সাইদুল ইসলাম, লন্ডন থেকে: শুধু যুক্তরাজ্যে নয়, পুরো ইউরোপের মধ্যে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশী মেয়র লুৎফুর রহমান। সিলেটে জন্ম নেয়া লুৎফুর ২০১০ সালে লন্ডনের বাঙালী পাড়া খ্যাত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে তীব্র প্রতিদ্বন্দীতাপুর্ন নির্বাচনে সরাসরি ভোটে নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি ছিলেন এই কাউন্সিলের কাউন্সিল লিডার।
১৯৬৫ সালের ১লা এপ্রিল লন্ডন শহরের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল সৃষ্টি হলেও এ বারায় মেয়র পদে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ২১ শে অক্টোবর। তার আগে কাউন্সিলরদের ভোটে মেয়রগন নির্বাচিত হলেও মেয়রের কোন নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না।
সে নির্বাচনের আগে লুৎফুর রহমান বৃটেনের মূল ধারার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল লেবার পার্টির রাজনীতি করতেন।
কাউন্সিল লিডার বা প্রধান থাকা অবস্থায় সে নির্বাচনে লেবার পার্টির তিন জনের ছোট প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই পাননি লুৎফুর । পরে উচ্চ আদালতের রায়ে তাকে সহ অন্য দুই বৃটিশ বাংলাদেশীকে প্রার্থী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে লেবার পার্টি।
প্রার্থী বাচাইয়ে লেবার দলের স্থানীয় সদস্যদের ভোটে লুৎফুর মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হলেও ভোটে তৃতীয় হওয়া হেলাল আব্বাস লেবার পার্টির কেন্দ্রে লুৎফুরের বিরুদ্ধে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ করেন। লেবার পার্টির প্রার্থী তালিকায় ভোটে দ্বিতীয় হন বর্তমান মেয়র জন বিগস। পরে দলের কেন্দ্র থেকে লুৎফুরকে বাদ দিয়ে তাঁর বদলে লেবার থেকে মনোনয়ন পান বাংলাদেশী বংশদ্ভূত হেলাল আব্বাস।
নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শেষপর্যন্ত লেবারের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েও স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে চমকের সৃষ্টি করেন লুৎফুর রহমান। লেবার কনজারভেটিভ পার্টির মতো ব্রিটেনের বড় দলগুলির প্রার্থীকে পরাজিত করেন বিশাল ব্যবধানে।
লুৎফুর কেবল ব্রিটেন নয়,পুরো ইউরোপের কোন শহরের বাংলাদেশী বংশোব্দুত প্রথম সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নির্বাহী ক্ষমতা সম্পন্ন মেয়র। কমিউনিটির মানুষের নানা অনুষ্টানে, জানাজায়, অসুস্থতায় পাশে থাকবার আন্তরিকতা ও জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতা লুৎফুর জনতার লুৎফুর হয়ে উঠেন। কমিউনিটিতে অনেকটা একক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে সক্ষম হন।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল হয়ে উঠে এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটি, এবং দেশ থেকে আসা মন্ত্রী সাংসদ ও সাধারণ বাংলাদেশীদের মিলনস্থল। লেবারের দুর্গে লেবারকে হটিয়ে স্বতন্ত্র লুৎফুর হয়ে উঠেন এক অপ্রতিদ্বন্দী নেতা। কমিউনিটির প্রতিটি সংগঠন,ছয়টি বাংলা টিভি আর ১২ টি বাংলা পত্রিকা; সবখানে নিজেকে শিরোনামে তুলে আনতে সক্ষম হন তিনি। মেয়র হিসেবে এখানকার সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রতিটি কমিউনিটি সংগঠন, সবাই ছিলেন লুৎফুরের আপনজন।
লুৎফুরের আন্তরিক আচরনের ক্যারিশমার বিষয়টি তার সমালোচকরাও একবাক্যে স্বীকার করেন।
তার আমলে টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় প্রায় সাড়ে পাচঁ হাজার নতুন বাড়ী নির্মান,স্কুল, কমিউনিটি পুলিশে ব্যাপক অর্থায়ন ও কবরস্থানের সমস্যা সমাধান সহ ব্যাপক উন্নয়ন হয়। তাঁর অবদানের বৌদলতে এখনো টাওয়ার হ্যামলেটসে যুক্তরাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে দাফন সম্পন্ন করা যায়। যদিও পরবর্তীতে জন বিগসের সময়কালে এই খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে।
২০১৪ সালের ২২ মে টানা দ্বিতীয়বার ৪৮ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র পদে নির্বাচিত হোন লুৎফুর রহমান। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি তাঁর বিরুদ্ধে। অবস্থানগত ও আর্থসামাজিকভাবে লন্ডনের প্রানকেন্দ্রটির মেয়র হিসেবে লুৎফুরের মতো একজন অশ্বেতাঙ্গ ও বাংলাদেশে জন্ম নেয়া রাজনীতিবিদের উত্থান শ্বেতাঙ্গ কিছু বর্নবাদী রাজনীতিবিদদের হতাশার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
একই সঙ্গে মেয়রের কাছে গুরুত্ব আর সমাদর পাবার প্রতিযোগীতায় কিছু সংক্ষুব্ধ বাংলাদেশীও ইর্ষার জেরে লুৎফুরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান। লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে খোদ বাংলাদেশীরাই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ করেন। স্থানীয় লেবার এমপি জেমস ফিটজপ্যাট্রিক অভিযোগ তুলেন লুৎফুরের বিরুদ্ধে।
নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ উঠে।
লুৎফুরের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী দেন ধর্নাঢ্য এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী,যার নিজের বিরুদ্ধে ইউরোপের একটি দেশ থেকে কয়েক কোটি টাকা জালিয়াতি করে ব্রিটেনে আনার অভিযোগ আছে।
এরই মধ্যে ২০১৪ সালের ২২ মে দ্বিতীয় দফায় মেয়র নির্বাচনে দ্বিতীয়বার ৩৮ হাজার ভোটে বিজয়ী হন লুৎফুর রহমান। সে নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশী লুৎফুরের বিরুদ্ধে প্রার্থী হলেও তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ২০১৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশী বংশোব্দুত ব্যবসায়ী আজমল হোসেন,এন্ডি এলার্ম,ডেভি সিমন, নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদ থেকে অপসারনের ক্যাম্পেইন শুরু করেন। বিষয়টি আদালতে গড়ায়। ইলেকশন ট্রাইবুনালের
আদেশে ২০১৫ সালের ২৩ শে এপ্রিল লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি ও পরবর্তী দুটি নির্বাচনে অংশ না নেবার নির্দেশনা দেয়। মামলার খরচ যোগাতে লন্ডনে নিজের বসতবাড়ীর মালিকানা হারান লুৎফুর রহমান।
পরে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দীর্ঘ চার দফায় ১.৭ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে তদন্তের পর লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, মেয়র লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়মের কোন প্রমান তারা পায়নি। সিটি অফ লন্ডন পুলিশ লুৎফুরের মেয়াদকালের আর্থিক বিষয় নিয়ে তদন্ত করে। তারাও কোন অভিযোগ পায়নি। এমনকি লুৎফুরের বিরুদ্ধে উত্তাপিত অভিযোগের বিষয়ে তাকে তদন্তকারীদল কোন কিছু জিজ্ঞেসও করেনি কোনদিন।
২০১৮ সালের ৩রা মের মেয়র নির্বাচনে লুৎফুর রহমানের নিজের গড়া দল এস্পায়ার পার্টি থেকে সমর্থন নিয়ে সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ প্রার্থী হন। কিন্তু সে নির্বাচনে লুৎফুর রহমানেরই একসময়ের অনুসারী রাবিনা খান লুৎফুরের প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে প্রার্থী হওয়ায় পরাজিত হন অহিদ আহমদ।
এদিকে, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত বর্তমান মেয়র জন বিগস সহ কনজারভেটিভ পার্টি সহ সকল দলের সংখ্যাগরিষ্ট কাউন্সিলাররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ বারায় আগামী নির্বাচন থেকে মেয়র পদে সরাসরি নির্বাচনের নিয়ম তুলে দিতে আগামী ৬ মে রেফারেন্ডাম বা গনভোটের আয়োজন করেছেন।
অন্যদিকে এ রেফারেন্ডামকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে প্রায় পাচঁ বছর পর ফের প্রকাশ্যে মাঠে এসেছেন লুৎফুর।
লুৎফুর আগামী ৬ মের রেফারেন্ডামকে সামনে রেখে পদে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের বিধান চালু রাখার পক্ষে ক্যাম্পেইন শুরু করে দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতির মাঠে নামায় করোনার মধ্যেও সরগরম স্থানীয় রাজনীতি।
রাজনৈতিক জীবনে এত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আবার কেন রাজনীতিতে প্রকাশ্যে তিনি, তাঁর কতটা করবার আছে এ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি আমাদের সময় ডটকমের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি সাইদুল ইসলামের সাথে। রেফারেন্ডামে মেয়র পদে সরাসরি নির্বাচনের বিধান চালু রাখার লড়াইয়ে জয়ের সম্ভাব্যতা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে একান্তে কথা বলেছেন তিনি।
আমাদের সময় ডটকমের প্রশ্নের জবাবে ২ সন্তানের জনক লুৎফুর রহমান বলেন, সিলেটের ওসমানীগর উপজেলার সিকন্দরপুর গ্রামে আমার জন্ম হলেও আমার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সব কেটেছে লন্ডনেই। আইনে ডিগ্রি নিয়ে একজন আইনজীবি হিসেবে লন্ডনে আমার ক্যারিয়ার শুরু। দু’দশক আইন পেশায় ছিলাম। ছাত্রজীবন থেকেই টাওয়ার হ্যামলেটস তথা ব্রিটেনের মুলধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষ তীব্র বৈরী পরিবেশেও ভালবেসে আমাকে দুবার মেয়র বানিয়েছেন। এর আগে লেবার পার্টির হয়ে দুবার কাউন্সিল লিডার ছিলাম।
লুৎফুর বলেন,শত্রুতার জন্য শত্রুতার বলি হয়েছি আমি। একটি মহলের ষড়যন্ত্র ছিল আমার পেছনে। আমাকে মেয়র পদ থেকে ট্রাইবুনাল নিদের্শে সরিয়ে দেয়া হয়। পরে দীর্ঘ প্রমান হয়েছে আমি নির্দোষ,নিরপরাধ ছিলাম।
আমি আমার জীবনে কখনো নির্বাচন করে হারিনি। এর মধ্যেই আগামী ৬ মে টাওয়ার হ্যামলেটসে আগামী নির্বাচেন মেয়র পদে সরাসরি নির্বাচন তুলে দিতে চাইছে একটি পক্ষ।
লুৎফুর রহমান আমাদের সময় ডটকমের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সরাসরি মেয়র পদে নির্বাচন ব্যবস্থা তুলে দেয়া মানে সাধারন মানুষের হাতে আর মেয়র নির্বাচনের সুযোগ থাকবে না। লিডারশীপ সিষ্টেমে কিছু ব্যাক্তি,পার্টি কাউন্সিলারকে খুশি করে লিডার হতে হয়। আমি চাই মেয়র নির্বাচনের ক্ষমতা সাধারন ভোটারদের হাতে থাকুক। টাউন হলে বসে গোপনে কাউন্সিলাররা মেয়রের পরিবর্তে কাউন্সিল লীডার বানাবেন, আমি সে সিষ্টেমের পক্ষপাতি নই।
লুৎফুর রহমান বলেন,টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষ এক দশক আগে ৬২ হাজার ভোট দিয়ে সরাসরি এবং পুরোপুরি গনতান্ত্রিক মেয়র নির্বাচনের পদ্বতি এনেছিলেন। করোনার এই দুর্যোগময় সময়ে রাষ্ট্রের প্রায় ৩৫০ হাজার পাউন্ড খরচ করে আবার একই ইস্যুতে রেফারেন্ডামের যৌক্তিকতা কোথায়? এই সাড়ে তিনশ হাজার পাউন্ড করোনা মোকাবেলায় খরচ করাই হত সংগত।
ব্রিটেনের মুলধারার বড় দলগুলো টাওয়ার হ্যামলেটসে লীডারশিপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমন বাস্তবতায় রেফারেন্ডামের রায় লীডারশিপের পক্ষে গেলে কী করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে লুৎফুর বলেন, ভোটারের রায়ের প্রতি আমার আস্থা আছে। হেরে গেলেও মানুষের সাথে থাকব।
লুৎফুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, আমার বয়োবৃদ্ধ বাবা মৃত্যুর আগে অন্তত জেনে যেতে পেরেছেন যে, আমি নির্দোষ। তাঁর সন্তান যে দুর্নীতিবাজ নয়,ব্রিটেনের আইনী ব্যবস্থা তার সাক্ষী।
লুৎফুর বলেন,আমার স্ত্রী- সন্তানরা, আমার সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরাই আমার প্রেরনার উৎস। মানুষের ভালবাসা আমাকে জনতার লুৎফুর রহমান বানিয়েছে। মানুষের ভালবাসার এ ঋণ মানুষের কাজ করে শোধ করেই জীবনভর যেতে চাই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে লুৎফুর রহমান বলেন,বাংলাদেশ আমার জন্মভুমি। যদিও বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল বা মতের প্রতি আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। বিগত দিনে এ বারার কিছু ব্রিটিশ বাংলাদেশী মানুষকে আমার বিরুদ্ধে ভুল বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। আমি বিশ্বাস করি,আমাকে ন্যায়হীন ভাবে সরিয়ে দেয়ায় এ বারায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত ব্রিটিশ বাংলাদেশী সহ ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।