। দোলাক্রোয়া বায়রনের সেই কাব্যের চিত্রভাষা নির্মাণ করলেন এই ছবিতে।

ল্যুভরে যে ঘরে ‘মোনালিসা’ টাঙানো আছে তার একপাশে একটি অসাধারণ ছবিতে আটকে গেল চোখ, সে ছবির শিল্পীর নাম সচরাচর শোনা যায় না। ল্যামবার্ট সাসত্রিসের আঁকা এক মায়ের বিস্ময়কর তৈলচিত্র। সাদা বিছানার ওপরে অর্ধশায়িত এই নারী তার হাতের কোমল স্পর্শে ছুঁয়ে আছে দুটি নরম পায়রার দেহ। তার শিশুপুত্র একটি তীর দিয়ে খেলাচ্ছলে বিদ্ধ করতে চাইছে সেই পায়রার শরীর। শিশুর কাঁধে পরিদের মতো ডানা। পনেরোশো পঞ্চাশ সালে আঁকা এই ছবিতে সুররিয়ালিজমের অস্ফুট প্রতিধ্বনি শোনা যায় যেন। বাইবেলীয় মিথের ওপর আঁকা এই ছবি না-কি না পুরোটাই শিল্পীর নিজস্ব কল্পনা- জানা হলোনা।

পেইনটিংগুলো দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আমরা পা বাড়াই নেপোলিয়নের এ্যাপার্টমেন্ট দেখতে। যেখানে দিগি¦জয়ী বীর নেপোলিয়নের ব্যবহৃত অস্ত্র-শস্ত্র, পোষাক-পরিচ্ছেদ, ফার্নিচার, ফাউন্টেন, তৈজসপত্র রয়েছে। বেশ পরিপাটি করে সাজানো পুরো এ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে সুবিশাল ডাইনিং, ড্রয়িং, ব্যবহৃত অস্ত্র-শস্ত্রসহ আরো কতো কী! কী জৌলুসপূর্ণ জীবনই না ছিল তাঁর। দেখতে দেখতে আনমনে হয়ে যাই। আনমনেই হাত লাগাই ফার্নিচারে। আমার সম্বিত ফিরে নিরাপত্তারক্ষীর নিষেধাজ্ঞায়। ভারতের পন্ডিচেরির বাসিন্দা আমাকে হিন্দিতেই বললেন। আমি তাকিয়ে হেসে দিয়ে পরিচিত হই। জানালেন, জন্ম ভারতে হলেও পিতা-মাতার সঙ্গে মাত্র আট বছর বয়সে প্যারিসে এসেছেন। লেখাপড়া এখানেই। তিন চার বছর পর জন্মভিটে দেখতে যান। তাঁর সাথে কথা বলতে বলতেই শেষ করলাম বীর নেপোলিয়নের স্মৃতিচিহ্নগুলো। যেগুলো এখনো কতো জীবন্ত ও ঐশ্বর্যময় যা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

আমার বিশ্বাস সারা বছর ল্যুভর মিউজিয়াম ঘুরেও এর পুরোটা দেখা সম্ভব নয়। এমনকি উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোও। এজন্য আমি একটা হোম ওয়ার্ক করে গিয়েছিলাম। প্রিয় পাঠক, আপনারা যদি কখনো ল্যুভর দেখতে যান তাহলে আমি বলবো একটু হোমওয়ার্ক করে যাবেন। আগে থেকেই জানতে হবে এখানে কী কী আছে। ল্যুভরের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখতে পাবেন এগুলো। সেখান থেকে যে ধরনের শিল্পকার্যে আগ্রহী তার একটা তালিকা করে নিন। তারপর ম্যাপ দেখে সেইসব কাজ দেখতে যাবেন। তবে পথে অনেক ভাল কাজ চোখে পড়বে। সেগুলো দেখবেন আপনার তালিকা শেষ করে। বলে রাখি, এই মিউজিয়াম মঙ্গলবার ছাড়া রোজ খোলা থাকে, সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। কিছু পাবলিক ছুটির দিন অবশ্য বন্ধ থাকে। এর টিকিট অনলাইনে আগেই কেটে নেওয়া ভাল, ভিড় আর লাইন এড়ানোর জন্যে। প্রতি মাসের প্রথম রবিবার এই মিউজিয়ামে ঢুকতে কোনও টিকিট লাগে না। প্যারিসের স্থানীয় সাংবাদিকদের দেখতে টিকিট লাগেনা। ২৪ ঘণ্টা আগে নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করলে আমার মতো সাংবাদিকদের জন্যও ল্যুভর দেখা একদম ফ্রি। আমি অবশ্য এ নিয়মটি জেনেছি সেখানের কাউন্টারে গিয়ে। নইলে এই সুযোগটি নেয়া যেতো।

ফিরে আসি মোনালিসা প্রসঙ্গে। ল্যুভরে প্রদর্শিত চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচে’ ছোট এই ছবিটি। অথচ সারা বিশ্ববাসীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে এই মোনালিসা। মোনালিসার ছবি দেখতে দেখতে নিজের কাছেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর পাহাড়প্রমাণ খ্যাতি কীসের জন্য? পাঁচশো বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের এত বেশি উৎসাহ ভালোবাসা কৌতূহল আর কোনও ছবিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে কি? কেউ কি পেয়েছে তার মতো এমন অখণ্ড ধারাবাহিক মনোযোগ? তিন ফিট বাই দুই ফিট চার ইঞ্চির একটি ছবি। সেখানে মুখ্য হয়ে আছে একটি আবক্ষ নারীমূর্তি, আর নেপথ্যে আবছা পাহাড়ী-নিসর্গ। আর কিছুই না। কোনও ঘটনা নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের উচ্চকিত নাটকীয়তা নেই, নেই কোনও চমকপ্রদ ভঙ্গিমা অথবা স্পেসের অবিশ্বাস্য ব্যবহার। হয়তো লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মতো কিংবদন্তি শিল্পীর আঁকা ছবি বলেই এত খ্যাতি মোনালিসার। কিন্তু মোনালিসার চেয়েও উৎকৃষ্ট ছবি কি আঁকেননি তিনি? হলফ করে বলতে পারি তাঁর আঁকা ‘ভার্জিন অফ দ্যা রকস্’-এর নারীর সৌন্দর্য মোনালিসার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

প্রচলিত গল্পগাথা দিয়েই মোনালিসা প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই। ভারতীয় এক লেখকের লেখা পড়ছিলাম এ প্রসঙ্গে। এই মুহুর্তে তাঁর নাম মনে করতে পারছিনা। শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বয়স যখন বাহান্ন বছর তখন তিনি প্রথম দেখেন ম্যাডেনা লিসাকে। ২৬ বছর বয়সের লিসা ফ্লোরেন্সের ধনী ব্যবসায়ী ফ্রানচেসকো ডেল গিওকোন্ডোর তৃতীয় স্ত্রী। সুন্দরী ইতালিয় রমনী লিসার একটি পোর্ট্রেট করার আবেদন নিয়ে তাঁর স্বামী গিওকোন্ডো একদা হাজির হয়েছিলেন লিওনার্দোর স্টুডিওতে। বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে নিশ্চয়ই সে এক স্মরণীয় মুহুর্ত। কারণ, তার আগে শত অনুরোধেও লিওনার্দো কারো পোর্ট্রেট আঁকতে রাজি হননি। রাজা-রানি, রাজকুমার-রাজকুমারী কারো মুখের প্রতিই ছিল না তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ। সুতরাং বিশেষত্ব কিছু একটা ছিলই সেই মুখে, যার টানে মোনালিসার মুখকে তুলির স্পর্শে অমর করে গেছেন লিওনার্দো। আপাতদৃষ্টিতে মোনালিসাকে দেখলে মনে হয় সে যেন কিছুটা ভাবলেশহীন। নিরাসক্তির মৃদুতায় আচ্ছন্ন একটি মুখ। এই ভাবলেশহীনতাই হল মোনালিসা ছবির আসল সম্পদ। যদিও আমরা জানি না মুখের এই অভিব্যক্তি লিসা নাম্নী নারীর নিজস্ব, নাকি লিওনার্দোর প্রতিভাবলে এটি আরোপিত হয়েছে চিত্রপটে। তবে একথা শোনা যায় যে লিওনার্দো নাকি মোনালিসার মুখের প্রসন্নতাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য ছবি আঁকার সময় স্টুডিওতে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাদনের সুব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এও জানা যায় যে মোনালিসাকে আঁকার কালে তার প্রেমে গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলেন স্বয়ং শিল্পী। এতটাই গভীর ছিল নাকি সেই প্রেম যে লিওনার্দো নিজেই ক্রমশ দেখতে হয়ে যাচ্ছিলেন মোনালিসার মতো। মোনালিসাকে নিয়ে এইরকম নানারকম কাহিনী, উপকথা আর গুজবের ভিড়। বিশ্বজোড়া সেই কৌতূহলের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক দিমিত্রি মেরেজকাউস্কির লেখা ‘দ্য রোমান্স অফ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’-র মতো অসামান্য একটি উপন্যাস। যদিও সে উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য এখনো হয়নি আমার।

পূর্ণেন্দু পত্রীর তাঁর বই ‘মোনালিসা’য় মেরেজকাউস্কির উপন্যাসটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন। যাতে আছে আরো অত্যাশ্চর্য সব তথ্য ও বিশ্লেষণ। সেই বইয়ে বলা হয়েছে, কারো কারো দাবি মোনালিসা নাকি আদৌ গিওকোন্ডোর স্ত্রীর ছবি নয়। সেটি আসলে ডাচেস অফ ফ্রানকাভিলা’র প্রতিকৃতি। আবার অনেকের মত এটিও নাকি সঠিক তথ্য নয়। ছবিটি প্রকৃতপক্ষে অন্য কোনও মহিলার, যেটি কিনা আঁকা হয়েছিল সে আমলের বিখ্যাত ইতালিয় ধনকুবের গুইলিয়ানো দা মেদিচির জন্য। মোনালিসা ছিলেন মেদিচির প্রাক্তন প্রেমিকা। তাঁর বর্তমান স্ত্রী মোনালিসার ছবি দেখে চটে যাবার ভয়ে তিনি শেষ অবধি ছবিটি রেখে দেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জিম্মায়। অনেকে আবার আরও এক পা এগিয়ে দাবি করেছেন- মোনালিসা আদৌ কোনও মহিলারই ছবি নয়। এ ছবি আসলে স্বয়ং লিওনার্দো দা ভিঞ্চিরই নারীরূপ! লিওনার্দোর আঁকা আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে এর স্বপক্ষে নাকি প্রমাণও পাওয়া গেছে। এরকম কত যে অবাক করা খবর! মাঝে মাঝে মনে হয় এত সব বিচিত্র সংবাদের জন্যই কি মোনালিসাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল এত বেশি। আমি শিল্পসমালোচক নই কিংবা কিংবা শিল্পকর্ম ওভাবে বুঝিও না তবে এটা বুঝি যে, মোনালিসা বিশ্বশিল্পের একটি অমূল্য সম্পদ। যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ হবেনা কোনো দিন।

ল্যুভর মিউজিয়াম পরিদর্শন শেষে এক অতৃপ্ত মন নিয়ে বের হয়ে আসি। প্যারিসে এলে আবার ল্যুভর দেখার ইচ্ছে মনে রেখেই হেটে হেটে সিন নদীর তীরে যাই। যেখানে লাভ ব্রিজ খুঁজতে খুঁজতে ফিরে তাকাই ল্যুভরের দিকে। সেই ল্যুভর মিউজিয়াম। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যেটিকে লুভ মিউজিয়াম নামে পড়েছিলাম। লুভ না ল্যুভরের বিতর্কে নয়, ইতিহাসের অমর সৃষ্টিগুলো দেখার এক সুখানুভুতি নিয়েই এগিয়ে যেতে যেতে একটি বিষয় মনের মাঝে বার বার উঁকি দিচ্ছিলো, এতো বিশাল সমৃদ্ধশালী এক জাদুঘর ল্যুভর যেখানে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সংগ্রহ রয়েছে। কিন্তু সবকিছুই কেমন যেনো হারিয়ে যায় ‘মোনালিসা’র ছোট্ট একটা ছবির কাছে।

লেখক: আসাদুজ্জামান সম্রাট-নগর সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও সম্পাদক-পার্লামেন্ট জার্নাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়