শিরোনাম
◈ এলডিসি উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য দুঃখজনক: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত ◈ জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ মুক্ত করার বিষয়ে  সরকার অনেক দূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ◈ এসএসসি পরীক্ষায় আমূল পরিবর্তন, বদলে যেতে পারে পরীক্ষার নামও ◈ পঞ্চম দিনের মতো কর্মবিরতিতে ট্রেইনি ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ◈ অর্থাভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়বেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী ◈ কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় কোনো নিশ্চয়তা নেই: ফখরুল ◈ জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের কাছাকাছি বাইডেন ◈ আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নতুন তারিখ ৮ মে

প্রকাশিত : ০৭ মার্চ, ২০২১, ১১:২১ দুপুর
আপডেট : ০৭ মার্চ, ২০২১, ১১:২১ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. আবুল বারকাতের বই ‘বড় পর্দায় শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ একটি পর্যালোচনা: প্রেক্ষিত-শোভন নারী

ড. শেলীনা আফরোজা: ২০২০, ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ, লেখক নিজ স্বাক্ষরে আমায় সৌজন্য কপি পাঠিয়েছেন । ৬৬০ পৃষ্ঠার বই আমার কাছে বিস্ময়, বইয়ের নামটিও বেশ বড়, একবার পড়ে মনে বিষয় বোধগম্য হলেও হুবহু মনে রাখা যায় না । এই বয়সে এতো ধৈর্য! প্রথমপাতা খুলে চমকিত, লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন সক্রেটিস, সেনেকা, ব্রুনো, সালভাদর, শেখ মুজিবুর রহমান, প্যাট্রিসলুমুম্বা, চে গুয়েভারা, কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, উইলিয়ামবা রাসেল এবং নোয়াম চমসকি -কে। উৎসর্গে আরও লিখেছেন ‘এবং নির্ভীক -নির্লোভ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে, যারা শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রত আছেন থাকবেন।’ বইটার নামকরণ করা হয়েছে ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র, ভাইরাসের মহা বিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের, সন্ধানে।’ লেখক ড. আবুল বারকাত, অর্থনীতিবিদ।

প্রচ্ছদে আরও লেখা আছে,‘Congratulations on the book- Noam Chomsky.’ বই থেকে জানলাম, নোয়াম চমসকি গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু, উপস্থাপন কাঠামো ও উপসংহারের ইংরেজি ভাবানুবাদ দেখেছেন। সুদূর আমেরিকার পেনসালভানিয়া শহরে জন্ম নেওয়া নোয়াম চমসকিসম্পর্কে জানতে ইচ্ছে জাগলো। গুগলে গিয়ে দেখলাম, ‘Avram Noam Chomsky is an American linguist, philosopher, cognitive scientist, historian, social critic, and political activist.’ বয়স বিরানব্বই বছর। তিনি লিখেছেন, It’s pretty ironic that the so called ‘least advanced’ people are the ones taking the lead in trying to protect all of us, while the richest and most powerful among us are the ones who are trying to drive the society to destruction.’ - চমৎকার কথা। এবারে নজর পড়লো আমার হাতের ভারী বইটির সূচিপত্রে। বইটিতে উপসংহার সহ ১২ টি অধ্যায়। কিছু কিছু অধ্যায় এবং উপ - অধ্যায়ের নামকরণ আমায় ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করে। আমার পছন্দের কিছু লাইন যদি একসাথে মিশিয়ে লিখি, তবে যা দাঁড়ায় তা হল :

ক্স মুক্তিযুদ্ধের চেতনাররাজনৈতিক অর্থনীতিঃ শোভন জীবন ব্যবস্থারভিত্তি।
ক্স ধনী দরিদ্র শ্রেণি বৈষম্য - অসমতাঃ শোভন সমাজ বিনির্মাণে প্রধান দূর্ভাবনারবিষয় ।
ক্স সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদঃ শোভন সমাজের অশোভন প্রতিপক্ষ।
ক্স বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ঃ ‘বিপন্ন জীবন’ এবং স্বাস্থ্য খাতের অপ্রস্তুতি।
ক্স কোভিড-১৯ ‘জীবিকার’ পথরুদ্ধকরেছে; হবেটা কি! কি করা জরুরি।
ক্স কোভিড - ১৯ - এর মহাবিপর্যয় ও মহামন্দা থেকে মুক্তি ঃ শোভন সমাজ - অর্থনীতি বিনির্মাণ মডেল ।
ক্স দারিদ্র - বৈষম্য - অসমতা ঃ অশোভন সমাজের গোড়ারকথা।
ক্স ভাইরাসের মহা বিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশ ঃ বিকল্প বাজেট ২০২০ - ২০২১ ।

এ পর্যায়ে এসে আমার মনে হয়েছে লেখক দেশের সাথে নিজেকে বিলীন করে ভাবছেন। তিনি অশোভন সমাজের কথা বলতে গিয়ে কৃষি , শিক্ষা , স্বাস্থ্য ,শিল্প , নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশুর বিকাশ এবং প্রতিবন্ধী মানুষের সক্ষমতার বিকাশকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। অধ্যাপক এবং অর্থনীতিবিদ লেখকের মানবিকতা এবং সমাজের প্রতি দ্বায়বদ্ধতার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ আমি অনুভব করি। সূচী থেকে বুঝতে পারি, তিনি শুধু সমস্যার কথা তুলে ধরে ক্ষান্ত হননি, লিখেছেন, প্রকৃতি - পরিবেশ - উন্নয়ন, প্রকৃতির সূর্যকেন্দ্রিক ধারণা প্রসঙ্গে। সরকার টাকা পাবে কোথায় সেটিও তিনি ভাবছেন। তিনি এই বইয়ের মাধ্যমে পথ খুঁজছেন ভাইরাসের মহা বিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশ বিনির্মাণের।

উপসংহারের নাম দিয়েছেন , ‘কোভিড - ১৯ মহামারীর বিশ্বে পরিবর্তন অনিবার্য - আমরা কি চাই ।’ এরপর বইয়ের অন্তরে প্রবেশ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই! এতে আছে ২৭ টি সরণি, ৩৯টি লেখচিত্র। লেখক কতোটা বিনয়ী তা তার কৃতজ্ঞতার তালিকা থেকে অনুমান করা যায়। অধ্যাপক নোয়াম চমসকির পাশাপাশি তিনি তার প্রাথমিক স্কুলের ভোলানাথ স্যার এবং ইয়াকুব স্যারকে কৃতজ্ঞতারবন্ধনে আবদ্ধ করতে ভুলেননি। উল্লেখ করেছেনপাণ্ডুলিপি আনা নেওয়া করা কর্মী ফয়েজ, জুন্নন এবং প্রসেনজিত এর কথা। চিলেকোঠায় বসে বই রচনায় গভীরভাবে নিমগ্ন লেখককে চা পানি দিয়ে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন যে আমেনার মা, শিল্পী,স্বর্ণা তারাও আছেন তালিকায়।

এই তালিকায় আমার জীবনসঙ্গী রাষ্ট্রদূত আবদুল হান্নানের নাম দেখে আমি বিশেষভাবে পুলকিত। আশাবাদী এই লেখক তার কৃতজ্ঞতার সবশেষে দার্শনিক জ্যা - জ্যাক রুশোর (১৭১২ - ১৭৭৮ ) কথার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘আমি খুব ভালো করেই জানি , এসব জানার কোনও আগ্রহ পাঠকের নেই। কিন্তু আমার আগ্রহ আছে তাদের বলার।’ লেখক বলছেন, ‘ আগাম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তাদের কাছে- যারা এই গ্রন্থটি পাঠ করবেন, ভাববেন, গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। - অন্যকে উদ্বুদ্ধ করবেন এবং এসব করে নির্মোহ জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শোভন সমাজ বিনির্মাণে প্রক্রিয়া ত্বরান্নিত করবেন।’ এরপর দায়িত্ববোধ করছি বইটি পড়ার। ড. বারকাত বলেন, তার জনগণ নিয়ে ভাবনার ল্যাবরেটরি ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।’ এই অর্থনীতি সমিতির ব্যানারে তিনি বইটি প্রকাশ করে তার মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। মুখবন্ধ শুরু করেছেন মানুষের ইতিহাস দিয়ে। তার মতে ইতিহাসের শুরুটা অসীম প্রকৃতিতে টিকে থাকার লড়াই। লড়াইটাছিল একতরফা। কারণ সমুদ্রে জলোচ্ছাস, বন্যা, শৈত্যপ্রবাহ, ঝড় বৃষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে মানুষ, প্রকৃতি নয়। প্রকৃতি বরং না চাইতেই ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য সব উজাড় করে দিয়েছে। তার মতে প্রকৃতি বিরক্ত হয়েছে ‘বোকা মানুষের যুদ্ধ’ ঘোষণায়। ‘দাস বাবস্থাতেই যখন থেকে দাস -মানুষ এবং জমিজমা বেচা কেনার পণ্যে রূপান্তরিত হলো, ঠিক তখন থেকেই শুরু ‘প্রকৃতির পণ্যায়ন’ (Commodification of Nature) । তিনি ঘটনা পরম্পরায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, দাস ভিত্তিক শোষণ, কৃষক - প্রজা – ভূমিদাস - ভূস্বামীর জন্ম, সামন্তবাদ, সমাজের পণ্যায়ন, বাবসায়ী ও অর্থলগ্নিকারি, ‘মুক্তি -সাম্য -ভ্রাতৃত্ব’ - এর নামে, সামন্তবাদীশোষণ বাবস্থার রূপভেদের মাধ্যমেই জন্ম নিলো পুঁজিবাদ। তার মতে পুঁজিবাদ নতুন শোষণ ব্যবস্থারনাম। পুঁজিবাদের উলঙ্গ মর্মার্থ বিশ্লেষণ করে সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে লেখক শোভন সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার তত্ত্ব কাঠামো বিনির্মাণ এবং তা বাস্তবায়নের যুক্তিসঙ্গতযুক্তি তুলে ধরেছেন । এসবই এই গ্রন্থের মূল বিচার্য বিষয় ।

তিনি লিখেছেন, ‘ আমরা যে সমাজে বাস করি, তা ‘অশোভন’ (ওহফবপবহঃ), যে কোনো মানদণ্ডেই অশোভন। বিষয়টি ব্যক্তিরইচ্ছা -অনিচ্ছানির্ভর নয় । ‘তার মতে এই সিস্টেমেরই নাম পুঁজিবাদ। সে কারণেই তিনি অশোভন সিস্টেম থেকে শোভন সিস্টেমে যাবার কথা বলছেন। বইয়ে প্রদত্ত মন্তব্যে অনেকে লেখক এর হিংস্রতম বিরোধিতা করবেন, এ শঙ্কাও তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। বাস্তবতার নিরিখে দীর্ঘ এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি মত প্রকাশ করেন যে, সিস্টেম হিসেবে পুঁজিবাদ গণতন্ত্রী নয়, সভ্য তো নয়ই, বরং তা অসভ্য বর্বর। কারণ যা অগনতান্ত্রী তা সভ্য নয়। কারণ সেখানে আইনের শাসন এবং শক্তি প্রয়োগের শাসন দুটোই বিদ্যমান। তার মতে পুঁজিবাদ অদক্ষ সিস্টেম। তিনি বলেন, ‘সিস্টেম হিসেবে পুঁজিবাদের সামাজিক অকার্যকর, অফল প্রদতাও অদক্ষতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে এই করোনাকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের আবাসন চাহিদা সমাধানে গুরুতর অসহায়ত্ব।’- এর ফলশ্রুতিতে মানুষের জীবনে যে অসহায়ত্ব নেমে এসেছে, তা সামাল দিতে পুঁজিবাদ ব্যর্থ। বইয়ে লিখিত সব বিষয়ে পাঠ করার সাধ জাগছে। যতোই পড়ছি এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করছি। অনেক বিষয়ই মনে হচ্ছে জানি, জানতাম, কিন্তু লেখকের মতো করে ভাববার মতো জ্ঞান অর্জিত হয়নি বলাই বাহুল্য। ১০ম অধ্যায়ের ১০.৮ ক্রমিকে তিনি নারীর ক্ষমতায়ন এর সাথে জুড়ে দিয়েছেন শিশুর বিকাশ প্রসঙ্গ। বলছেন গভীর মননিবেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির কথা (পৃষ্ঠা ৩৮৮ - ৪১৪ )। তিনি বাস্তব সম্মতভাবেই অনুধাবন করেছেন, নারীর ক্ষমতায়নও শিশুর বিকাশ ধারণা হিসেবে দুটোই স্বাধীন হলেও তারা ব্যাপকভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল। কিন্তু এই দুয়ের মাঝে যেটি অনুচ্চারিত থেকে যায় তিনি ভাবছেন সেটি নিয়ে। তার মতে এবং আমিও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি শিশুর বিকাশের মান ও মাত্রার সাথে পরিবারের নারীর ক্ষমতায়নের মানও মাত্রা সম্পর্কযুক্ত। পুষ্টিহীনমায়ের রুগ্ন শিশুরবিকাশ হয় বাধাগ্রস্থ যার নেগেটিভ প্রভাব চলে বংশ পরম্পরায়।

লেখকের কথার সমালোচনা করবো কি, উল্টো যতোই পড়ছি মনে হচ্ছে সবার সাথে শেয়ার করি। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনে বেড়ে উঠার সুযোগ শিশুদের থাকে মাত্র একবার -- মাতৃ গর্ভে এর পরবর্তীকালে পরিবার - প্রতিবেশ - পরিবেশে । যখন বলা হয় ‘আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ’ তখন এর যৌক্তিক মর্মার্থ হলো আগামীর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আজকের নারীকে ক্ষমতায়িত করতেই হবে।’ তিনি বলেন প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন দর্শন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একই ভুল হবে যদি মানব প্রগতি ভাবনায় নারীকে বাদ দেয়া হয়। তিনি সমাজের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা ও পিতৃতান্ত্রিক আচরণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, মায়ের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত সব ছেলেই। কিন্তু নারীকে অবজ্ঞা করে ‘মেয়ে মানুষ’ বলতে কুণ্ঠাবোধ করেনা এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তিনি বলেন পুঁজিবাদী সমাজেও নারী বঞ্চনার শিকার, আর দরিদ্র নারীর বঞ্চনা বহুমাত্রিক। এ দেশে শোভন জীবন বাবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে কারো দ্বিমত নেই। এ পর্যায়ে লেখক অগণিত উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ বিষয়ে ঐক্যমত থাকলে ও কাজটি একেবারেই করা হয় না, বাস্তবতা সম্পূর্ণ অন্য রকম। আমি কয়েকটি বিষয় সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ না করে পারছি না। কথাগুলো আমার এবং আমার মত শতকোটি নারীর জীবনের। আশার কথা যে যিনি দরদ দিয়ে বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন এবং এর সমাধান খুঁজছেন ড. আবুল বারকাত, তিনিএই সমাজেরই একজন পুরুষ, তবে তিন কন্যার গর্বিত বাবা ।

ক্স বাক্তি জীবনে নারী জননী এবং শ্রদ্ধার । কিন্তু সেই নারী পরিবারে,সমাজেএবংরাষ্ট্রীয়
ব্যবস্থায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রক হবেন, এটি মানতে কি এই সমাজের মানুষ মানসিকভাবে প্রস্তুত? গবেষণা ছাড়াই জবাব দেয়া যায়, ‘না’ ।
ক্স কৃষিউৎপাদনে নারীর অবদান ৫০ শতাংশ, এর স্বীকৃতি কি আছে? বরং সমাজ ১০০ ভাগ নিশ্চিত যে, এই কাজের জন্যই নারীর জন্ম।
ক্স ১৮ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে সংসারের হাল ধরা মা সবার শেষে যা বাঁচবে তাই খাবেন, এটাই স্বীকৃত ।
ক্স মায়ের অপুষ্টির কারণে বংশ পরম্পরায় মহাবিপর্যয় চলছে, এই চক্র নিয়ে কোন ভাবনা আপাতদৃষ্টিতে চোখে পড়ে না।

ক্স পরিবারের সেবা যত্নের জন্যই মেয়েরা এটা স্বতঃসিদ্ধ এবং বদ্ধমূল ধারণা। কিন্তু এই সেবা শ্রমের শ্রদ্ধা মূল্য অথবা অর্থমূল্য আজো নিরূপণ করা হয়নি।
ক্স গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত নারী কর্মীদের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশী এবং বৈদেশিক মুদ্রার কতোটুকু অংশীদারিত্ব তারা পান? শোষণ এবং অবদান কোনোটারইস্বীকৃতি নেই, থাকেন অর্ধভুক্ত। কোভিড- ১৯ এবং লক ডাউনে তারা অভুক্ত, একথা আমরা ক’জন ভেবেছি?
ক্স পুত্র সন্তানের মা হতে না পারা নারীর জীবনের বড় অভিশাপ, কিন্তু এ বিষয়ে বিজ্ঞান সম্মত চিন্তা ভাবনার কোনো প্রচার প্রসার চোখে পড়েনা।
ক্স নারীরা যেখানে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ, সেখানে উন্নয়ন বাজেটে নারীর হিস্যা কেনো মোট ক্রীড়া বাজেটের ১৫ শতাংশ?
ক্স সরকারি হিসেবে ১২-১৫ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার। কিন্তু লেখকের গবেষণা অনুযায়ী ২৩ লক্ষ নারী গুরুতর নির্যাতনের শিকার, যাদের আইনগত, স্বাস্থ্যগত ও কাউন্সিলিং সেবা প্রয়োজন । এজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বাজেট কমপক্ষে ৩০ গুন বাড়ানো ।
ক্স অস্বাস্থ্যকর ও অবৈজ্ঞানিক পন্থায় নারীর মাটিতে বসে রান্নাবান্না এদেশের সবার কাছে স্বাভাবিক বিষয়। এতে নারীর স্বাস্থ্য ভঙ্গুর হয়ে পড়া, আয়ু কমে যাওয়া, হেঁসেলের অর্থনীতির এসব কেউ এখন ভাবছে না বলে লেখক চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ক্স জাতীয় আয়ে নারীর অবদান আজও অজানা। লেখক অংক কষে দেখিয়েছেন জিডিপি-তে নারীর অবদান ২০ শতাংশও স্বীকৃত নয়। কিন্তু প্রকৃত অবদান কমপক্ষে ৪৮ শতাংশের চেয়ে আরও অনেক বেশি, এমনকি তা ৬০ শতাংশও হতে পারে। এ পর্যায়েলেখক প্রশ্ন রেখেছেন কিসের ভিত্তিতে এ হিসেব ? তিনি বলছেন, আমরা শোভন অর্থনীতি সমাজ ব্যবস্থারকথা বলছি। যা কিছু মানব কল্যাণসৃষ্টি করে তার সবটুকুই শোভন জিডিপি-তে যোগ করতে হবে। এর যা কিছু জিডিপি-তে যোগ করা হয় কিন্তু মানব কল্যাণ উদ্দিষ্ট নয়, তা আসলে জিডিপি থেকে বিয়োগ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ‘পুরুষ জিডিপি’কমবে, ‘নারী জিডিপি’বাড়বে। লেখকের শেষ কথা ‘শোভন জিডিপি’- তে নারীর অবদান বাড়তে বাধ্য। তবেই প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গটি শোভন সমাজ ব্যবস্থার সমার্থক হতে সক্ষম হবে। নারী পুরুষের সম - সুযোগ, মানবাধিকার, অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, কাজ পাবার অধিকার, যুক্তি সঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার - সাংবিধানিক ভাবে সবই প্রাপ্য । তবু অনেক ক্ষেত্রেই নারী পিছনের কাতারে। লেখক আইনের আলোকে বিভিন্ন উদাহরণ এবং বাস্তবতার নিরিখে বলছেন, জমি- সম্পত্তিতেনারীর অধিকার – আইনগত ভাবে সীমিত, বাস্তবে নেই বললেই চলে। নারীর ক্ষমতায়নে এ এক অন্যতম বাধা। তার মতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক চর্চা - এসবই নারীর প্রতি বৈষম্য চিরস্থায়ী করেছে। লেখকের দেখানো শোভন আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় প্রকৃতির বিধান মেনে চললে থাকবে না ব্যক্তিগত মালিকানা, থাকবে না জমি - সম্পত্তির ক্রয়-বিক্রয় বাজার। সেক্ষেত্রে জমি - সম্পত্তি উদ্ভূত শোষণ বঞ্চনা ও বৈষম্যও দূর হবে। যতোক্ষণ তা না হচ্ছে, জমি সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার হবে বাতুলতা মাত্র। কীভাবে নারী সত্যিকার অর্থে তার মর্যাদার স্থান প্রাপ্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়িত হতে পারে, সে বিষয়ে লেখক এই বইয়ের ৪০৬ পৃষ্ঠায় ৭ টি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা, ধারণা, তার মৌলিক ভাবনা এবং করনীয় সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন। একই সাথে আছে শিশুর বিকাশের বিষয়টিও। নারীর ক্ষমতায়ন -উন্নয়ন কর্মসূচিপ্রসঙ্গে তিনি জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে সবধরনের নারীর মৌলিক চাহিদার বিষয় উল্লেখপূর্বক প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা তুলে ধরেছেন।

এর মাধ্যমে নারীর শোভন কর্মসংস্থান, ন্যায্য মজুরি, আবাসন, অবসর, বিনোদন, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে, সন্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শোভন সমাজের স্বপ্ন দেখছেন লেখক। বিরামহীনভাবে তিনি তার মৌলিক ভাবনা লিপিবদ্ধ করেছেন পাতার পর পাতা, খুঁজছেন সমাধানের পথ। নারীর ভালো মন্দ, সুযোগ সুবিধা, নির্যাতিত অসন্মান জনকপশ্চাদপদ অবস্থা, সব কিছুর সাথেই আমরা পরিচিত। কিন্তু লেখকের লেখা পড়ার সময় মনে বার বার প্রশ্ন জাগে, সবই তো সহজ এবং বাস্তবসম্মত তবে বাস্তবায়নে বাধাকোথায়? মূলত মৌলিক পরিবর্তন অন্তর থেকে চাইলে প্রয়োজন কাঠামো পরিবর্তনের। এমন সাহসী পদক্ষেপ বা সংস্কার কে করবেন, কীভাবে করবেন সেটিই বড় প্রশ্ন। বিশেষত স্বল্প আয়তন বিশিষ্ট ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই বিশাল দেশ, যাদের প্রতিনিয়ত হাজার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকতে হয়, তাদের পক্ষে ব্যাপক সংস্কারের বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে দুরূহ। তাই লেখকের মৌলিক ভাবনার শতভাগ বাস্তবায়ন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় হয়তো সম্ভব নয়, তথাপি আশাবাদী হওয়া যায় এই ভেবে যেকিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান কাঠামোতেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব। যেমন নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ নীতির পরিবর্তন আনয়ন বড় কোনো কঠিন কাজ নয়। দরিদ্র - প্রান্তিক নারীর দারিদ্র - বঞ্চনা - বৈষম্য- অসমতা দূর করতে বাজেট বাড়ানোর সুপারিশ ভেবে দেখা যেতেই পারে । নারী উদ্দিষ্ট কর্মসূচির বরাদ্দ স্পষ্টীকরণ কোনো কঠিন কাজ নয় বলেও আমি মনে করি।

নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা নিরসনে প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এজন্য সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ, মনিটরিং, ফলোআপ এবং সমন্বয় কর্মপদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকর হবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।এই নীতিমালায় যা কিছু আছে তার কতোটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা ভাববার সময় এসেছে। স্থানীয় সরকারে নারীর যথাযথ অংশীদারিত্ব, আদিবাসী নারীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় লেখক ১১,১৪৮ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। জেন্ডার সমতা বিষয়ক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে লেখক বাজেটে প্রয়োজনীয় স্টার্ট আপ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করেছেন। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় নারীর জন্য বরাদ্দ, জেন্ডার সংবেদনশীল প্রযুক্তি বান্ধব নীতি বাস্তবায়ন, জেন্ডার বাজেটের লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও পরিবিক্ষনের কথা অত্যন্ত যৌক্তিক। নারী উন্নয়ন নীতিমালায়এ বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে না। নারীর ক্ষমতায়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উল্লেখ করতে ভুলেননি লেখক। আরো একটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাব তিনি রেখেছেনঃ মানসম্মত প্রযুক্তি সহায়ক কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং সেখানে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

এর বাস্তবায়ন সম্ভব, যদি দায়িত্ব প্রাপ্ত যারা আছেন তারা সত্যিকার অর্থে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। আমাদের দেশে সঠিক পরিকল্পনার জন্য বাস্তবসম্মত এবং সঠিক তথ্য উপাত্তের বড়ই অভাব। কাজেই নারী উন্নয়ন ও জেন্ডার সমতার জন্য লেখকের কথার সাথে সুর মিলিয়ে আমারও স্বপ্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহ আন্তরিকভাবে দেশের সমৃদ্ধির জন্য নারী বিষয়ক গবেষণা করে তথ্য উপাত্ত নীতি নির্ধারকদের সরবরাহ করতে সচেষ্ট হবেন। শোভন বাংলাদেশে শোভন নারী সমাজদেখার স্বপ্ন নিয়ে আজ কিছুটা হলেও স্বস্তি বোধ করছি। প্রশাসনের সবোর্চ্চ পদে চাকরি করেও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কোনো অবদান রাখতে না পারার দুঃখ আমায় সারাক্ষণ পোড়ায়। আমি নিশ্চিত, ড. আবুল বারকাতের ‘বড় পর্দায় সমাজ - অর্থনীতি - রাষ্ট্র ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি যথাযথ মর্যাদা পাবে। শুধু সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে, বাস্তব সম্মত দিক নির্দেশনা সমূহ চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নের পথ অনুসন্ধান করতে পারলে, লাভবান হবে দেশ, উপকৃত হবে মানুষ, দেখা মিলবে শোভনসমাজের। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে টিকে থাকতে চাইলে ধরে রাখতে হবে উন্নয়নের ধারা। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে লেখক লক্ষ কথা বলেছেন, আমি বর্তমান প্রেক্ষিতে যা গ্রহণ সম্ভব আপাতত সেটাতেই মনোনিবেশের পক্ষে। শুরুটা তো হোক। তাহলেই প্রাথমিক জবাব মিলবে লেখকের হতাশার, ‘হবেটা কি ? রবি ঠাকুরের ভাষায়, যা আমাদের জাতিয় সঙ্গীতেরও অংশ ঃ
‘মা,তোর বদন খানি মলিন হলে,
ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি,
সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’

সেই দেশে যখন পুলিশ রিপোর্টে বলা হয় গত বছর ২৬ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার, সেখানে বাস্তব চিত্র কি হতে পারে অনুমান করা কঠিন নয়। এদের দুঃখে সহমর্মীহতে প্রয়োজন এক সমুদ্র নয়ন জল। কাজেই দেশ মাতৃকার মুখে হাসি ফুটাতে বিকল্প হতে পারে শোভন বাংলাদেশের স্বপ্ন। সেখানে যেটুকু এখনি বাস্তবায়ন যোগ্য তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে মর্যাদার আসনে কে না দেখতে চায় ? যারা চান না, তাদের থাকতে হবে হেঁসেল/ উনন বিহীন বাড়ী আর বংশবৃদ্ধি বর্জিত জীবন ব্যবস্থায়। যা অকল্পনীয়, অবাস্তব, বিকৃত এবং অশোভন। আশা করবো, ড. আবুল বারকাতের ‘বড় পর্দায় সমাজ - অর্থনীতি - রাষ্ট্র ভাইরাসের মহা বিপর্যয় থকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ - যারা হাতে পাবেন, পাতা উল্টাবেন, দেশে সুদিন আসবেই - সেই লক্ষ্যে যারা ভাবছেন এবং ভাববেন, নিজ নিজ স্থান থেকে কিছু করার তাগিদ বোধ করছেন, দেশকে আপন ভেবে অন্তর থেকে দেশের ভাল চাইছেন, তাদের জন্য এটা কেবল সুখপাঠ্যই নয়, হতে পারে তার চেয়েও বেশি কিছু। অনেক বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো দিক নির্দেশনা রয়েছে এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে । শুধু চাই গবেষনা মনস্ক মন, দেশের জন্য কিছু করার তাগিদবোধ। লেখকের বড় পর্দায় শোভন বাংলাদেশ এবং সেখানে নারীর মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নের ৫০ শতাংশও যদি বাস্তবায়িত হয় তবে হয়তো অশোভন শব্দের হাত থেকে রক্ষা পাবেবাংলাদেশ । লেখক : পিএইচডি, প্রাক্তন সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

 

 

 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়