ওয়ালিউর রহমান: বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আজ এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাম। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। উপনিবেশিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি হাঁপিয়ে উঠেছিল। শাসন, অত্যাচার, বৈষম্য, নিষ্পেষণ বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। তারা মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। যার ফলশ্রুতিতে এই ভ‚খণ্ডে এক পূর্ণজাগরণের সুচনা হয়েছিল, যার আভাস আমরা ৪৮, ৫২, ৬২, ৬৬ এবং ৬৯-এর আন্দোলনে দেখতে পাই। সে পূর্ণজাগরণে যোগ দিয়েছিল আবাল বৃদ্ধ বণিতা। এ সকল আন্দোলন ছিল কখনও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, কখনও ছাত্রদের বিজ্ঞানভিত্তিক- সার্বজনীন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, কখনও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা স্বায়ত্বশাসন আদায়ের জন্য সংগ্রাম। কখনও বা সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, কখনও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম এবং এই পুরো সময় জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদিয়কতা, গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। এ সব রক্তঝরা বেগবান আন্দোলন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এক মহাজাগরণের, এ জাগরণ স্বাধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন, স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-যার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেই তারিখ যা মহাকালের দেয়ালে সূর্য চিহ্ন এঁকে দিয়ে অনন্তকালের জন্য ভাস্কর করে দিলো।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ তারিখে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এতদঅঞ্চলের মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি ৪৮ থেকে শুরু করে ৭১ পর্যন্ত সময়ে ধাপে ধাপে সেই মহাজাগরণের ডাকটি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন ইতিহাসের সমান্তরালে। আর দেশের মানুষকে প্রস্তুত করেছেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহাজাগরণে সামিল হয়ে ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সময় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়তে, তিনিই হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সেই তেজদীপ্ত উচ্চারণ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম; শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশেরে সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে- স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জন রীড রচিত বিশ্বখ্যাত ‘Days that shook the world’-যে ক’টি দিনে রাশিয়ায় মহামতি লেলিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রতিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে ওই ১৮ দিন। বঙ্গবন্ধু জীবনের ব্রত ছিল একটাই আর তা হলো নিজের জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত থেকে হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করা।
হাজার বছরের পরাধীনতায়, স্বাধীনতা যে কী বাঙালিদের সেই বোধ হারিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুই সেই মহাপুরুষ যিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের ক‚টনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো।
আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি এ বক্তৃতাকে তুলনা করি রোমান সম্রাট সিসেসোর বক্তৃতার সঙ্গে। এ বক্তৃতার তুলনা করা হয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিটস, মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষণের সঙ্গে। আর তুলনা করা চলে আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত গ্যাটিসবার্গ এড্রেসের সঙ্গে। এ ভাষণের ব্যঞ্জনা তাৎপর্য ও গুরুত্ব সেদিন যারা কাছে বসে শুনেছেন তারাই বুঝতে পারবেন। সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক করতে এই ভাষণের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি যথার্থই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’- সত্য হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্যদিয়ে। এ ভাষণের সুর অনুসরণ করেই এক নতুন রেনেসাঁর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :