রাশিদুল ইসলাম : [২] ঔপনিবেশিক সময়ে বৃটিশ ভারতের দরিদ্রতম অংশগুলোর একটি ছিল পূর্ববঙ্গ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে তা পরিণত হয় পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধে আরো দরিদ্র হয় দেশটি। আর এখন দেশটির মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে ভারতের কাছাকাছি চলে এসেছে। কোভিড মহামারির আগে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টানা চার বছর ৭ শতাংশের বেশি ছিল, যা পাকিস্তান, ভারত ও চীনের চেয়েও বেশি।
[৩] বাংলাদেশিরা বর্তমানে কেবল আগের তুলনায় বেশি ধনীই নন, একইসঙ্গে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি শিশু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। আশির দশকে যা ছিল মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে। কমেছে শিশু মৃত্যুর হার। সব দিক থেকেই পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করছে বাংলাদেশ।
[৪] মুক্তিযুদ্ধ যতটাই বিপর্যয়কারী হোক না কেন, তা অনেক দিক থেকে বাংলাদেশকে সফলতার পথে নিয়ে গেছে। দেশকে উদ্ধারে ফিরে এসেছিলেন অনেক প্রবাসী। বৃটেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সস্তায় জেনেরিক ওষুধ ও গর্ভনিরোধক বিলি করতে দাতব্য সংস্থা স্থাপন করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরি। লন্ডনে নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে আরেকটি দাতব্য সংস্থা ব্র্যাক গড়ে তোলেন ফজলে হাসান আবেদ। এটি ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
[৫] দাতব্য সংস্থা ও এনজিওগুলোকে খুশিমনেই এসব কাজ করতে দিয়েছে তৎকালীন সরকার। আশির দশকে শিশুদের পোলিওর মতো রোগের টিকা দেওয়ার কর্মসূচীর অর্ধেক সম্পন্ন করেছিল সরকার ও বাকি অর্ধেকের দায়িত্ব নিয়েছিল ব্র্যাক। ওই দশক শেষ হওয়ার আগে দেশটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার হার ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে পৌঁছায়।
[৬] নব্বইয়ের দশকের দেশে ৬৪ হাজার স্কুল পরিচালনা করছিল ব্র্যাক। এসব স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। তাদের শেখাতে নিয়োগ দেওয়া হতো নারীদের। বর্তমানে দেশটির উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি।
[৭] বিজিএমইএ-এর সভাপতি রুবানা হক বলেন, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ পোশাক শিল্প নারীদের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে। মজুরিসম্পন্ন কাজে নারীদের অংশগ্রহণ ৫০ বছর আগে ৩ শতাংশ ছিল। এখন তা ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ৪০ লাখ পোশাককর্মীর ৮০ শতাংশই নারী। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে পুরো বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশের জিডিপির ১১ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে।
[৮] একদলীয় রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ও তার কন্যা শেখ হাসিনা, আপাতদৃষ্টিতে পিতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিধান বাতিল করে দেন তিনি। [৯] তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার দাবি, তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
[১০] ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ তোলে, তাদের ৭ হাজারের বেশি কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মতো অনেককে দোষী সাব্যস্ত আসামী হওয়ার কারণে নির্বাচনে লড়তে দেওয়া হয়নি। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
[১১] আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুরুতর অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। সরকারি চুক্তিগুলো প্রায়ই দলীয় নেতাদের ঘনিষ্ঠরা পেয়ে থাকেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছে। দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে যাদের, তারা ঋণ পরিশোধ করছেন না। আদালতেও গিয়েও লাভ নেই: সেখানে সবসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা ব্যক্তিরাই জয়ী হন।
[১২] ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সবচেয় ধনী পরিবারগুলোর আয় বেড়েছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এ সময়ের মধ্যে দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। এজন্য ব্যবসায়ী এলিটদের ‘রেন্ট-সিকিং’-কে দায়ী করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে রেন্ট-সিকিং ধারণা হচ্ছে সমাজের কোনো সুবিধা বা সম্পদ সৃষ্টি না করেই কোনো ব্যক্তির নিজস্ব অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা।
[১৩] বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি দুই শতাংশ কম হয়ে থাকে। দেশে কমছে বৈদেশিক বিনিয়োগও।
[১৪] ব্র্যাকের প্রধান আসিফ সালেহ বলেন, জাতীয় দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার পরিমাণ মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। কাজের সন্ধানে কেউ বিদেশ যেতে পারছে না। এতে ভবিষ্যতে দেশে রেমিট্যান্স প্রবেশের হার কমার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর দেশে ঢোকা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারের সমান। এদিকে, বিদেশে লকডাউনের ফলে কাপড়ের চাহিদা কমেছে। যার ফলে ক্রয়াদেশ বাতিলের শিকার হয়েছে দেশের পোশাক কারখানাগুলো।
[১৫] রুবানা হক বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে গেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ এর মধ্যে কর্মরত নারীর সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১.৭ শতাংশ করে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে এ বৃদ্ধির হার কমে ০.৭ শতাংশে নেমেছে। তিনি বলেন, আইনের সুশাসন ও রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ছাড়া নারীদের প্রতি সহিংসতা অনিয়ন্ত্রিতই থেকে যাচ্ছে। (সংক্ষেপিত)
আপনার মতামত লিখুন :