শিরোনাম
◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে ◈ সেনা গোয়েন্দাসংস্থার বিরুদ্ধে ৬ পাক বিচারপতির ভয় দেখানোর অভিযোগ ◈ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাদা পতাকা উড়াচ্ছিল, তাদের বূলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিল ইসরায়েলী সেনারা ◈ যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত

প্রকাশিত : ৩০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২২ রাত
আপডেট : ৩০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আধুনিক ভারতের প্রথম মহিলা শিক্ষক, যিনি বদলে দিয়েছিলেন অসহায় বাল্যবিধবাদের ভাগ্য

অনলাইন ডেস্ক: ভারতীয় নারীদের কাছে ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল ভয়াবহ। শিশু বয়েসে বিয়ে হয়ে যেতো, বয়েসে অনেক বড় পুরুষের সাথে।বালিকা বয়েসেই বিধবা হয়ে, মাথা কামিয়ে ব্রহ্মচর্য্য পালন করতে হতো বহু নারীকে। আগলে রাখার মতো কেউ না থাকায়, অসহায় বালিকাগুলি স্বামীর পরিবারে ও সমাজের কাছে হয়ে উঠতো ভোগের সামগ্রী। সইতে হতো নিদারুণ যৌন নিগ্রহ। এর ফলে বেশিরভাগ বাল্যবিধবা গর্ভবতী হয়ে পড়তো। মান বাঁচাতে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতো বালিকাগুলি।

 

অন্ধকারে জ্বলে উঠেছিল আশার প্রদীপ

১৮৩১ সালে, মহারাষ্ট্রের নায়গাঁওতে জন্ম নিয়েছিলেন সাবিত্রী পাতিল। মাত্র ন’বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কাটগুন গ্রামের জ্যোতিবা ফুলের সঙ্গে। স্বামীর বইপত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন বালিকা সাবিত্রীবাঈ। পাঁচ বছর পরে, ধরা পড়ে গিয়েছিলেন স্বামীর কাছে।

সমাজের অনান্য পুরুষের মতো জ্যোতিবা ফুলে তিরস্কার করেননি তাঁর স্ত্রীকে। কারণ জ্যোতিবা তখন সমাজ সংস্কারের  স্বপ্ন দেখছিলেন। সাবিত্রীবাঈকে জ্যোতিবা নিয়ে গিয়েছিলেন মিসেস মিচেলের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে সাবিত্রীবাঈ প্রথাগত শিক্ষা শেষ করে, শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মিসেস ফারারের ইন্সটিটিউট থেকে।

 

শুরু হয়েছিল অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই 

১৮৪৮ সাল, পুনের ভিডেওয়াড়ার ধূলিধুসরিত রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে হেঁটে যেতেন সতেরো বছরের সাবিত্রীবাঈ। তাঁর দিকে ছুটে আসতো পচা ডিম, নর্দমার কাদা ও গোবর। উড়ে আসতো অশ্রাব্য গালাগাল। জানলার ফাঁক দিয়ে ভেজা চোখে  তাকিয়ে থাকতেন নারীরা। যাঁদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল সমাজ। সেই বেড়ি হেলায় খুলে, সীমাহীন লাঞ্ছনা সহ্য করে সাবিত্রীবাঈ পৌঁছে যেতেন একটি বাড়িতে।

 

সাবিত্রীবাঈ‍য়ের অপেক্ষায় মাদুরে বসে থাকতো, আটজন বিধবা নাবালিকা। শিক্ষার অধিকার ছিল যাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঘরে ঢুকে সাবিত্রীবাঈ সবার আগে আবর্জনা মাখা শাড়ীটি পালটে নিতেন। তাই অতিরিক্ত একটি শাড়ি রোজ সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এর পর কয়েকঘন্টা ধরে চলতো নাবালিকা বিধবাদের পড়াশুনা শেখানো। আটজন বালিকাকে নিয়ে শুরু করা বিদ্যালয়টিই ছিল, কোনও ভারতবাসী পরিচালিত প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। সাবিত্রীবাঈ ফুলে হয়ে গিয়েছিলেন, আধুনিক ভারতের প্রথম ভারতীয় মহিলা শিক্ষক।

বাল্যবিধবাদের অধিকার নিয়ে সাবিত্রীবাঈ‍য়ের লড়াই, মেনে নেয়নি পুনের রক্ষণশীল সমাজ। একঘরে করে দিয়েছিল ফুলে দম্পতিকে। ছাড়তে হয়েছিল বসতবাড়ি। জ্যোতিবার বন্ধু উসমান শেখ ও তাঁর বোন ফতিমা শেখ, নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন ফুলে দম্পতিকে। সেই বাড়িতেই ছিল সাবিত্রীবাঈ‍য়ের বালিকা বিদ্যালয়টি।

পরবর্তীকালে, সাবিত্রীবাঈ‍য়ের বিদ্যালয়ে  শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ফতিমা শেখ ও সগুনাবাই। ভিটেছাড়া হলেও থামেনি লাঞ্ছনা। রাস্তায় বের হলেই জুটতো টিটকিরি এবং শারীরিক নিগ্রহ। অসহায় বাল্যবিধবাদের পাশে দাঁড়ানো এক দুঃসাহসী এক নারীর নিগ্রহ, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতো হৃদয়হীন সমাজ।

 

যত বেড়েছিল লাঞ্ছনা, তত বেড়েছিল জেদ

মাঙ্গ ও মাহার সম্প্রদায়ের জন্য সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরও দুটি স্কুল। ১৮৫১ সালে, সাবিত্রীবাঈয়ের তিনটি স্কুলে পড়াশুনা করতো প্রায় দেড়শো জন ছাত্রী। ছাত্রীদের স্কুলমুখী করার জন্য মাসিক বৃত্তি দিতেন। বাল্যবিধবাদের বোঝাতেন নারীদের জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব। নারীশিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য, ১৮৫২ সালে, ব্রিটিশ সরকার সাবিত্রীবাঈকে দিয়েছিল সেরা শিক্ষিকার পুরষ্কার।

 

১৮৫২ সালেই, নারীর অধিকার ও সম্মান ছিনিয়ে নেবার জন্য, সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘মহিলা সেবা মন্ডল’। শুরু করেছিলেন এক অসাধারণ আন্দোলন। মহারাষ্ট্রের ক্ষৌরকর্মীদের অনুরোধ করেছিলেন, নাবালিকা বিধবাদের মাথা কামানোর কাজ বয়কট করতে। কারণ কামানো মাথার বালিকা দেখলেই, সমাজের নারীলোলুপ হায়নারা বুঝে যেত বালিকাটি বিধবা ও ভোগের বস্তু। সাবিত্রীবাঈয়ের আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন ক্ষৌরকর্মীরা। চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলেছিলেন, বাল্যবিধবাদের মাথা আর তাঁরা কামাবেন না।

 

বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিদ্যালয়গুলি

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশদের থেকে পাওয়া অনুদান। রক্ষণশীলদের ভয়ে অনুদান বন্ধ করে দিয়েছিলেন পরিচিতেরাও। অর্থাভাবে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠিত তিনটি স্কুলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১৮৫৮ সালে। তবুও লড়াই ছাড়েননি সাবিত্রীবাঈ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাল্যবিধবাদের পড়াতেন।

পড়ার সাথে বাল্যবিধবাদের, আঁকা ও সাহিত্য রচনাতেও উৎসাহ দিতেন তিনি। নিজেও লিখতেন অসামান্য কবিতা। যা পরবর্তীকালে তাঁকে মহারাষ্ট্রের প্রথমসারির কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। তবে বিদ্যালয় তিনটি বন্ধ করে, সাবিত্রীবাঈকে দমাতে পারেনি রক্ষণশীল সমাজ। পরবর্তীকালে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আঠেরোটি বালিকা বিদ্যালয়।

প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ভারতের প্রথম  ‘ভ্রূণ হত্যা’ প্রতিরোধ সংস্থা

১৮৬৩ সালে সাবিত্রীবাঈ, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ‘। গর্ভবতী বাল্যবিধবা ও ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী বালিকাদের আশ্রয়স্থল ছিল এই বাড়িটি। যেখানে ধাইমায়েরা সন্তান প্রসব করাতেন। সন্তানসম্ভবা বাল্যবিধবাদের আর লজ্জায় আত্মহত্যা করতে হতো না। কিংবা অবৈধ উপায়ে গর্ভপাত করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হতো না। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের সব দায়িত্ব নিতেন সাবিত্রীবাঈ।

১৮৭৩ সালে,স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সত্য শোধক সমাজ’। মুক্তমনা এই সমাজে যোগ দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ- অব্রাহ্মণ হিন্দু, মুসলিম ও সরকারি আধিকারিকেরা। এই সমাজের উদ্দেশ্য ছিল, পিছিয়ে থাকা মানুষদেরকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া। এই সত্য শোধক সমাজকে সাথে নিয়ে, সাবিত্রীবাঈ লড়াই শুরু করেছিলেন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে। কারণ, ব্রিটিশরা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে, ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে দিলেও, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় রমরমিয়ে চলছিল এই বর্বর প্রথা।

অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে নেমেছিলেন সাবিত্রীবাঈ। সে যুগে বেশিরভাগ পানীয়জলের কুয়ো থাকতো উচ্চবর্ণের দখলে। তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষেরা, সে সব কুয়ো থেকে জল নিতে পারতেন না। খাল ও পুকুরের দূষিত জল খেতে বাধ্য হতেন। তাই সাবিত্রীবাঈ, নিজের বাড়ির ভেতরে বানিয়েছিলেন, প্রকাণ্ড এক কুয়ো। সেই কুয়ো থেকে জল নিতেন জলকষ্টে ভোগা নিম্নবর্ণের মানুষেরা। কিছুদিনের মধ্যেই সাবিত্রীবাঈয়ের দেখানো পথে হেঁটেছিলেন, উচ্চবর্ণের বহু মানুষ।

অব্রাহ্মণ হয়েও দত্তক নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তানকে

উচ্চবর্ণদের কাছে বার্তা দিতেই, ১৮৭৪ সালে, অব্রাহ্মণ সাবিত্রীবাঈ দত্তক নিয়েছিলেন, কাশিবাই নামের একজন ব্রাহ্মণ বিধবার সন্তানকে। দত্তকপুত্র যশবন্ত রাওকে ডাক্তার তৈরি করেছিলেন। বিয়ে দিয়েছিলেন এক বাল্যবিধবার সঙ্গে। বিয়ের আগে ভাবী পুত্রবধুকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে। যাতে নতুন পরিবারে পুত্রবধু মানিয়ে নিতে পারে। সংসারের কাজ থেকে পুত্রবধুকে দূরে রেখেছিলেন, যাতে সে পড়াশুনা শেষ করতে পারে।

১৮৭৬ সালে, ভারত জুড়ে শুরু হয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সাবিত্রীবাঈ তাঁর স্বামী ও পুত্রকে নিয়ে, রান্না করা খাবার পৌঁছে দিতে শুরু করেছিলেন মহল্লায় মহল্লায়। প্রান্তিক মানুষদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার জন্য, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় খুলেছিলেন প্রায় বাহান্নটি লঙ্গর। সেদিন তাঁর মধ্যে মহারাষ্ট্র দেখেছিল মা অন্নপূর্ণাকে।

১৮৯০ সালের ২৮ নভেম্বর, প্রয়াত হয়েছিলেন প্রাতঃস্মরণীয় সমাজ সংস্কারক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে। শত শত বছরের প্রথাভেঙে, স্বামীর শবযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ। নিজের মাথায় বয়েছিলেন স্বামীর অস্থিকলস। স্থানু হয়ে দাঁড়িয়েছিল রক্ষণশীল সমাজ। কাদা, পচা ডিম, গোবর ছোঁড়ার মতো সাহস হয়নি।

পৃথিবী ছেড়েছিলেন সেবা করতে করতেই

১৮৯৭ সালে পুনেকে আক্রমণ করেছিল, তৃতীয় বুবোনিক প্লেগ মহামারী। পুত্র যশবন্তকে নিয়ে সাবিত্রীবাঈ শুরু করেছিলেন একটি চিকিৎসাকেন্দ্র। রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরে প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে আসতেন সাবিত্রীবাঈ, ছেলে যশবন্ত চিকিৎসা করতেন। এভাবেই একটি দশ বছরের বালককে, মান্ডোয়া থেকে কোলে তুলে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন সাবিত্রীবাঈ। যে ছেলেটিকে তার পরিবার রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিল।

দিন রাত এক করে, সাবিত্রীবাঈ সুস্থ করে তুলেছিলেন বালকটিকে। কিন্তু নিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রাণঘাতী প্লেগে। মা’কে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন পুত্র যশবন্ত। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল করে, ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ, চলে গিয়েছিলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে। চলে গিয়েছিলেন, হাজার হাজার বাল্যবিধবা ও লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায় করে দিয়ে। চলে গিয়েছিলেন, ঘুণধরা সমাজের মিশকালো রাতে, নারীমুক্তির প্রদীপ জ্বালিয়ে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়