ড. শোয়েব সাঈদ, ভ্যাকসিন গ্লোবালাইজেশন বনাম ন্যাশনালিজমের তীব্র টানাপোড়েনে বিপাকে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য। গত সেপ্টেম্বরে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের উপর কলামে যে সব বিষয়ে আশংকা করেছিলাম তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি এখন।
নগদ টাকায় কেনা ভ্যাকসিন ভারতের কাছ থেকে সময় মত পেতে সমস্যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাথে চুক্তি রক্ষা করা শুধু বাংলাদেশের জন্যে নয় ভারতের জন্যেও দরকার। বাংলাদেশ ভাল থাকলে বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের রাজ্যগুলো ভাল থাকবে।
সমস্যা বহুমুখী। ভ্যাকসিনের কাঁচামাল এবং আনুসঙ্গিক উপকরণের রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট সমস্যায় আছে ভ্যাকসিন উৎপাদনে গতি আনতে। চুক্তি অনুসারে সাপ্লাই দিতে ব্যর্থ হওয়ার এসট্রাজেনেকার বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। জোট নিরপেক্ষ ভ্যাকসিন নামে পরিচিত ভ্যাকসিনটি ইউরোপের চাপ আর বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে নৈতিক দায়িত্বের উভয় সংকটে।
যুক্তরাষ্ট্রের কঠিন স্বার্থপরতা দেশটিকে ভ্যাকসিনে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত করেছে। মেক্সিকো আর কানাডার প্রতি বিলম্বে সামান্য সহযোগিতা ছাড়া বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকার অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে।
কোভিড সংকটের বর্তমান ওয়েভে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ব। দৈনিক সাড়ে তিন লক্ষ সংক্রমণ আর ২-৩ হাজার মৃত্যুর বোঝা নিয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে উদার অবস্থানে নেই ভারত। ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদে দোষী দেশগুলো ভ্যাকসিন বিশ্বায়নের উদার পথে হাঁটলে নিজের দেশেই ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনায় রাজনীতির জটিল খেলায় এদের কাছ থেকে গরীব দেশগুলোর বেশী কিছু আশা করার নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় প্রধান ভ্যাকসিন নিয়ে এই টানা হেঁচড়ার বিষয়টিকে দরিদ্র দেশগুলোর জন্যে বিপর্যয় বলে মনে করেন।
জরুরী পরিস্থিতি মানুষের মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করে। কানাডায় মাস খানেক আগেও অনেকেই ভাবতেন ফাইজার, মডার্না নেবেন, এসট্রাজেনেকা নয়। এখন সংক্রমণের কঠিন অবস্থায় অনেকেই যে কোন একটি ভ্যাকসিন পেলেই খুশী। ভারত থেকে কানাডায় কোভিশিল্ড সরবরাহে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
যে কোন জরুরী অবস্থায় সংকটের তাৎক্ষণিক আর দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানে পরিকল্পনা থাকে। রাশিয়ার ভ্যাকসিন স্পুটনিকের বাংলাদেশে উৎপাদন একটি সময় সাপেক্ষ প্রোজেক্ট। এটি অনেক আগেই করা যেত। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মাইক্রোবায়োলজির পেশাজীবি হিসেবে বলতে পারি বাংলাদেশে রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি উৎপাদনে প্লান্ট নির্বাচন, প্লান্টটি উৎপাদনের যোগ্য করে তোলা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, উৎপাদন এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোলের যাবতীয় অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেবার বিষয়টি বেশ সময় সাপেক্ষ। ভবিষ্যতে কাজে লাগার এই প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যাবার পাশাপাশি দরকার সরাসরি রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি জরুরীভাবে বাংলাদেশে আমদানী করা। চীন থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একশন প্লান দরকার।
এই মুহূর্তে ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের প্রয়াস বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
বলা হচ্ছে ভারতের এই কঠিন পরিস্থিতির জন্যে ভ্যারিয়েন্টের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার গাফলতি আর হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিভ্রান্তিকর আলোচনা অনেকাংশে দায়ী।
অধিক সংক্রামক ইউকে ভ্যারিয়েন্টের আর ভ্যাকসিন ফাঁকি দেবার ক্ষমতাবান দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের আদিভূমি ইউকে আর দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু পরিস্থিতি খুব সফলভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখছে। ইউকে এর ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপক টিকাদান সহায়তা করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাপান, অস্ট্রেলিয়া অপেক্ষাকৃতভাবে ভাল অবস্থানে।
পরিস্থিতি যত কঠিন হোক না কেন, নিষ্ঠার সাথে স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব নয়।
লেখকঃ কলামিস্ট, অনুজীব বিজ্ঞানী, কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।