আহসান হাবিব: না, হতে পারে না, ভাষা নিজে সাম্প্রদায়িক নয়। মানুষ সাম্প্রদায়িক, তাই ভাষাকে সে সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ব্যবহার করে। এটা একটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ‘জল’ এ শব্দটি একটি চিহ্ন, যা দিয়ে আমরা এ অঞ্চলের মানুষ এমন একটি তরলকে বুঝি যা আমাদের তৃষ্ণা মেটায়, আমাদের পরিপাকের অন্যতম মূল উপাদান। জলের বিপরীতে আমরা যখন ‘পানি’বলি, তখনো একই তরলকেই আমরা শনাক্ত করি। তাহলে কেউ যখন জল বলে তখন তাকে কেন আমরা তাকে হিন্দু কিংবা পানি বললে মুসলিম বলি?
এটাই সাম্প্রদায়িকতা। এটা হিন্দু-মুসলিমের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ধর্ম ভাষাকে আত্মসাৎ করে মানুষকে বিভক্ত করে ফেলেছে। এ বিভক্তির ফলে আমরা ভাষা দিয়েই তার ধর্মীয় পরিচয় নির্ধারণ করি এবং রাজনৈতিক যে দ্বন্দ্ব তা প্রকাশ করে ফেলি। অথচ জল এবং পানি দুটোই বিদেশি শব্দ। ধর্ম এর উৎপত্তিস্থলের নৈকট্য বিবেচনায় রেখে নিজ ভাষায় কুক্ষিগত করে নিয়েছে। এ নেওয়ার পেছনে যেমন ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। যেহেতু বাংলা ভাষার উদ্ভব এবং এর বিবর্তনে রয়েছে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের ভাষার মিশ্রণ, তাই এটি অবিমিশ্র কোনো ভাষা নয়, পৃথিবীর কোনো ভাষাই তা নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বহু বিদেশি শাসকদের শাসন শোষণের ইতিহাস। যে যখন এ উপমহাদেশ শাসন করেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে ভাষা। এ ভাষা মিশে গেছে স্থানীয়দের ভাষার সঙ্গে। সেসব ধীরে ধীরে আত্মীকৃত হয়ে গেছে। তাহলে ভাষা কখন সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার হয়ে উঠলো?
যখন মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নিজেদের রাজনৈতিক আইডেন্টিটি নির্মাণ করতে চাইলো, ভাষার সাম্প্রদায়িকতা তখন থেকেই শুরু। উপরিকাঠামো ধর্ম কিন্তু অবকাঠামো রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বের ফলে ভাষাও এর সঙ্গে বলি হলো। একই বস্তুর নাম ভিন্ন (জল, পানি) হওয়ার ফলে এক দল এক একটিকে নিজেদের বলে কুক্ষিগত করে ফেলল এবং এভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন শুরু হয়ে গেলো। এটা সাহিত্যেও প্রভাব ফেললো, রাজনীতিতে তো বটেই। এখন আমি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করি ‘কেমন আছেন’? এর উত্তরে যদি তিনি বলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’তাহলে বুঝতে হবে এ উত্তরের পেছনে লোকটির সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিয়াশীল। কেউ যদি বলেন ‘ভালো আছি’ তাহলে বুঝতে হবে তার দৃষ্টিভঙ্গি অন্তত সাম্প্রদায়িক নয়। আমি বলতে চাইছি কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে একটি ভাষা ব্যবহার করছে, তার ওপরে নির্ভর করছে একটি নির্দোষ ভাষার সাম্প্রদায়িকিকরণ। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :