শিরোনাম
◈ অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধে বিটিআরসিতে তালিকা পাঠানো হচ্ছে: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ◈ পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ জলাবদ্ধতা নিরসনে ৭ কোটি ডলার ঋণ দেবে এডিবি ◈ ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে: মির্জা ফখরুল ◈ বেনজীর আহমেদের চ্যালেঞ্জ: কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে তাকে সব সম্পত্তি দিয়ে দেবো (ভিডিও) ◈ চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু ◈ আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না: সুপ্রিমকোর্ট ◈ তীব্র গরমে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা আরও ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা ◈ সিরিয়ায় আইএসের হামলায় ২৮ সেনা নিহত ◈ সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, পতন অনিবার্য: রিজভী 

প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:২৫ দুপুর
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:২৫ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: মুশতাক আহমেদ : যে মানুষটাকে মাথায় করে রাখা উচিত, তাকে মরতে হলো কারাগারে!

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: আসুন মুশতাক আহমেদ যে কতো বড় দুর্ধর্ষ অপরাধী ছিলেন তা একটু জেনে নিই। এই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন যারা তাদের চোখে মুশতাক এতই দুর্ধর্ষ ছিলেন যে তাকে দ্বিতীয়বারে ১১ মাস হাজত, ছয় বার জামিন আবেদন নাকচ এবং সবশেষে কাস্টডিতে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেই এই রাষ্ট্র প্রমাণ করেছে, মুশতাক আহমেদ কতো বড় দুর্ধর্ষ মানুষ ছিলেন। তাহলে তাকে যারা চিনতো তাদের জবানিতে তাকে আরও গভীরভাবে চিনি। ‘মুশতাক আহমেদ ছিলেন চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র, পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডেও যান। কৃষি খামারের প্রতি আগ্রহী হয়ে অনেক দেশে ঘুরে বেড়ান। দেশে সুন্দরবন থেকে শুরু করে আনাচে কানাচে ঘুরেছেন। কুমির পাগল ছিলেন তিনি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে তিনিই প্রথম কুমির চাষ করা শুরু করেন। মিডিয়ায় পরিচিত হয়েছিলেন ‘কুমির ভাই’  বলে। তার আগে পরিচিতরা তাকে পাগল ডাকত। দেশ থেকে প্রথম কুমির রপ্তানি করেন এই মুশতাকই। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যে পাগল ছিলাম না, তা প্রমাণ করতেই লেগেছে আট বছর।’দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে ৬৭টি কুমির রপ্তানির মাধ্যমে পরে মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হন যে তিনি পাগল ছিলেন না। অথচ কুমির চাষের অনুমতি পেতে দুই বছরে ৩২টি টেবিল ঘুরে আসতে হয়েছিলো তাকে। শুনতে হয়েছিলো, দেশের বাইরে টাকা পাচারের ধান্ধা এসব।

বুঝেন এবার, বিদেশে টাকা পাচার রোধে কি কঠোর ‘তারা’ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, বিসিএস, জব প্রিপারেশনের গাইডগুলাতে লাখ লাখ পোলাপান মুখস্ত করে, দেশের প্রথম কুমির চাষ হয়, ময়মনসিংহের ভালুকায়। হ্যাঁ, এটাই মুশতাকের সেই কুমিরের খামার ছিলো। সেই খামার পরে অন্যকে হস্তান্তর করেছিলেন যদিও। সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করা এ দেশের তরুণরা জানে না, বাংলাদেশের পথিকৃৎ একজন উদ্যোক্তার নাম। করোনাকালে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় অন্য অনেকের মতো সরকারের সমালোচনা করেছিলেন তিনিও, কার্টুনিস্ট কিশোরের কার্টুন শেয়ার দিয়েছিলেন। এর জন্য মুশতাক, কিশোরসহ আরও কয়েকজনকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ডিজাটাল আইন নামক কালা-কানুনে গ্রেপ্তার করা হয়। মাসের পর মাস জেলে বন্দী থেকে, জামিন না পেয়ে, নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি জেলেই মারা গেলেন।

স্রেফ একটা হত্যাকাণ্ড। একদিন আগেও জামিনের আবেদন করে জামিন পাননি মুশতাক, তাইলে হয়তো বেঁচে যেতেন তিনি। কুমির চাষে নামার আগে সুন্দরবন এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হয়েছিলো মাসিহা আখতার লিপার সঙ্গে, তাকেই বিয়ে করেছিলেন তিনি। লিপা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্রী, গবেষণা করেছিলেন মুক্তা চাষ ও ইলিশ নিয়ে। রীতিমতো ‘কুমির চাষের এনসাইক্লোপিডিয়া’  ছিলেন তিনি। এ জন্যই হয়তো আরেক কুমির পাগল মুশতাকের প্রেমে পড়েছিলেন। স্বামী জেলে যাওয়ার পর যে ধাক্কা সইতে হলো তাকে, তার ট্রমায় মানসিকভাবে অসুস্থ তিনি এখন, ধারণা করতেছি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন লিপা। স্ত্রীর এ অবস্থা জানার পরেও, মা-বাবার একমাত্র ছেলে ও ভরণপোষণকারী হওয়া সত্ত্বে ও মাসের পর মাস মুশতাককে জামিন দেওয়া হয়নি। যে স্বপ্নবাজ দম্পতি এ দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, দেশে নতুন একটি রপ্তানিমুখী খামারের জন্ম দিয়েছিলেন, বিদেশে গিয়ে সুখে থাকার বদলে দেশকেই বেছে নিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে দেশকে নতুন কিছু দিতে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন, তরুণদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করেছিলেন সেই মুশতাক আর লিপাকে তিলেতিলে শেষ করে দেওয়া হলো।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এসে এটাই এখন আজকের বাংলাদেশ আর আমরা তার ‘গর্বিত’নাগরিক। ‘এ কথাগুলো লিখেছেন রাফসান গালিব’। এবার আসুন আমরা আমার প্রিয় সহকর্মী কাজী হানিয়াম মারিয়া যে কিনা নিজেও একজন ক্যাডেট কলেজের ছাত্রী তার জবানিতে একটু জেনে নিই মুশতাক আহমেদ সম্পর্কে। ‘মুশতাক ভাইকে প্রথম দেখি ক্যাডেট কলেজ ক্লাবের সামনে। হাসিমুখে বললেন, তুমি তো দেখি ঢাকার আরেক প্রান্ত থেকে আড্ডা মারতে চলে আসলা। এর আগে আমাদের গ্রুপ আড্ডা হতো ইসিএফের পোস্টগুলোতে। ঘোষণা দিয়ে আড্ডা। ট্যাগ করে বিরক্ত করে ডেকে এনে আড্ডা।

এক্স-ক্যাডেট গ্রুপগুলোতে সদা হাস্যজ্জল এবং তুমুল জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব মুশতাক ভাই। আমার দেখা একমাত্র মানুষ যিনি অনলাইন-অফলাইন একইরকম। অফলাইনে নিজেকে মহাপুরুষ দেখানোর জন্য গালফুলানো বুলি কখনও ছাড়তে দেখিনি। ডিবেট গ্রুপে কারও সঙ্গে মতবিরোধ হলেও তাকে দেখেছি সেসব পোস্ট এড়িয়ে যেতে। তার লেখা কুমির চাষীর ডায়রি এবং চা-বাগানের দিনগুলো পড়লে বোঝা যায় লেখক হিসেবে তিনি কতোটা সাবলীল ছিলেন। তার কোনো ভয়ংকর রাষ্ট্রবিরোধী লেখা আমার চোখে পড়েনি। সমাজের অসংগতির সমালোচনা করে লিখে বরং তিনি সুনাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ তিনি চোখে ফিল্টার এটে চলতেন না যে শুধু ভালো ভালো দেখবেন, আর খারাপকে অন্য সময়ের সঙ্গে তুলনা করে মন্দের ভালো বলবেন। শেষবার যখন জামিন পেলেন, কেমন আছেনের জবাবে বলেছিলেন বেঁচে আছি।

আপনি নতুন কিছু করতে চান। আপনার মাথায় কেমন চিন্তা আসবে? সুপার শপ, অরণ্যে রিসোর্ট, বুটিকস, মাছ-মুরগির খামার, পাহাড় বা সমুদ্রের কাছে হোটেল। কিন্তু কখনও কি কুমির চাষের বা রপ্তানির কথা আপনার মাথায় আসবে। আমি বড়জোড় চিড়িয়াখানার ঘুমন্ত কুমির দেখে আসবো, নয়তো বাচ্চাদের সঙ্গে কুমির তোর জলে নেমেছি খেলবো। আমাদেরই মাঝে এক দুজন থাকে যারা সবার থেকে আলাদা চিন্তা করতে পারে। মুশতাক ভাই তাদের মধ্যে একজন। তার পরিচিত গন্ডীর মধ্যে তিনি কুমির ভাই নামেই পরিচিত ছিলেন। বেচারা বড় বড় হিংস্র জীবন্ত কুমির নিয়ে খেলেছেন বলে ভুলেই গেছিলেন যে ডাঙা নামক জলে থেকে মানুষরুপী কুমিরের সঙ্গে সখ্যতা না করলে অকালে মরে যেতে হয়। কুমির খামার যখন হস্তান্তর করে দিচ্ছেন তখন দুঃখপ্রকাশ করে মেসেজ দিয়েছিলাম। বলেছিলেন, কুমিরের চিড়িয়াখানা করবেন এবং বিনা টিকিটে ঘুরতে দিবেন। আপনার স্বপ্নগুলো আমাদের ছোট মাথার ধরাছোয়ার বাইরে, তাই তা বাস্তবায়নের সুযোগ আমরা আপনাকে দিতে পারিনি। বিদায় মাইকেল কুমির ঠাকুর’। এবার চিন্তা করে দেখুন যেই মানুষটাকে মাথায় করে রাখা উচিত, রাষ্ট্র তাকে মেরে ফেলেছে। আর যাদের জেলে থেকে মরে পচে গলে যাওয়া উচিত তারা এ রাষ্ট্রে সান-সৈকতে মহানন্দে থাকে। একে কি আর সভ্য রাষ্ট্র বলা যায়? লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়