ডেস্ক রিপোর্ট: করোনা পরিস্থিতিতে রমজাননির্ভর ছয় পণ্য-ছোলা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি ও খেজুরের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তোলা হয়েছে। রমজান মাসের চাহিদার তুলনায় এসব পণ্যের সরবরাহ বেশি রয়েছে। এ ছাড়া আমদানি প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। আমদানিও বেড়েছে। ফলে বাজারে রমজাননির্ভর এই ছয় পণ্যের কোনো ধরনের সংকট নেই। সোমবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ইতোমধ্যে সরকারের ১২ সংস্থাকে মাঠে নামানো হয়েছে। সংস্থাগুলো হলো : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিও থাকবে। তারপরও যদি কারসাজির প্রমাণ মেলে তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, রমজানে বাজারে যাতে কোনো সমস্যা না-হয়, সেজন্য প্রস্তুতি রয়েছে। সবরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। দেশে নিত্যপণ্যের কোনো সংকট নেই। সরবরাহেও কোনো ঘাটতি হবে না। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক আছে। কারণ, চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণে পণ্য মজুত আছে।
এদিকে রমজান মাস সামনে রেখে ছয় পণ্যের মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দেশে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসে চাহিদা এক লাখ ৩৬ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে দেশে উৎপাদন হয়েছে ৮২ হাজার টন। এ ছাড়া বর্তমানে দেশে ১৭ লাখ ৯০ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে সরবরাহ ১৮ লাখ ৫৩ হাজার টন।
সেক্ষেত্রে দেখা যায়, পুরো বছরের চাহিদার তুলনায় দেশে বর্তমানে ৫৩ হাজার টন চিনি বেশি আছে। দেশে বছরে খেজুরের চাহিদা ৬০ হাজার টন। শুধু রমজান মাসে চাহিদা ৪০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৬২ হাজার টন। সেক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় এই পণ্যটি বেশি আছে। বছরে ছোলার চাহিদা দুই লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা ৮০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে দেশে উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার টন। এ পর্যন্ত চার লাখ ১১ হাজার টন আমদানি করা হয়েছে। ফলে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি রয়েছে।
একইভাবে বছরে মসুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন। এক মাসে চাহিদা ৩৮ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসে চাহিদা ৮০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়েছে দুই লাখ ৬৬ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার টন। সেক্ষেত্রে মোট সরবরাহ চার লাখ ৪৯ হাজার টন। এ ছাড়া আমদানির পর্যায়ে রয়েছে আরও ডাল।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৬ লাখ টন। এর মধ্যে রোজার মাসে চাহিদা তিন লাখ টন। এখন পর্যন্ত ২৫ লাখ ৫৫ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। চার লাখ সাত হাজার টন আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে চাহিদা তিন লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ টন। চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ১৬ লাখ ২৩ হাজার টন আমদানি হয়েছে। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই মোট সরবরাহ রয়েছে ১৮ লাখ ২৩ হাজার টন। সেক্ষেত্রে বর্তমানে ভোজ্যতেল চাহিদার তুলনায় সরবরাহ পর্যাপ্ত।
বাজারমূল্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অসাধুরা রমজান উপলক্ষ্যে গত দুই মাস আগ থেকেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। পাশাপাশি সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে আরও এক দফা পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর রোজায় ব্যবহৃত ছয় পণ্যের যৌক্তিক খুচরা মূল্যের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। কিন্তু রাজধানীর খুচরা বাজারে পণ্যের মূল্য যাচাই করে দেখা গেছে, অধিদপ্তরের প্রকাশিত যৌক্তিক মূল্যের চেয়েও বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। অধিদপ্তর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ছোলা সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য ৬৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু খুচরা বাজার ঘুরে প্রতিকেজি ছোলা ৭৫ টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে। দুই মাস আগে এই ছোলা খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা।
প্রতিকেজি পেঁয়াজের খুচরা যৌক্তিক মূল্য ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা। প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৩৯ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা। প্রতিকেজি উন্নত মানের মসুর ডালের খুচরা মূল্য ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০৩ টাকা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। অধিদপ্তর প্রতিকেজি চিনির যৌক্তিক খুচরা মূল্য ধরেছে সর্বোচ্চ ৬৮ টাকা-বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭২ টাকা। প্রতিকেজি সাধারণ মানের খেজুর যৌক্তিক মূল্য ধরা হয়েছে ৮০-১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা।
জানতে চাইলে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, শক্ত মনিটরিং ও শাস্তির দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। তা না-হলে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার যে প্রবণতা, সেটা কমবে না।
তিনি আরও বলেন, মূলত কয়েকটা কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এর মধ্যে একটি হলো চাহিদার তুলনায় পণ্য সরবরাহ কম থাকা। তবে দেশে মজুত পরিস্থিতি ভালো, এ সময় অসাধুরা প্রতিবছরের মতো কৃত্রিমভাবে ঘাটতি দেখিয়ে অনেক সময় দাম বাড়াতে পারে। তাই সরকারের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে, যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করতে না পারে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ঢাকায় ৩০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। যেখানে এই খুচরা মূল্যকে ভিত্তি ধরে খুচরা দাম পর্যবেক্ষণ করা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, এটি একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে জনগণকে আসন্ন রমজান মাসে সুফল দেওয়া যাবে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে নয় সদস্যবিশিষ্ট ‘বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ’বিষয়ক স্থায়ী কমিটি গঠন করেছে। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, চাহিদার তুলনায় রমজাননির্ভর পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। তাই করোনা পরিস্থিতি ও রমজান উপলক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাজারে বিশেষ মনিটরিং সেল কাজ করছে। ইতোমধ্যে করোনার প্রভাবের অজুহাতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়েছিল। তা তদারকির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। তবে এরপরও যদি কোনো ব্যবসায়ী অসাধু পন্থায় পণ্যের দাম বাড়ায়, তাহলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পরিদর্শন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টিম। সোমবার সকালে টিমের সদস্যরা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের মার্কেট ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেন। ব্যবসায়ীদের নানা নির্দেশনা দেন। টিমের সদস্যরা সতর্ক করে ব্যবসায়ীদের ন্যায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য বিক্রির নির্দেশ দেন।
মন্ত্রণালয়ের টিমের সদস্য ও জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান বলেন, খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকটি মার্কেট পরিদর্শন করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। খাতুনগঞ্জে যথেষ্ট পণ্য মজুত আছে। কোনো পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। সূত্র:যুগান্তর