শিরোনাম
◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ভারত থেকে ১৬৫০ টন পেঁয়াজ আসছে আজ! ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত

প্রকাশিত : ০৯ মার্চ, ২০২১, ১০:৩০ দুপুর
আপডেট : ০৯ মার্চ, ২০২১, ১০:৩০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. নজরুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা-দক্ষতার ওপর জনগণের আস্থা

ড. নজরুল ইসলাম : অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আমার প্রথম পদার্পণ ১৯৭৮ সালের ১৩ জুলাই। তার দুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেছে। ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমের ঝামেলা চুকিয়ে যখন সিডনি এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছিলাম তখন মনে মনে ভয় হচ্ছিলো, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও গোলমালের সম্মুখীন হবো নাতো। এরপর অস্ট্রেলিয়ার এগারোটি সাধারণ নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে কোনো গোলমাল কখনো দেখিনি। নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সবাই জনগণের রায় মেনে নেয়। অস্ট্রেলিয়ার সংসদে আছে দুইটি কক্ষ। নিম্ন-কক্ষের নাম প্রতিনিধি পরিষদ (হাউজ অব রেপ্রেজেন্টেটিভ্স) এবং এর সদস্য সংখ্যা ১৫১। উচ্চকক্ষের নাম সিনেট এবং এর সদস্য সংখ্যা ৭৬। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা মেম্বার অফ পার্লামেন্ট (এমপি) এবং সিনেটের সদস্যরা সিনেটর নামে পরিচিত। প্রতিটি এমপির নির্বাচন এলাকার সীমানা সতর্কতার সঙ্গে নির্ণয় করা হয় যাতে প্রত্যেকটিতে মোটামুটি একই সংখ্যক ভোটার থাকে। নির্বাচন পরিচালনা ও তদারকি করার দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচন কমিশনের। ভোটার তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বও তাদের। এই দায়িত্বটি নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে থাকে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে, প্রায় ১৬.৫ মিলিয়ন ভোটার বা যোগ্য ভোটারদের ৯৬.৮ শতাংশ ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছিলো। এ ছাড়া কমিশনের অন্যান্য দায়িত্বর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচন এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবদ্ধকরণ এবং তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ।
প্রতিনিধি পরিষদের মেয়াদ তিন বছর। তবে প্রধানমন্ত্রী তার সুবিধা মতো যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য বেছে নিতে পারেন। সরকার যাতে হঠাৎ করে নির্বাচন ডেকে বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলতে না পারে, সে জন্য নির্বাচনী প্রচারের জন্য সর্বনিম্ন ৩৩ দিন নির্ধারিত আছে। সাধারণত নির্বাচনী প্রচার ৫ সপ্তাহ ধরে চলে। নির্বাচন ডাকার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো বড় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। জরুরি বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে বিরোধীদলের আনুষ্ঠানিক পরামর্শ নিতে হয়। প্রার্থীরা নির্বাচনের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রচার চালায়। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর প্রচারণা আরও বেড়ে যায়। দলের নেতারা নির্বাচনী প্রচার চালায় সেই সব আসনে যেখানে গত নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান ছিলো সংকীর্ণ (৬ শতাংশ বা তার কম)। এগুলোকে প্রান্তিক আসন বা মার্জিনাল সিট বলা হয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ২১ টি মার্জিনাল সিট আছে। আগামী নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে এই আসনগুলিতে জয়ের উপর। অস্ট্রেলিয়ায় কোনও প্রার্থীকে একাধিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কখনও দেখেনি। আইনত তা সম্ভব কিনা তা জানি না। তবে এটাই দেখেছি কোনও প্রার্থী যদি তার নির্বাচনী এলাকায় বসবাস না করে তা হলে তাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া ভোট না দিলে জরিমানা দিতে হয়। এই কারণে ভোট প্রদানের হার সবসময় বেশি থাকে। ১৯২৫ সালে বাধ্যতামূলক ভোটদানের সূচনা হওয়ার পর, প্রত্যেক নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারদের ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল ৯১.৯ শতাংশ। কাজেই অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচিত সরকারের বৈধতা অনেক বেশি। প্রসঙ্গত পৃথিবীর মাত্র ১৩ শতাংশ দেশগুলিতে বাধ্যতামূলক ভোটদানের ব্যবস্থা আছে। অস্ট্রেলিয়ায় ভোট দিতে গেলে তিনটি প্রশ্ন করা হয়। প্রথম প্রশ্ন- ‘আপনার পুরো নাম কি?’ নির্বচন কর্মকর্তা কাগজে ছাপানো ভোটার তালিকায় নাম খুঁজে বের করার পর পরবর্তী প্রশ্ন- ‘আপনি কোথায় থাকেন?’ প্রদত্ত ঠিকানাটি যদি ভোটার তালিকার নামের সঙ্গে মিলে যায় তবে পরবর্তী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়- ‘আপনি কি এই নির্বাচনে ইতোমধ্যে ভোট দিয়েছিলেন?’ উত্তর না হলে, ভোটারকে দুইটি ব্যালট পেপার দেওয়া হয় - একটি প্রতিনিধি পরিষদের জন্য এবং অপরটি সিনেটের জন্য। প্রতিটি ব্যালট পেপারে নির্বাচন কর্মকর্তা সাক্ষর দিয়ে দেন এবং সেই সঙ্গে ভোটার তালিকায় ভোটারের নাম চিহ্নিত করে রাখেন। লক্ষণীয় যে অস্ট্রেলিয়ায় ভোট দিতে কোনও পরিচয় পত্রের প্রয়োজন হয় না। আসলে অস্ট্রেলিয়ায় কোনও জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ‘অস্ট্রেলিয়া কার্ড’ নামে একটি জাতীয় পরিচয় পত্র প্রবর্তনের জন্য ১৯৮৫ সালে সরকার উদ্যোগ নিয়েছিলো, তবে জনগণের বিরোধিতার কারণে তা পরিত্যক্ত হয়। ভোট দানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভোটারের সততার উপর নির্ভর করা হয়। তবে অস্ট্রেলিয়ায় ভোট জালিয়াতির কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদে একাধিক বার ভোট প্রদানের মাত্রা ছিলো মাত্র ০.০৩ শতাংশ। একাধিক বার ভোট প্রদানকারীদের বেশিরভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছিলেন।
সন্ধ্যা ৬ টায় ভোট কেন্দ্রের দরজা বন্ধ হওয়ার পরপরই ভোট গণনা শুরু হয়ে যায়। একই সময়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলো নির্বাচন উপলক্ষে তাদের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। প্রতিটি চ্যানেলের সাংবাদিক, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধি এবং নির্বাচন বিশ্লেষক নিয়ে গঠিত নিজস্ব প্যানেল থাকে। নির্বাচন প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় কোনও ক্লাব বা হোটেলে তাদের দলের কর্মীদের নিয়ে এই সব অনুষ্ঠান দেখতে থাকেন। দল-প্রধানদের জন্য আয়োজন অনেক বড় থাকে। তবে তারা পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে বাড়িতে বসে নির্বাচনের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে নির্বাচনকেন্দ্রগুলি থেকে ভোট গণনার ফলাফল আসতে থাকে এবং টিভি চ্যানেলের নির্বাচন বিশ্লেষকরা তা বিশ্লেষণ করে প্রতিটি আসনটি কে জিততে পারে তা বোঝার চেষ্টা করেন। রাত ৮ টার মধ্যেই কোন দল সামগ্রিক ভাবে জয়লাভ করবে তার আভাস পাওয়া যায়। এরপর একে একে আসনগুলিতে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। সাধারণত রাত ১০/১১ টা নাগাদ পুরো ফলাফল জানা যায়। কনভেনশন অনুসারে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার অল্প সময়ের মধ্যেই, পরাজিত দলের নেতা ফোনে বিজয়ী দলের নেতাকে অভিনন্দন জানান। তারপর তিনি তার দলের অনুষ্ঠানে যান এবং প্রকাশ্যে নির্বাচন পরাজয় স্বীকার করেন। সেই সঙ্গে দলীয় নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। এরপর সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তার দলের অনুষ্ঠানে গিয়ে বিজয় ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি তার সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটা রূপরেখা দেন। সঙ্গে থাকে পরাজিত দলের নেতার জন্য সহানুভূতি এবং শুভ কামনা। এরকমই দেখে আসছি ৩৩ বছর ধরে। অস্ট্রেলিয়ায় শান্তিপূর্ণ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধান কারণ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতার উপর জনগণের আস্থা। সেই সঙ্গে রয়েছে জনগণের সততা এবং দেশপ্রেম। আর সবচেয়ে বড় কথা প্রার্থীদের পরাজয় স্বীকার করে জনগণের রায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা।
লেখক : শিক্ষক, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়