গুলজার হোসেন উজ্জ্বল: আমি ডাক্তার এবং আমি একজন মধ্য মেধার লোক। আমি যে মধ্য মেধার সেটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। কারণ এর সপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে। ডাক্তারিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে আমি এয়ারফোর্সে জিডি পাইলট হওয়ার আশায় পরীক্ষা দিয়েছিলাম। দ্রুত পরিবারের হাল ধরতে পারবো এটা ছিলো মূল আশা। সঙ্গে পাইলটের গ্ল্যামার। আরাধনা ছবির রাজেশ খান্না। প্রথম পরীক্ষাতেই আউট। প্রথম পরীক্ষাটি ছিলো আই-কিউ টেস্ট। আধঘণ্টা পরই রেজাল্ট দিলো। আমি আইকিউ টেস্টে ফেল মারলাম। যেকোনো ব্যর্থতাই কষ্টের। কষ্ট নিয়ে আমি বাল্যবন্ধু তৌহিদুল-সুমনদের মেসে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার তখন বয়স ১৮+ বন্ধুর দুঃখে বন্ধু সান্ত্বনা দেবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তৌহিদ উল্টা হাসাহাসি করলো। বললো, তুই ডিফেন্সে পরীক্ষা দিতে গেছিস এটা ভেবেই তো হাসি আসতিছে। সুমন বললো, এটা প্রমাণ হলো যে তোর আইকিউ খারাপ। সুমনের কথা ফেলা যায় না। আমি সেই থেকে ধরে নিয়েছি আমার আইকিউ খারাপ। আমার যে আইকিউ খারাপ এটা পরেও অনেকবার প্রমাণ হয়েছে। হেমাটোলজিতে রেসিডেন্সির সময়ে একজন রোগীর কেমোথেরাপির প্রটোকল বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন আমার সুপারভাইজার আমিন লুতফুল কবির স্যার। কিন্তু কোনটার পর কোনোটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছিলো না। আমি স্যারকে বললাম, স্যার লিখিত আকারে থাকলে দেন। স্যার বললেন, আমি শুরুতেই বুঝছিলাম তোমার আইকিউ সমস্যা। তোমার লিমিটেশন আছে৷ আমি হেসে বলেছিলাম, জ্বি স্যার। এটা আগেও অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। আমার আইকিউ খারাপ, এটা ধরে নিয়েই আমি আমার প্ল্যানগুলো করি। আমার সহকর্মী ও সহকারীদের এটা আগেই বুঝিয়ে দিই। তারা আমাকে সাহায্য করে।
আমি ভুলে যাই সব কিছু। মনে রাখতে পারি না। এজন্য আমাকে বাজারে পাঠানো হয় না। অনেকেই হয়তো ভাবছেন বাজারের তালিকা পকেটে করে নিয়ে গেলেই সমাধান। কিন্তু অনেকবার এরকম হয়েছে যে আমি বাজারে তালিকা পকেটে নিয়ে বের হয়েছি কিন্তু ভুলে হাসপাতালে চলে গেছি। বাজারেই যাওয়া হয়নি। ফর্দ পকেটেই থেকে গেছে। তাই আর আমাকে বাজারে পাঠানো হয় না। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর আমার মা এবং এরপর আমার স্ত্রী এই দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের দেশে একটি প্রচলিত ধারণা আছে ডাক্তার মানেই মেধাবী। কথাটি পুরো সত্য না। আমি অনেক কিছুতেই ব্যর্থ হয়েছি। আমি ক্লোজ আপ ওয়ানে বেস্ট ফরটিতে আসতে পারিনি। নতুন কুঁড়ি পদক পাইনি। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সেরা হতে পারিনি। এরকম অসংখ্য না পারা আমার জীবনে বিদ্যমান।
আমার ইচ্ছা ছিলো সংবাদিকতা পড়বো। কিন্তু এই পেশা অনিশ্চিত বলে সাহসই পাইনি। মেধা তো পরের বিষয়। আমার সামান্য ঝুঁকি নেওয়ার মতোই সাহস নেই। আমার মধ্যমের কারণেই রাস্তায় পুলিশ আটকালে আমি ভয় পাই। কাগজপত্র সব ঠিক আছে তো? মাঝে মাঝে ফেঁসে যাই। তবে মাথা ঠাণ্ডা রাখি। একবার রঙ ইউটার্ন নিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি। ট্রাফিক পুলিশ আটকালো। আমি বললাম, আমি একজন সামান্য চিকিৎসক। আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলটি ক্ষমা করে দিলে কৃতার্থ হই। জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে আমার কষ্ট হবে৷ আমার আয় সীমিত৷ আমার কার্ডটি রাখুন চেম্বারে এসে একদিন গল্প করে যাবেন। আপনার কর্মস্থলেরই পাশে আমার চেম্বার। কোনোদিন অসুখ বিসুখে পড়লে স্মরণ করবেন৷ ডা. গুলজার বেঁচে থাকতে চিকিৎসা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। পুলিশ ভদ্রলোক হেসে বললেন, আপনারা সমাজে সবচেয়ে মেধাবী। আপনাদের আটকাতে আমাদেরও ভালো লাগে না৷ আমি বললাম, আপনিও ভুল করলেন। আমি একজন মধ্যমেধার মানুষ। এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ হেসে দিলেন। মনে হয় বিশ্বাস করলেন না। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :