ড. শোয়েব সাঈদ: ভ্যারিয়েন্ট তাণ্ডবে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই বিশ্বব্যাপী এখন কঠিন এক সময়ের মুখোমুখি। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট B.1.17, দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট B.1.351 আর ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট P.1 ভীতিকর অবস্থায় ফেলেছে বিশ্বকে। বাংলাদেশে করোনার বর্তমান ঢেউয়ের ধরনে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে চেনা, অচেনা একাধিক ভ্যারিয়েন্টের কবলে বাংলাদেশ।
ভ্যারিয়েন্ট ভীতিতে পশ্চিমা বিশ্ব চেষ্টা করছে যথাসাধ্য টিকাদানের গতি বাড়াতে যাতে ভ্যারিয়েন্টজনিত স্বাস্থ্য সংকটে থমকে না যায় স্বাস্থ্যখাত। জনগণকে যতো বেশি টিকার আওতায় আনা যাবে, কোভিড নিয়ন্ত্রণে ততো বেশি সফলতা পাওয়া যাবে। ভ্যারিয়েন্টের ক্রমবর্ধমান হুমকিতে যে ভয়টি বেশি কাজ করছে তাহলো ভ্যাকসিনকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাবান ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি। মৃত্যুর হারে ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট P.1 ব্রাজিলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছে। অপেক্ষাকৃত তরুণদের আক্রান্ত আর মৃত্যুর হারে উদ্বিগ্ন বিশ্ব। কানাডার কিছু প্রদেশে এই ভ্যারিয়েন্টের ক্লাস্টার চিহ্নিত হয়েছে। বলা হচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে কানাডা মোক্ষম সময়টুকু হেলায় হারিয়েছে। কানাডা আবারো স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠিন বিধি নিষেধের পথে।
টিকাদানের সাথে স্বাস্থ্যবিধির গভীর প্রণয় অত্যাবশ্যক। মোট জনসংখ্যার ৫০-৫৫ শতাংশ টিকাদানের সাথে স্বাস্থ্যবিধির মেনে চলার কারণে টিকা থেকে স্পষ্টই উপকার পেতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্র, সংক্রমণ আর মৃত্যু লাগাম আপাতত টেনে ধরতে পেরেছে। টিকাদানের সাথে স্বাস্থ্যবিধির বিরহের মাশুল দিতে হচ্ছে চিলির জনগণের। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ টিকাদানের পরেও স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে সংক্রমণের গতিকে থামাতে পারছে না। তবে মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সফল। ভ্যাকসিন হেজিটেন্সী অর্থাৎ টিকাদানে ইতস্ততা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনীহা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। টিকা নিয়ে মিথ্যা মিথ নিরসনে শক্তিশালী সরকারি কার্যক্রম চালু আছে বহুদেশে।
বাংলাদেশে যে উৎসাহে টিকাদান শুরু হয়েছিল, মনে হচ্ছে তা ধরে রাখা যাচ্ছে না। নেতিবাচক রাজনীতি, টিকার সেফটি নিয়ে বৈশ্বিক ঘটনাবলীর সঠিক নির্মোহ ব্যাখা, আলোচনা, প্রচারণার অভাবে টিকা বিমুখতা আমাদের দেশে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের সেরামের সাথে প্রতিশ্রুত টিকা দিয়ে মাত্র দেড় কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জনসংখ্যার টিকা দেওয়ার ফলে মনে হচ্ছিলো চারপাশের বহু চেনাজন টিকা নিচ্ছে কিন্তু বাস্তবে জনসংখ্যার মাত্র ৩.৪ শতাংশ টিকার সিঙ্গেল ডোজের আওতায় এসেছে। এই স্বল্প সংখ্যার মধ্যে আবার ভ্যাকসিন অনীহার উৎপাত বাংলাদেশের ভ্যাকসিন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। টিকা কার্যক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে তাল মেলাতে না পারলে বাংলাদেশ ক্রমশ পিছিয়ে যাবে যার অবধারিত পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি আর ব্যবসা বাণিজ্য।
সেরামের প্রতিশ্রুত ৩ কোটি ভ্যাকসিন নাড়াচাড়ার মধ্যে তৃপ্তির ঢেঁকুর একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। বাংলাদেশে বিশের নীচে বয়সের জনসংখ্যা ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ জনসংখ্যার দুই ডোজের জন্যে প্রায় ২১-২২ কোটি ভ্যাকসিনের দরকার। এই ভ্যাকসিন সংগ্রহে ব্যর্থতা ভ্যারিয়েন্টের ক্রমবর্ধমান উৎপাতে আমাদের জন্য মহাবিপদ ঢেকে আনবে, ইতোমধ্যে আমরা বিপদে আছি।
ভ্যাকসিন অনীহা দূরীকরণে সরকারকে একটা কঠোর অবস্থানে আসতে হবে। টিকার ব্যবস্থা করে টিকা গ্রহণের একটি সময়সীমা দিয়ে, টিকা সনদের ব্যবস্থা করে টিকা যারা নেননি তাদের কর্মক্ষেত্র যেমন গার্মেন্টস, কল-কারখানা, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যানবাহনে ওঠা নিষিদ্ধ করে দিতে হবে, অর্থাৎ বাধ্য করতে হবে। বহু দেশ করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাচ্ছে। সরকারের প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহ আর জনগণকে টিকাগ্রহণে আর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করা ছাড়া আমাদের বিপদ থেকে মুক্তির পথ নেই। লেখক : কলামিস্ট, অনুজীব বিজ্ঞানী, কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত
আপনার মতামত লিখুন :