ড. শোয়েব সাঈদ , কানাডায় অভিবাসনের শুরুতে টোকিও থেকে টরেন্টোতে আসা। সময়টা ২০০৮ এর সেপ্টেম্বরে, আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে জাপানের নারিতা থেকে ডালাস হয়ে টরেন্টো। ওয়ান ওয়ার্ল্ড এলায়েন্সের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত (স্যাফায়ার) যাত্রী হবার সুবাদে তখন জাপান এয়ারলাইন্স, আমেরিকান এয়ারলাইন্স আর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে যাতায়ত ছিল বেশী।
বাচ্চাদের জন্যে বিমান ভ্রমণ খুব উৎসাহের বিশেষ করে লাউঞ্জ সহ সুবিধেগুলো সহযোগে। জন্ম আর বেঁড়ে উঠা জাপান ছেড়ে কানাডায় বসতি স্থাপনের শঙ্কা, উত্তেজনা, আর বিষণ্ণতার ককটেলে বাচ্চা দুটোর প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। এসবের মাঝেই এরা ভ্রমণের আনন্দটুকু উপভোগে ব্যস্ত ছিল সারাক্ষণ।
রেড আই অর্থাৎ রাত্রিকালীন ফ্লাইটের বোয়িং ৭৭৭ বিমানটিতে সপরিবারে নারিতা থেকে ডালাসে পৌছাই সকালে। কয়েক ঘণ্টার লে-ওভার সময় কাটিয়ে ডালাস থেকে আবার টরেন্টোর ফ্লাইট। যুক্তরাষ্ট্রের এবং বিশ্বের বৃহত্তম এয়ারলাইন্স আমেরিকান এয়ারলাইন্সের প্রধানতম হাব হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাস বিমানবন্দর। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যস্ত ডিএফডাব্লিও অর্থাৎ ডালাস/ফোরথ ওয়ারথ ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের পাশেই আমেরিকান এয়ারলাইন্সের সদর দপ্তর।
তখন জাপান থেকে ডালাস হয়ে কানাডা যাত্রায় আমেরিকান এয়ারলাইন্সের যাত্রী হলে লাগেজ সরাসরি চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ডালাসে কোন প্রকার চেকিং ছাড়া। এই সুবিধের ফলে ট্রানজিটের সময় লাগেজ টানাটানির ঝামেলামুক্ত থাকা যায় এবং শুধুমাত্র এই কারণেই শিকাগো, নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো না হয়ে ডালাস হয়ে আসা।
বেশী বুদ্ধি ভাগ্য দোষে ব্যাকফায়ার করলে মহা ঝামেলা। ডালাস এয়ারপোর্টের এক ফাঁকিবাজ কুকুরের লোভের কাছে বেশী বুদ্ধিকে মনে হচ্ছিল নির্বুদ্ধিতা।
বিমান ডালাসে অবতরণের পর ইমিগ্রেশন পার হয়ে কাস্টমস, তারপর কানেক্টিং ফ্লাইট পর্যন্ত লাউঞ্জে বিশ্রাম বা দোকানপাটে ঘুরাঘুরি এরকম পরিকল্পনার শুরুতেই ঘটল বিপত্তি।
ইমিগ্রেশন বুথের সামনে অপেক্ষারতদের আশেপাশে প্রশিক্ষিত কুকুরে আনাগোনা যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিমানবন্দরে নিয়মিত দৃশ্য। কুকুর আমি আর আমার বাচ্চাদের খুব প্রিয় প্রাণী ফলে কুকুরের আনাগোনা ভালই লাগছিল; আমার স্ত্রী অবশ্য বিপরীত, বিরক্ত হচ্ছিল। কুকুর বাহিনী নীরবেই তাদের কাজ করে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই একটি কুকুর আমার স্ত্রীকে ঘিরে ঘেউ ঘেউ করতেই সিকিউরিটির ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেল আমার স্ত্রীর পাশে।
ব্যস, সচল হয়ে গেল টিএসএ অর্থাৎ ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশনের নিরাপত্তা কর্মীদের ওয়াকিটকিগুলো, শুরু হয়ে গেল দৌড়ঝাঁপ। নিমিষেই চলে এল বেশ কয়েকজন অফিসার, তারপর ছেলে মেয়ে সহ আমাদের সবার পাসপোর্ট, বোর্ডিং পাস ওদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইমিগ্রেশন লাইন থেকে আলাদা করে নিয়ে গেল বিশেষ রুমে। আমরা হয়ে গেলাম ইমিগ্রেশন হলরুমের চারপাশের সবার দৃষ্টি নিবন্ধের কেন্দ্রবিন্দু।
পেশাগত কাজে জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তখন আমার যাতায়ত ছিল নিয়মিত, ফলে সন্দেহভাজন যাত্রীদের ইমিগ্রেশনের পর বিশেষ রুমে দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি জানা ছিল। অভিজ্ঞতার আলোকে না চমকিয়ে বিরক্ত হলেও উপভোগ করার চেষ্টা করছিলাম। বিরক্তির কারণ ছিল টরেন্টো ফ্লাইট মিস করার দুশ্চিন্তা।
আমরা অবশ্য ইমিগ্রেশনে সন্দেহভাজন ছিলাম না, ছিলাম নিষিদ্ধ বা বিপদজনক পণ্য বহনে সন্দেহভাজন। এই রুমগুলোতে নিরাপত্তা কর্মীদের ব্যবহারের প্রাথমিক কৌশল হচ্ছে অহেতুক বসিয়ে রেখে পাত্তা না দিয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টির খেলা। আমরা যারা ট্রানজিট যাত্রী, তাদের উপর এটি কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করার প্রবল চাপ তৈরি করে। বাচ্চারা সাথে থাকায় দীর্ঘক্ষণ উপেক্ষিত থাকতে হলোনা। প্রথম ধাপে নানা প্রশ্নের উত্তর অর্থাৎ মৌখিক পরীক্ষার পর এবার ওরা দ্বিতীয় ধাপের ব্যবহারিক নিরাপত্তা তল্লাশি শুরু করল।
কুকুরটির লক্ষ্য ছিল আমার স্ত্রী’র ভ্যানিটি ব্যাগ। উনারা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের সব লাগেজ চেক করার। আমাদের যে লাগেজগুলো সরাসরি টরেন্টো চলে যাবার কথা ছিল, বিশেষ ব্যবস্থায় রি-কল করে সেগুলোকে আনা হল লাগেজ বেল্ট এলাকার একটি কর্নারে তারপর চলল প্রতিটি লাগেজ খুলে খুলে তল্লাশি। খুলার পর সরি বলে আবার আমাকেই দিচ্ছিল স্যুটকেস লাগাতে।
আমাদের উপমহাদেশের কালচারে ভ্রমণের সময় স্যুটকেস ভর্তি করার বিষয়টি খুব আগ্রাসী, ঠাসাঠাসির বিষয়। অভিবাসনে একদেশ থেকে অন্য দেশে যাবার সময় পারলে পুরো বাসাটিকে স্যুটকেসে ভরে নিয়ে যাবার প্রবণতার প্রতি গৃহিণীদের দুর্বলতাকে উপেক্ষা করা কঠিন। এই অবস্থায় যাত্রার মাঝপথে স্যুটকেস খুলতে হলে বিড়ম্বনার শেষ নেই। একে একে ৯ টি স্যুটকেসের একই পরিণতির পর এবার নজর গেল ক্যারিঅন লাগেজের উপর, একে একে সব খুলা হল।
সব লাগেজ চেক করেও কিছু না পেয়ে এবার নিরাপত্তা অফিসারদের ব্রেইন স্টর্মিং বা ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং এর পালা। প্রাথমিকভাবে আমার স্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগ চেক করে ওরা কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার মত কিছু পায়নি। আমাদের কোন পরামর্শও উনারা আমলে নিচ্ছিল না। এই অবস্থায় কুকুরটিকে আবার ডেকে আনা হল। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল আমার স্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগে রাখা কয়েকটি চকলেটের প্রতি কুকুরটি আসক্তি। আর চকলেটের প্রতি এই কুকুরের লোভ ছিল আমাদের বিড়ম্বনার কারণ। নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত কুকুরটির এই আচরণ প্রশিক্ষণের শিক্ষানুসারে ছিল অপেশাদারী।
আমাদের ছোট বেলায় বিটিভিতে দেখা বিখ্যাত টিভি সিরিজ ডালাসের শহরের বিমানবন্দরটি সপরিবারে ঘুরে দেখার আনন্দকে মাটি করে, কানাডায় অভিবাসনের শুরুতেই ফ্লাইট মিস করার প্রবল চাপের তিন ঘণ্টার ঘর্মাক্ত এপিসোডটির অবসানে সিকিউরিটি অফিসারের মুখে ছিল একটি খুবই শুকনো “সরি”।
আমাদের কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে অফিসারকে দেখলাম ফোনে কুকুরটিকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে, সম্ভবত ঊর্ধ্বতনকে বলছিল কুকুরটির চকলেট প্রীতি আর প্রশিক্ষনের অপর্যাপ্ততা নিয়ে। যাত্রীদের অহেতুক এই হেনস্তা নিয়ে অবশ্য ওদের মাথাব্যাথা ছিল বলে মনে হয়নি। বকশিস বা টিপস যে জাতি দাবী করে, হার নির্ধারণ করে আদায় করে নেয়, সেই ট্রাম্পিয়ান জাতির বিরাট অংশের অন্যদের নিয়ে ভাবার সময় নেই।
শেষতক অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুততার সাথে ডালাস বিমানবন্দরে আমাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করে দেবার ফলে ম্যাগডোনেল ডগলাস এমডি ৮০ এর সরু দেহের বিমানের ডালাস থেকে টরেন্টোর ফ্লাইটটি ধরতে বেগ পেতে হয়নি।
লেখকঃ কানাডার একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
আপনার মতামত লিখুন :